সখ থেকে রশিদ সেলিমের সারুমা অ্যাভিয়ারি

 সেলিমের মা ময়না পুষতেন। ঘরময় ঘুরে বেড়াত ময়না। কথাবার্তা বলত। সেলিম অবাক হয়ে দেখতেন।

তারপর  সেলিম নিজেই একটি শালিককে পোষ মানান। এখন বজলুর রশিদ সেলিমের সারুমা অ্যাভিয়ারি দেশের অন্যতম বৃহৎ পাখির খামার। মুহাম্মদ শফিকুর রহমান গল্প করে এসেছেন।

বেজি, বিড়াল, কুকুর, বানর, সাপও পোষ মানিয়েছেন সেলিম; কিন্তু ২০১১ সালে সেলিমের বাইপাস সার্জারি হয়। ডাক্তার বলেন, টেনশনমুক্ত থাকতে। তিনি খাঁচায় পাখি পালনের কথা ভাবেন। এটিকে তিনি টেনশনমুক্ত থাকার উপায় ভাবতে থাকেন। ৫০ জোড়া বাজরিগার পাখি কিনে ফেলেন। এগুলো খাঁচার বিদেশি পাখি। এখন তাঁর সংগ্রহে ৫০ প্রজাতির কয়েক শ পাখি আছে। সারুমা অ্যাভিয়ারি বিডির তিনি মালিক। এখন নারায়ণগঞ্জের থানাপুকুর পারে তাঁর পক্ষীশালা। 

তাঁর দারুণ সংগ্রহ

প্যারাকিট (একটু বড় পাখি) জাতের প্রায় সব রকমের পাখি আছে তাঁর কাছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য মলুক্কান কাকাতুয়া (পূর্ব ইন্দোনেশিয়ার নেটিভ), আফ্রিকান গ্রে প্যারট, ইলেকটাস প্যারট (নিউগিনি বা সলোমন আইল্যান্ডের নেটিভ পাখি), ব্লু অ্যান্ড গোল্ড ম্যাকাও, ক্যাটাগনিয়ান কনুর, গালা কাকাতুয়া, চ্যাটারিং লরি, ব্ল্যাকক্যাপ লরি, ইয়োলো বিপ লরি, রেড লরি, মলুক্কান রেড লরি, ব্লু মাউনটেন লরি, রেইনবো রেড কালার লরি, পারফেক্ট লরি, ব্ল্যাক উইং লরি, কার্ডিনাল লরি, ব্লু স্টিক লরি, সান কনুর, গোল্ডেন হেড কনুর, ইয়োলো সাইডেড কনুর, পাইনাপেল কনুর, ব্লু কনুর, লুটিনো রিংনেক, এলবিনো রিংনেক, অস্ট্রেলিয়ান কিং প্যারট ইত্যাদি। আরো আছে ডায়মন্ড ডোভ, গ্রিন চিক কনুর, এলবিনো ক্রিস্টেট বেঙ্গলি ফিঞ্চ, জেব্রা ফিঞ্চ, পাইড বেঙ্গলি, ক্যালিফোর্নিয়ান কোয়েল ইত্যাদি। এগুলোর অনেকটাই দুর্লভ।  

উল্লেখ্য, খাঁচার পাখি দুইভাবে পালা যায়। খাঁচায় এবং কলোনি করে। কলোনি হলো খোলা জায়গায় ছেড়ে পাখি পালা। সেলিম দুই জায়গায়ই সফলতা পেয়েছেন। একদিকে ককাটেল পাখির কলোনি করে সফল হয়েছেন। অন্যদিকে সান কনুর, রেড লরির মতো পাখি খাঁচায় ব্রিড করিয়েছেন।

তাঁর ময়ূর নাচে

সেলিমের খোলা ছাদে ময়ূর নাচে। পেখম মেলে রঙের ফোয়ারা ছোটায়। ১২টির মতো ময়ূর আছে তাঁর অ্যাভিয়ারিতে (পক্ষীশালায়)।   ব্যক্তিগত সংগ্রহে এত ময়ূর দেশে বোধ হয় আর নেই। সেলিম বললেন, ‘ময়ূরের ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে ৩০ দিন লাগে। নানা রকম বীজ আর শাকসবজি খেতে পছন্দ করে ওরা। আমার পক্ষীশালার একটি বড় আকর্ষণ এই ময়ূরগুলো। ’

