করোনাভাইরাসের লক্ষণ ও প্রতিরোধের উপায় : What is Coronavirus and what are the Symptoms? 

Corona Virus (Covid-19) করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) প্রায় সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যে এই ভাইরাসে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। আক্রান্ত অবস্থায় আছে ক‌য়েক লা‌খেরও বেশি। তবে অনেকে গবেষক মনে করছেন, আক্রান্ত হওয়া ব্যক্তির সংখ্যা ১০ গুণ হতে পারে।

আক্রান্ত হলে কীভাবে বুঝবেন
করোনাভাইরাস মূলত ফুসফুসে আক্রমণ করে। সাধারণত জ্বরের সঙ্গে শুকনো কাশি দিয়ে শুরু হয়। জ্বর ও কাশির এক সপ্তাহের মাথায় শ্বাসকষ্ট অনুভব হয়। এসব লক্ষণ দেখা দিলে রোগীকে হাসপাতালে নেওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির লক্ষণ প্রকাশ পেতে ১৪ দিন পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। এটাকে ইনকিউবেশন পিরিয়ড বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ রোগীর লক্ষণ প্রকাশের আগে এই ভাইরাস ব্যক্তির শরীরে এ সময় পর্যন্ত সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে।
তবে কিছু গবেষকের মতে, এই ইনকিউবেশন পিরিয়ড ২৪ দিন পর্যন্ত হতে পারে। আবার চীনের অনেক বিজ্ঞানী বলছেন, লক্ষণ প্রকাশের আগেও অনেকে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারেন।

করোনাভাইরাস কতটা মারাত্মক
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ৪৪ হাজার রোগীর তথ্য বিশ্লেষণ করে বলছে, আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৮১ শতাংশের শরীরে হালকা লক্ষণ দেখা দেয়। ১৪ শতাংশের শরীরের লক্ষণ দেখা দেয় এর চেয়ে মাঝারি আকারে। অন্যদিকে মাত্র ৫ শতাংশ করোনোভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন।

এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ১ থেকে দুই শতাংশ মানুষ মারা যায়। যদিও এই হার বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ হাজার হাজার মানুষ এখনো চিকিৎসাধীন, যাদের মধ্যে কেউ কেউ মারা যেতে পারেন। তাই মৃতের হার আরও বাড়তে পারে। আবার কত মানুষের শরীরী হালকা লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছে, তার সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। সেগুলো বিবেচনায় নিলে মৃতের হার আরও কমতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বে প্রতি বছর ১০০ কোটির মতো মানুষ ভাইরাসজনিত ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়ে থাকেন। এর মধ্যে ২ লাখ ৯০ হাজার থেকে সাড়ে ৬ লাখ পর্যন্ত মানুষ মারা যান। প্রতি বছরই এসব ভাইরাসের ভয়াবহতার মাত্রা পরিবর্তিত হয়ে থাকে।

করোনাভাইরাস কী নির্মূল করা সম্ভব
এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। তবে এর টিকা আবিষ্কারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। আশা করা হচ্ছে, চলতি বছরের শেষের দিকে এই টিকা মানুষের শরীরে পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করা যাবে।

যেহেতু এই ভাইরাসটি ফুসফুস ও শ্বাসকষ্টের সঙ্গে সম্পৃক্ত, সে হিসেবে বর্তমানে আক্রান্ত ব্যক্তিদের এ সংক্রান্ত চিকিৎসা দেওয়া হয়। আক্রান্ত ব্যক্তিদের আলাদা করে রাখা হয়। শ্বাসকষ্ট কমাতে কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যবস্থা করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন হাসপাতাল ও চিকিৎসকেরা নিজেদের মতো করে ভাইরাস প্রতিরোধী ওষুধ প্রয়োগ করে থাকেন।

কীভাবে নিজেকে রক্ষা করা করবেন
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, কোভিড-১৯ থেকে রক্ষা পেতে সাবান দিয়ে বারবার হাত ধুতে হবে, হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় টিস্যু বা রুমাল দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে ফেলতে হবে, হাঁচি-কাশি দেওয়ার পরপরই হাত ধুয়ে ফেলতে হবে, পারতপক্ষে নাক, মুখ ও চোখে হাতের স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ এতে এ ধরনের ভাইরাস হাত থেকে শরীরে প্রবেশ করতে পারে। হাঁচি-কাশি বা জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তির কাছাকাছি যাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।

কত দ্রুত ছড়াচ্ছে কোভিড-১৯
বর্তমানে প্রতিদিন এই ভাইরাসে আক্রান্ত শত শত নতুন রোগীর তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এ জন্য অনেক গবেষকই মন্তব্য করছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতো দাপ্তরিক প্রতিষ্ঠানগুলো আক্রান্ত ব্যক্তিদের যে সংখ্যা জানতে পারছে—প্রকৃত সংখ্যা তার থেকে ১০ গুণ বেশি হওয়াও সম্ভব।

চীনের বাইরে এ ভাইরাস সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া, ইতালি ও ইরানে। এখন পর্যন্ত ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, মিয়ানমারসহ বিশ্বের অন্তত ৪৩টি দেশে এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। সবচেয়ে বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে সংক্রমণের উৎপত্তিস্থল চীনের উহানে। বিশ্বে ৮০ হাজারের বেশি আক্রান্ত মানুষের মধ্যে কেবল হুবেই প্রদেশে আক্রান্তের সংখ্যা ৬৫ হাজারের ওপরে।

