লন্ডনে ইন্টারন্যাশনাল ল অ্যাসোসিয়েশন, বনে এনভায়রনমেন্টাল ল অ্যাসোসিয়েশন,
হেগে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস—সব জায়গায় অসীম শ্রদ্ধা আর সম্মানের
সঙ্গে তাঁর নাম উচ্চারণ করেন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় আইন বিশেষজ্ঞ ও
আইনজীবীরা। বিশ্বময় আইন আর মানবাধিকার জগতে বাংলাদেশ মানে একটি নামই শুধু।
তিনি ড. কামাল হোসেন।
কামাল হোসেন (জন্ম বরিশালের শায়েস্তাবাদে) বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট আইনজীবী, রাজনীতিবিদ এবং মুক্তিযোদ্ধা। সচরাচর তাঁকে "ডঃ কামাল হোসেন" হিসাবে উল্লেখ করা হয়। তিনি বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতাদের মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭২-এর ৮ই জানুয়ারি শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁকেও মুক্তি দেয়া হয়। তিনি শেখ মুজিবের সঙ্গে ১০ জানুয়ারি লন্ডন হয়ে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি সর্বদাই সোচ্চার। তাঁকে ব্যক্তিগত সততা, ন্যায্যতা, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রবক্তা হিসাবে সাধারণভাবে সম্মান করা হয়।
১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ২০ এপ্রিল তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জুরিসপ্রুডেন্সে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে ব্যাচেলর অব সিভিল ল ডিগ্রি লাভ করেন। লিংকনস ইনে বার-অ্যাট-ল অর্জনের পর আন্তর্জাতিক আইন বিষয়ে পিএইচডি করেন ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে । আইনজীবী সারা হোসেন তাঁর কন্যা।শিক্ষক, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী থেকে শুরু করে বস্তিবাসী, বিনা বিচারে আটক অসহায় মানুষ, সুবিধাবঞ্চিত নারী-শিশুসহ বহু মানুষ নির্যাতন, হয়রানি এবং শোষণ থেকে মুক্তি পেয়েছে তাঁর নিজের বা তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংগঠনগুলোর মাধ্যমে। দেশকে তিনি হাজার হাজার কোটি টাকার মামলায় জয়ী করেছেন সিমিটার এবং শেভরনের মতো জায়ান্ট বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলায় লড়ে। দেশের মানুষকে তিনি উজ্জ্বলভাবে তুলে ধরেছেন সারা বিশ্বের বিভিন্ন ফোরামে।
ড. কামাল হোসেন বাংলাদেশের সংবিধানের প্রণেতা হিসেবেই অধিক পরিচিত। রাজনীতিতে তিনি ছিলেন সবসময়ই সোচ্চার। ১৯৭০ সালের পাকিস্থানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আওয়ামীলীগের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচনা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালে আইনমন্ত্রী এবং ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ড. কামাল হোসেন জাতিসংঘের স্পেশাল রিপোর্টারের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় রয়েছেন। তিনি গণফোরাম নামের রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।
শুধু সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে নয়, ড. কামালের পুরোটা জীবন কেটেছে এই
ধারাতেই। তাঁর রাজনীতি, আইন পেশা বা সমাজচিন্তা—সবই মানুষের কল্যাণের জন্য,
কখনো অশুভ বা অমঙ্গলকর কিছুর জন্য নয়। বরং যা কিছু খারাপ তার বিরুদ্ধে
তিনি বারবার রুখে দাঁড়িয়েছেন, মানুষের কাছে আশা-ভরসা আর বিবেকের অনন্য
প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছেন। গুম, খুন, অন্যায়, শোষণ আর গণতন্ত্র হরণের বিরুদ্ধে
নিরন্তর যুদ্ধে কেটেছে তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময়।
আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের কিংবদন্তিরা কেউ
বেঁচে থাকেননি বহু বছর। না বঙ্গবন্ধু, না তাজউদ্দীন, না অন্য কেউ। আমাদের
সৌভাগ্য ড. কামাল হোসেন আছেন। কিংবদন্তি হয়ে বহু বছর টিকে থাকা অসাধারণ
একটি বিষয়। তিনি সেই অসাধারণ মানুষটি হয়েই রয়েছেন বাংলাদেশের হৃদয়ে,
বাংলাদেশের মানুষের কাছে।
বাংলাদেশে যেকোনো সুস্থ ধারার রাজনৈতিক, সামাজিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনে
তিনি অগ্রগণ্য একজন মানুষ হিসেবে স্বীকৃত ও সম্মানিত হয়েছেন। সংবিধান
ছাড়াও বহু গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়ন করেছেন। মানবাধিকার ও আইনের শাসন
প্রতিষ্ঠার মামলায় প্রধান ভূমিকা তিনি পালন করেছেন। তাঁর হাতে গড়ে উঠেছে
আইন ও সালিশ কেন্দ্র, ব্লাস্ট, টিআইবি, বিলিয়া, সেইলসসহ বাংলাদেশের
খ্যাতিমান সংস্থাগুলো।