তাঁর ভাণ্ডারে ম্যান্ডারিন ডাক

খুব সুন্দর পাখি ম্যান্ডারিন ডাক।   ছাদে ১০ ফুট বাই ১০ ফুট ঘর করে এই পাখি পালা যায়। সেলিম বললেন, ‘এক জোড়ার দাম প্রায় ৩০ হাজার টাকা। ’  ম্যান্ডারিনের ঘরে জলাধারও করেছেন তিনি। সেখানে ওরা ভেসে বেড়ায়। সেলিমই বাংলাদেশে প্রথম এবং একাধিকবার ম্যান্ডারিন ডার্ক ব্রিডিংয়ে (উৎপাদন)  সফল হয়েছেন।

তবে শুরুটা সহজ ছিল না

২০১২ সালের ঘটনা। অফিসে ব্যস্ত ছিলেন সেলিম। পাখি দেখাশোনা করত একটি মেয়ে। মেয়েটি এসে বলল, ‘স্যার পাখিগুলো জানি কেমন করছে। ’ ১৫ মিনিটের মধ্যে ৫০ জোড়া পাখি মারা গেল। সেলিম চোখে-মুখে অন্ধকার দেখলেন। পাখির মূল্য ছিল প্রায় চৌদ্দ লাখ টাকা। তবে তিনি ভেঙে পড়লেন না; বরং তাঁর জেদ চাপল। বলছিলেন, ‘শখের পাখির হঠাৎ মৃত্যু আমাকে জেদি করে তোলে। ভাবলাম সফল আমাকে হতেই হবে। ইন্টারনেটে পড়াশোনা শুরু করি। বুঝতে পারলাম, আমদানি করা পাখিতে ভাইরাস সংক্রমণ ঘটেছে। নতুন করে আবার পাখি নিয়ে আসি। নতুন করে আবার শুরু করি। পাখিদের আচার-আচরণ বোঝার চেষ্টা করেছি। পাখি মারা গেলেই আমি পড়াশোনা নতুন উদ্যমে শুরু করতাম। খুঁজতাম সমাধান। বলতে পারেন ঠেকে ঠেকেই শিখেছি। ’

ইতিহাস লিখলেন

৩ সেপেম্বর ২০১৮। বাংলাদেশে ইতিহাস সৃষ্টি করলেন সেলিম। মলুক্কান কাকাতুয়ার বাচ্চা ফোটে তাঁর অ্যাভিয়ারিতে। ম্যান্ডারিন ডাক, চ্যাটারিং লরি, ব্ল্যাক ক্যাপড লরি, প্রিন্সেস অব ওয়েলস, ক্যালিফোর্নিয়ান কোয়েল ইত্যাদি পাখির বাচ্চা উৎপাদনেও তিনিই প্রথম বাংলাদেশে। বললেন, ‘অনেকে ২০ কিংবা ৩০ বছরে পাখি পালন করে যতটা সফল হয়েছে, আমি মাত্র সাত বছরে তার চেয়ে বেশি সফলতা পেয়েছি। ’

ভালোবাসি সন্তানের মতো

‘পাখিকে আমি আমার সন্তানের মতো ভালোবাসি। ওদের ছাড়া থাকতে পারি না। ’ বললেন সেলিম। সান কনুর পাখির বাচ্চাকে মুখে তুলে খাবার খাওয়াচ্ছিলেন মাইশা মুবাসশেরা। ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষে পড়ে। সেলিমের একমাত্র সন্তান। সেলিমের স্ত্রীও পাখির কাজে সাহায্য করেন। সেলিম জানালেন, তাঁর পাখিগুলো দেখে আত্মীয়-স্বজনরাও আনন্দ অনুভব করে। দুঃখ হলো, প্রিয় মা-বাবা তাঁর সফলতা দেখে যেতে পারেননি।

পাখির যত্ন-আত্তি, খাবার

সেলিমের অ্যাভিয়ারিতে লাইট জ্বালানো নেই কোনো খাঁচায়। তার ওপর আবার খোলা ছাদ। পাখিগুলোর কি শীত লাগছে না? সেলিম বললেন, ‘আমি আমার পরিবারের খাবারের প্রতি যেমন যত্নবান, পাখির জন্যও তাই। এক দিন ফল, এক দিন শাক, এক দিন সবজি, এক দিন এগ ফুড দিই ওদের। ফলে ফিজিক্যালি পাখিগুলো অনেক শক্ত। ’ আপন নামের একটি ছেলে সেলিমকে পাখি পালনে সহায়তা দেন। আপনেরও খুব ভালো লাগে পাখি।