কীভাবে ছড়াল কোভিড-১৯
গত বছরের ডিসেম্বরে শনাক্ত হওয়া এ ভাইরাস চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরের ‘সাউথ চায়না সিফুড হোলসেল মার্কেট’ থেকে ছড়িয়ে পড়েছে বলে প্রাথমিক ডেটা বিশ্লেষণে জানা গেছে। ওই বাজারে বাদুড়, বন বিড়াল, সাপের মতো বন্য প্রাণীগুলোও খাওয়ার জন্য জীবন্ত বিক্রি করা হতো। বেশ কয়েকটি গবেষণার ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, বাদুড় থেকে মানুষের শরীরে এই ভাইরাস ছড়িয়েছে। অর্থাৎ প্রাণীর কাছাকাছি যাওয়া মানুষের মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়িয়েছে।

করোনাভাইরাসের অপর একটি রূপ হলো সার্সভাইরাস (সেভার একিউট রেসপিরেটরি সিন্ড্রম)। যা ২০০২ সালে চীনে ছড়িয়ে পড়ে অন্তত ৭৭৪ ব্যক্তি প্রাণী হারিয়েছিলেন। সার্সে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল আট হাজার ৯৮ জন। সে হিসেবে কোভিড-১৯ অনেক ভয়াবহভাবে ছড়াচ্ছে। সার্স ভাইরাস বাদুড় থেকে বনবিড়ালে সংক্রমিত হয়েছিল। পরে তা মানবদেহে ছড়িয়ে পড়েছিল।

ক‌রে‌ানাভাইরাস সংক্রান্ত হটলাইন নম্বরসমূহঃ
নভেল করোনাভাইরাস সংক্রান্ত যে কোনো তথ্য পেতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এই ১৩টি নম্বর সবসময় খোলা পাওয়া যাবে। ক‌রোনা ভাইর‌াস সার্ভিস সংক্রান্ত তথ্য পাবেন।
হটলাইন নম্বরগুলো হচ্ছে- ১৬২৬৩, ০১৪০১১৮৪৫৫১, ০১৪০১১৮৪৫৫৪, ০১৪০১১৮৪৫৫৫, ০১৪০১১৮৪৫৫৬, ০১৪০১১৮৪৫৫৯, ০১৪০১১৮৪৫৬০, ০১৪০১১৮৪৫৬৩, ০১৪০১১৮৪৫৬৮, ০১৯২৭৭১১৭৮৪, ০১৯২৭৭১১৭৮৫, ০১৯৩৭০০০০১১, ০১৯৩৭১১০০১১।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হটলাইনের নম্বরটিও (১৬২৬৩) এখন নভেল করোনাভাইরাস সংক্রান্ত তথ্য জানাতে ব্যবহৃত হবে। বাকি ১২টি নম্বর আইইডিসিআরের।
ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, যারা ব্যবহার করতে পারেন তাদের জন্য ই-মেইল ও ফেসবুকে আমাদের সাথে যোগাযোগ করা অনেক বেশি সহজ হবে। আইইডিসিআর’র ফেসবুক একাউন্টটি হলো- (iedcr,covid-19controol room) এবং ই-মেইল একাউন্টটি হলো (iedcrcovid19@gmail.com)।
“কারও নমুনা সংগ্রহের যদি প্রয়োজন মনে হয়, তারাও (স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হটলাইন) আমাদের জানাবেন নমুনা সংগ্রহ করতে হবে কি না।”

ক‌রোনাভাইরাস প্রতিরোধে পরামর্শ
করোনা ভাইরাস নিয়ে ভীত না হয়ে সতর্কতা অবলম্বন করার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের দেওয়া কিছু পরামর্শ মেনে চলতে সবাইকে পরামর্শ দিয়েছে সরকার।
>> নিয়মিত জীবণুনাশক বা সাবান বা হ্যান্ড ওয়াশ দিয়ে হাত ধোয়া উচিত।
>> কাশি বা হাঁচি দিচ্ছেন এমন ব্যক্তি থেকে ৩ ফুট দূরত্ব বজায় রাখা প্রয়োজন।
>> হাত না ধুয়ে চোখ, নাক ও মুখ স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
>> হাঁচি বা কাশি দেওয়ার সময় টিস্যু বা হাতের কনুই দিয়ে নাক ও মুখ ঢেকে রাখতে হবে।
>> যেখানে সেখানে থুথু নিক্ষেপ করা যাবে না।
>> রান্না করার আগে ভালো করে খাবার ধুয়ে নিতে হবে।
>> যে কোনো খাবার ভালো করে সিদ্ধ করে রান্না করতে হবে।
>> অসুস্থ ব্যক্তি বা প্রাণীর সংস্পর্শে আসা যাবে না।
>> কাপড় একবার ব্যবহার করে ধুয়ে ফেলুন।
>> বাড়ি এবং কর্মক্ষেত্র নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে।
>> বাইরে ব্যবহৃত জুতা ঘরে ব্যবহার করা যাবে না। খালি পায়ে হাঁটা যাবে না।
>> পরিচিত বা অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে হাত মেলানো বা আলিঙ্গন করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
>> জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্ট অনুভব করলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। অন্যের সংস্পর্শ  থেকে দূরে থাকতে হবে।
>> স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীর পরামর্শ অনুসরণ করে নিরাপদ থাকাই উত্তম পন্থা।
>> অসুস্থ বোধ করলে বাড়িতে অবস্থান করা উত্তম।
>> জনাকীর্ণ স্থানে সতর্ক থেকে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে।
>> শিশু, বৃদ্ধ ও ক্রণিক রোগীদের অধিকতর সতর্ক থাকতে হবে।
>> নিজেকে নিরাপদ রাখতে বিদেশ ভ্রমণ না করাই ভালো।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সন্দেহ, লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা দিলে সরাসরি জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে সরকার। বরং বাড়িতে থেকে হটলাইন নম্বরে ফোন করলে তারাই বাড়িতে গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করবে বলে জানানো হয়েছে।

No comments:

Post a Comment