ড. কামাল হোসেনের ঈর্ষণীয় বহু অর্জন রয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। তিনি জাতিসংঘ, কমনওয়েলথসহ শীর্ষস্থানীয় বহু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে নেতৃস্থানীয় বা পরামর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন। বিশ্ববিখ্যাত কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের (অক্সফোর্ড, আমস্টারডাম, ডান্ডিসহ) শিক্ষক কিংবা ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন, পৃথিবীর বহু দেশের জন্য খসড়া আইন প্রণয়ন করে দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আরবিট্রেশনের চেয়ারম্যান ও গবেষণা জার্নালের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সমুদ্রসীমা নিয়ে রাষ্ট্রসমূহের বিরোধে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের বিচারক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
তিনি তাঁর অতুলনীয় মেধা, বাগ্মিতা ও ব্যক্তিত্বের কারণে অনন্য উচ্চতায় আসীন হয়েছেন। বাংলাদেশকে নিজের কীর্তির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গৌরবান্বিত করেছেন।
ড. কামাল হোসেনের ঈর্ষণীয় বহু অর্জন রয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। তিনি জাতিসংঘ, কমনওয়েলথসহ শীর্ষস্থানীয় বহু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে নেতৃস্থানীয় বা পরামর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন। বিশ্ববিখ্যাত কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের (অক্সফোর্ড, আমস্টারডাম, ডান্ডিসহ) শিক্ষক কিংবা ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন, পৃথিবীর বহু দেশের জন্য খসড়া আইন প্রণয়ন করে দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আরবিট্রেশনের চেয়ারম্যান ও গবেষণা জার্নালের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সমুদ্রসীমা নিয়ে রাষ্ট্রসমূহের বিরোধে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের বিচারক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
তিনি তাঁর অতুলনীয় মেধা, বাগ্মিতা ও ব্যক্তিত্বের কারণে অনন্য উচ্চতায় আসীন হয়েছেন। বাংলাদেশকে নিজের কীর্তির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গৌরবান্বিত করেছেন।
ড. কামাল হোসেন একজন পুরোদস্তুর আইনজীবী। অক্সফোর্ড থেকে
পিএইচডি আর বিসিএল, লন্ডনের লিংকনস ইন থেকে বার-অ্যাট-ল করে ফিরে এসে তিনি
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৫৯ সালে।
অল্প কয়েক বছরে তিনি একজন তুখোড় আইনজীবী হিসেবে নিজের অবস্থান গড়ে নেন।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় লড়তে গিয়ে তিনি বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য একজন রাজনৈতিক
সহযোগীতেও পরিণত হন। তিনি সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে বিজয়ী
হয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে কমিটিকে দেশের সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব
দেন বঙ্গবন্ধু, তার সভাপতি করা হয় মাত্র ৩৫ বছর বয়সী কামাল হোসেনকে। এরপর
তিনি বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে কাছের একজন মানুষ হিসেবে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ
মন্ত্রণালয়ের (আইন, জ্বালানি ও খনিজ এবং পররাষ্ট্র) দায়িত্ব পালন করেছেন;
বহু ভালো ভালো আইন ও নীতি প্রণয়নে ভূমিকা রেখেছেন।
বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ড তাঁর জীবনের গতিপ্রবাহকে থমকে দেয়। তিনি কোনো দিনই এই হত্যাকাণ্ড মেনে নিতে পারেননি। এই হত্যাকাণ্ডের পর তিনি কয়েক বছর আর দেশেই থাকেননি। এ সময় বিদেশে খ্যাতিমান বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ও গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন, আইনবেত্তা হিসেবে তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন শুরু করেন। এরপর দেশে ফিরে এসে আওয়ামী লীগের পুনর্গঠনে সম্পৃক্ত হন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের কাজে নিবিষ্ট হন, আইন পেশায় আরও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েন।
নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনে তিনি রাস্তায় এবং আদালতে সমানভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
কিন্তু এরপর গণতন্ত্র, সুশাসন আর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ধীরে ধীরে
ফিকে হতে শুরু হলে তিনিও রাজনীতিতে তাঁর সংগ্রাম আরও কঠিন হয়ে পড়ে। বেশি
ব্যস্ত হয়ে পড়েন মানবাধিকার, আন্তর্জাতিক জ্বালানি, সমুদ্র ও পরিবেশ আইনের
একজন অগ্রগণ্য আইনবিশারদ হিসেবে।
বয়স তাঁকে কাবু করতে পারেনি। স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা পারেনি হতোদ্যম করতে। এখনো এই দেশে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার যেকোনো উদ্যোগে তিনিই সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। এই লড়াইয়ে সবচেয়ে নিরবচ্ছিন্ন, একনিষ্ঠ এবং নির্লোভ থেকেছেন তিনি।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে যে আলোচিত জোট গড়ে উঠেছে সেটির নেতৃত্বে আছেন ড. কামাল।
No comments:
Post a Comment