রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার আরিফুলরা চার ভাইবোন। চারজনই শিক্ষিত। ছোট ভাই হাফেজ আসিফ পাবনার একটি মসজিদে ইমামতি করেন। চার বছর আগে তিনি পাবনা থেকে আরিফুল ইসলামকে তিন জোড়া শৌখিন পাখি কিনে দিয়েছিলেন। পাখি দেখে বাবা আসাদুর রহমানের সে কী রাগ! বাবাকে বুঝিয়ে বাড়িতে পাখি পালন শুরু করেন আরিফুল।
ছয় মাস পর যোগ হয় নতুন আরও দুই জোড়া পাখি। এরপরই শুরু হয় ডিম দেওয়া। পাঁচ জোড়া পাখি এক বছরে হয়ে দাঁড়ায় ২০ জোড়ায়। আরিফুল ‘ভাই ভাই’ নামে গড়ে তোলেন পাখির খামার। এখন তিনি পুরোদস্তুর খামারি। বর্তমানে প্রতি মাসে পাখি বিক্রি করে তাঁর আয় হচ্ছে ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা। তাঁর দেখানো পথে গ্রামের অনেক তরুণ-যুবক বাণিজ্যিকভাবে পাখি পালন শুরু করেছেন।
উপজেলা সদর থেকে আট কিলোমিটার দূরে সয়ার ইউনিয়নের মণ্ডলপাড়া গ্রামে আরিফুলের বাড়ি। কাঁচা-পাকা পথ ধরে যেতে হয় তাঁর বাড়িতে। আরিফুলের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, তিনি খামারে পাখি পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। কিছুক্ষণ পর খামার থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। এরপর পাখির খামার করার গল্প শোনালেন।
আরিফুল ইসলাম জানান, তাঁরা এক বোন ও তিন ভাই। বাবা আসাদুর রহমান পেশায় কৃষক। তাঁদের সাত বিঘা জমি আছে। বড় ভাই আনিছুল ইসলাম জাপান টোব্যাকো কোম্পানিতে চাকরি করেন। আর ছোট ভাই হাফেজ আসিফ পাবনা সদর উপজেলার কলাবাগান মসজিদে ১০ বছর ধরে ইমামতি করেন। ২০১১ সালে মাস্টার্স শেষ করার পর আরিফুল চাকরির জন্য হন্যে হয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরেন।
তিনি জানান, চাকরি না পেয়ে তিনি বাড়িতেই শুরু করেন চাষাবাদ। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে তিনি ছোট ভাই আসিফের কাছে পাবনায় বেড়াতে যান। সেখানে বড় বড় পাখির খামার দেখে উৎসাহিত হন তিনি। তাঁর উৎসাহ দেখে ছোট ভাই আসিফ পরিচিত এক খামারির কাছ থেকে ২ হাজার ৪০০ টাকায় তিন জোড়া শৌখিন বাজরিকা জাতের পাখি কিনে খামার করার পরামর্শ দেন।
পাখি নিয়ে বাড়ি ফিরলে আরিফুলের বাবা রেগে যান। আরিফুলকে গালমন্দও করেন। পরে মুঠোফোনে ছোট ভাই আসিফ বাবাকে বোঝান। বাবা শান্ত হলে নিজ বাড়িতে খাঁচায় পাখি পালন শুরু করেন। ছয় মাস পর আরও দুই জোড়া ডায়মন্ড ডোভ জাতের পাখি কিনে আনেন। পাখি ডিম দেয়। ডিম থেকে বাচ্চা হয়। এভাবে বাড়তে থাকে আরিফুলের পাখির সংখ্যা। একসময় বাড়ির সামনে একটি ঘর তুলে গড়ে তোলেন পাখির খামার।
আরিফুলের খামারে বর্তমানে বাজরিকা, ফিঞ্চ, মুনিয়া, ডায়মন্ড ডোভ জাতের ৭০ জোড়া পাখি রয়েছে। এসব পাখির অনবরত কিচিরমিচির শব্দে চারপাশ মুখরিত থাকে। সঠিক পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণে ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর পর তা বড় করা হয়। এরপর বয়স অনুযায়ী বিক্রি করা হয় বিভিন্ন দামে।
আরিফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার খামারে বাজরিকা জাতের পাখি সবচেয়ে বেশি। এই পাখি বছরে চারবার ডিম দেয়। প্রতিবার ডিম দেয় ৫ থেকে ৭টি। ডিম থেকে বাচ্চা হতে সময় লাগে ১৭ থেকে ১৮ দিন। বাচ্চার বয়স ৩০ থেকে ৩৫ দিন হলেই উড়তে পারে। প্রজননের উপযোগী হতে চার মাস সময় লাগে। অন্যান্য জাতের পাখিগুলোও প্রজননে কাছাকাছি সময় নেয়।’
তিন মাস বয়সী বাজরিকা জাতের এক জোড়া পাখি ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৩০০, ফিঞ্চ ৭০০ থেকে ৮০০, মুনিয়া ৫০০ থেকে ৬০০, ডায়মন্ড ডোভ ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। পাখিকে খাবার হিসেবে দেওয়া হয় চিকন ধান, কাউন, চিনা ও সূর্যমুখী ফুলের বীজ। প্রতি মাসে একেক জোড়া পাখির জন্য ৫০ থেকে ৬০ টাকা খরচ হয়। বর্তমানে মাসে ৩০ জোড়া পাখি বিক্রি করে খরচ বাদে আরিফুলের মাসে ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা আয় হয়। পাইকারেরা খামারে এসে পাখি কিনে নিয়ে যান।
আরিফুলকে দেখে ওই গ্রামের যুবক সজীব হোসেন, হেলাল মিয়া, মিলন রহমান, এমদাদুল হক পাখির খামার করে বেকারত্ব ঘুচিয়েছেন। সজীবের খামারে এখন ১২ জোড়া পাখি রয়েছে। পাখির বাচ্চা বিক্রি করে মাসে তাঁর আয় হচ্ছে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা। হেলাল মিয়াও পাখি বিক্রির চার মাসের আয়ের টাকায় একটি গাভি কিনেছেন।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ফরহাদ নোমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আরিফুল ইসলাম আদর্শ খামারি। তিনি নিভৃত পল্লিতে শৌখিন পাখি পালন করে যে সাফল্য অর্জন করেছেন, তা অবিশ্বাস্য। দেশের শিক্ষিত বেকার যুবকদের জন্য এটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে। আমরা তাঁকে সব সময় সহযোগিতা করছি।’
No comments:
Post a Comment