সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশের শীর্ষ ইস্পাত উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম, আবুল খায়ের স্টিল, কেএসআরএম, জিপিএইচসহ বড় বড় কারখানা ছাই রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত। বিশেষত বিএসআরএম দীর্ঘদিন ধরে সরাসরি রপ্তানি করে এলেও গত দুই বছরে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরেক জায়ান্ট জিপিএইচ স্টিলও। এসব ছাই কারখানা থেকে সংগ্রহ করে রপ্তানিতে যুক্ত তৃতীয়পক্ষের অনেক ব্যবসায়ীও।
জানা যায়, বর্তমানে দেশে প্রায় ৬০ লাখ টন এমএস রড উৎপাদন হয়। রড উৎপাদন করে- বিএসআরএম, কেএসআরএম, একেএস, জিপিএইচ, এইচএম, বন্দর, আনোয়ার ইস্পাতের মতো বড় জায়ান্টরা। এরই মধ্যে অনেকে কারখানা সম্প্রসারণ করে সক্ষমতা বাড়ানোর কাজ শুরু করেছে। ২০২৩ সালে রড উৎপাদনের সক্ষমতা এক কোটি টনে উন্নীত হবে বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা। এ শিল্পে যুক্ত হচ্ছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিও। আগে বায়ুদূষণের জন্য ইস্পাত কারখানাগুলোকে দায়ী করা হলেও নতুন নতুন প্রযুক্তি আসায় তা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে।
অন্যদিকে, ইস্পাত প্ল্যান্টগুলোতে পুরোনো লোহা গলানোর সময় চুল্লি থেকে কালো ধোঁয়ার মাধ্যমে ছাই বেরিয়ে আসে। এসব কালো ধোঁয়া এয়ার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের (এটিপি) মাধ্যমে পরিশোধন করা হলে বাতাস এবং ছাই আলাদা হয়ে যায়। পরিশোধনের পর স্বচ্ছ বাতাস খোলা আকাশে ছেড়ে দেওয়া হলেও ছাইগুলো জমা পড়ে নির্ধারিত বাস্কেটে। এরপর পরের প্রক্রিয়াগুলো শেষে এসব ছাই চলে যায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, চায়না, থাইল্যান্ড, কোরিয়া, স্পেন, তুরস্ক ও ভারতে এই ছাই রপ্তানি হয়। মূলত ছাই প্রক্রিয়াজাত করার মাধ্যমে কালি ও প্রিন্টারের কার্টিজ তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
বাংলাদেশে প্রায় ৭০ বছর ধরে ইস্পাত শিল্পের সঙ্গে জড়িত বিএসআরএম। মূলত বিএসআরএমের হাত ধরে দেশে সমৃদ্ধ হয় ইস্পাত শিল্প। সময়ের ব্যবধানে নতুন নতুন উদ্যোক্তা আসে এ শিল্পে। দেশের জনপ্রিয় ব্র্যান্ড বিএসআরএম’র পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তির সংযোজন ঘটছে অন্যদের প্ল্যান্টগুলোতেও। বর্তমানে জিপিএইচের কারখানা সবচেয়ে আধুনিক কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস প্রযুক্তির সংযোজন করেছে। একেএসের কারখানায়ও সংযোজন করা হয়েছে এই প্রযুক্তি। প্রযুক্তির উৎকর্ষতার কারণে পরিবেশ দূষণ অনেকটাই কমে গেছে এ শিল্পে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কারখানাভেদে রপ্তানিযোগ্য ছাইয়ে জিঙ্ক অক্সাইডের মাত্রা কম-বেশি হয়। বিশেষত কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস ও ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস প্রযুক্তির কারখানাগুলোতে আনুপাতিক হারে ছাই বেশি উৎপাদন হয়। কিন্তু এসব ছাইয়ে জিঙ্ক অক্সাইডের পরিমাণ কম থাকে। অন্য প্রযুক্তির কারখানাগুলোর ছাইয়ে অপেক্ষাকৃত জিঙ্ক অক্সাইড বেশি থাকে। যে কারণে বিদেশের প্রক্রিয়াজাত কারখানাগুলোতে অপেক্ষাকৃত বেশি জিঙ্ক অক্সাইডের ছাইয়ের চাহিদা বেশি থাকে। এসব ছাইয়ের দামও থাকে বেশি।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ থেকে প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে জানা যায়, প্রতি টন জিঙ্ক অ্যাশ কিংবা স্টিল ডাস্ট ৯৮ ডলার থেকে আটশ ডলারে রপ্তানি হয়। তবে ঢেউটিন, সিআই শিট কারখানার সলিড জিঙ্ক অক্সাইড রপ্তানি হয় প্রতি টন দুই হাজার থেকে সাড়ে ৪ হাজার ডলারে। বছরে ইস্পাত কারখানার ছাই রপ্তানি থেকে বাংলাদেশ আয় করছে প্রায় দুইশ কোটি টাকা।
তথ্যমতে, বিএসআরএম ও জিপিএইচ ইস্পাত বাদেও থ্রি আর রিসোর্স লিমিটেড, ভুলারপাড়া অ্যাগ্রো ফার্মস লিমিটেড, ব্রাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, জেএস আয়রন মার্ট, মেসার্স বোন ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, মেসার্স ইপিএস ইন্টারন্যাশনাল, রয়েল মেটাল অ্যান্ড মিনারেলস ট্রেড এবং টিনু ভুইয়া ট্রেডিং নামে প্রতিষ্ঠানগুলো স্টিল ডাস্ট (ছাই) রপ্তানি করছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসআরএম গ্রুপের বাণিজ্য বিভাগের প্রধান কাজী কামরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, এক সময় ইস্পাত শিল্পের কারখানাগুলোর স্টিল ডাস্ট ফেলে দেওয়া হতো। এতে দূষিত হতো পরিবেশ। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে এসব স্টিল ডাস্টের (ছাই) চাহিদা রয়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের স্টিল ডাস্টে প্রায় ৫০ শতাংশের বেশি জিঙ্ক অক্সাইড রয়েছে। অন্যদের কারখানায় খুব অল্প পরিমাণে জিঙ্ক অক্সাইড থাকে। যে কারণে বিশ্ববাজারে আমাদের ছাইয়ের চাহিদা বেশি। প্রতিযোগিতামূলকভাবে আমরা মূল্যও বেশি পাই। এখন আমরা প্রতি বছরই এসব ছাই রপ্তানি করি। দেশের মোট রপ্তানির ৬০ শতাংশ করি আমরাই। এছাড়া শুধু আমরাই সরাসরি রপ্তানি করি। সম্প্রতি জিপিএইচ সরাসরি রপ্তানি করছে। অন্যরা তৃতীয়পক্ষের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে। বর্তমানে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কারখানাগুলো থেকে স্টিল ডাস্ট সংগ্রহ করে রপ্তানি করছে।
এ কর্মকর্তা আরও বলেন, বিএসআরএম বছরে প্রায় ১২ হাজার টন ছাই রপ্তানি করে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ছাই রপ্তানি করে প্রায় ৬২ লাখ ডলার আয় করেছে। বাংলাদেশি টাকায় যা ৫০ কোটি টাকার বেশি।
প্রতিষ্ঠানটি শুরু থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় দুইশ কোটি টাকার ছাই রপ্তানি করেছে বলেও জানান তিনি।
জিপিএইচ ইস্পাতের নির্বাহী পরিচালক (অর্থ ও ব্যবসা উন্নয়ন) কামরুল ইসলাম এফসিএ বলেন, আমাদের প্ল্যান্ট দেশের মধ্যে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির। আমরা বর্তমানে কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস প্রযুক্তির সংযোজন করেছি। আমাদের কারখানায় প্রতি টন লোহা পরিশোধন করার ক্ষেত্রে শুধু এয়ার পলিউশন কন্ট্রোল ব্যবহারের জন্য আড়াইশ থেকে তিনশ টাকার মতো খরচ হয়। এটি বাধ্যতামূলকভাবে চালাতে হয়। এ প্ল্যান্ট থেকে আমরা স্টিল ডাস্ট রপ্তানি করছি।
তিনি বলেন, জিপিএইচ ছাড়াও একেএসের প্ল্যান্টে ডাস্ট কালেকশন প্রযুক্তি অনেক উন্নত। তাই এ প্ল্যান্ট দুটি থেকে সবচেয়ে বেশি ডাস্ট সংগ্রহ হয়। অন্য কারও এত বেশি পরিমাণে ডাস্ট আসে না। আনুপাতিক হারে জিপিএইচের সবচেয়ে বেশি ডাস্ট সংগৃহীত হয়। এর মাধ্যমে পরিবেশের সর্বোত্তম সুরক্ষা হচ্ছে। শুধু আমাদের কারখানা থেকেই প্রতিদিন ৩০ টন জিঙ্ক ডাস্ট আসে। যেখানে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত জিঙ্ক অক্সাইড থাকে।
এ কর্মকর্তা বলেন, আমরা ২০২০ সালের শেষ দিক থেকে জিঙ্ক অক্সাইড সরাসরি রপ্তানি শুরু করেছি। এরই মধ্যে থাইল্যান্ড, চায়না, কোরিয়ায় রপ্তানি হচ্ছে। বর্তমানে প্রতি মাসে ৭শ থেকে এক হাজার টন চাই রপ্তানি করছি। এ খাত থেকে ২০২১ সালে আমাদের প্রায় ১১ লাখ ডলার আয় এসেছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ১০ কোটি টাকার মতো।’
No comments:
Post a Comment