টেইম এক্সপার্ট

টেইমের সরল অর্থ পোষ মানানো। এ ক্ষেত্রে পাখি উন্মুক্ত পরিবেশে ঘুরে বেড়াবে, তবে উড়ে যাবে না। ডাক দিলে হাতে আসবে। আদেশ-নিষেধ শুনবে। সেলিম রীতিমতো টেইম এক্সপার্ট। অসংখ্য পাখি তিনি টেইম করেছেন। বনের শালিকও টেইম করতে তিনি সফল হন। বেজির মতো চঞ্চল প্রাণীও তাঁর টেইম ছিল। তিনি বললেন,  রেইনবো লরি সবচেয়ে প্লে ফুল টেইম পাখি। সারাক্ষণ খেলাধুলা করে। মানুষের সঙ্গে বেশ ভালো বন্ধুতা গড়ে। টেইম কিভাবে সহজে করা যায়? বললেন, সময় দিতে হবে। ছোট বেবি হ্যান্ড ফিড মানে হাতে করে খাওয়াতে হবে। পাখির সঙ্গে কথা বলতে হবে। কথা শুনলে পুরস্কার যেমন—খাবার দিতে হবে। না শুনলে মৃদু শাস্তি দিতে হবে। সতর্ক করে তিনি বললেন, টেইম পাখি ঘরে নিরাপদ বেশি। বাইরের পরিবেশে ততটা নয়।  

সেলিম ভাই আছেন

পাখি পালনে কারো কোনো সমস্যা হলে ছুটে যান সেলিম ভাইয়ের কাছে। তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যাভিয়ান কমিউনিটি অব বাংলাদেশ সংস্থার। এটি সরকার অনুমোদিত সংস্থা। এই সংস্থা পাখি প্রদর্শনীর আয়োজন করে থাকে। প্রচুর পড়াশোনা আর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বিদেশি পাখির লালন-পালন ও ব্রিডিং সিস্টেমের স্থানীয় কায়দা তিনি বের করে ফেলেছেন।    তাঁরটি দেখে নতুনরা শিখতে পারছে। সেলিম নতুনদের পাখি বিষয়ে বেসিক জ্ঞান অর্জন, পাখির ফার্ম ভিজিট, বড় ব্রিডারদের সঙ্গে যোগাযোগ, শুরুতেই ব্যাবসায়িক চিন্তা না করা ও পাখির যত্ন নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।

সবার জন্যই খোলা

দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত সারুমা অ্যাভিয়ারি বিডি। সারুমায় পাখি দেখতে এসে কেউ না খেয়ে ফেরত যায়নি। আপ্যায়ন না করে তিনি ছাড়েনই না। হোক না অপরিচিত। স্কুল-কলেজ, মাদরাসার ছাত্র-ছাত্রী, সরকারি কর্মকর্তা, ব্যাংক কর্মকতা, বেসরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা—সব শ্রেণির মানুষ তাঁর অ্যাভিয়ারিতে আসেন।   ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল থেকেও আসে। সময় নিয়ে পাখিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন তিনি। তিনি বললেন, ‘ভিজিটররা মেহমান। আগে একটু ফোন দিয়ে যে কেউ এখানে আসতে পারেন। ’

অন্য শখ

সেলিম একজন সফল ছাদ বাগানি। আপেল, মাল্টা, লেবু, সৌদি খেজুর, টমেটো, শসা, কাঁচা মরিচ—সব আছে তাঁর ছাদে। গাছপালার মধ্যেই পাখিরা ঘুরে বেড়ায়। এ ছাড়া বর্ণালি অ্যাগ্রো নামে তাঁর একটি ফার্ম আছে। সেখানে টার্কি, গাড়ল, ছাগল, গরু, মাছের পুকুর রয়েছে। একসময় ফটোগ্রাফিও করতেন। পুরস্কারও পেয়েছেন। বই পড়তে পছন্দ করেন তিনি। ঘুরেছেন বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ।

বলতে চান না

নারায়ণগঞ্জ শহরেই খাদিজাতুল কোবরা মাদরাসা। মাদরাসায় আবাসিক যারা থাকে তাদের পড়াশোনার সব খরচ দেন সেলিম। প্রতি সপ্তাহে নিজে রান্না করে নিয়ে গিয়েও তাদের খাওয়ান। কখনো কাচ্চি, কখনো বা মোরগ পোলাও। কয়েকটি স্কুলে আর্থিক সহায়তা করেন তিনি। এক দিনের ঘটনা। একটি স্কুলে গিয়ে দেখলেন ওয়াশরুম ভালো নয়। নিজের টাকা দিয়ে ওয়াশরুম সারিয়ে দিলেন। গোপনেই এসব কাজ করে বেড়ান। বললেন, ‘আপনি (লেখক) আমার মেহমান। এটুকুই গুরুত্বপূর্ণ। পত্রিকায় লিখবেন সেটা পরের ব্যাপার। ’

তিনি স্বপ্ন দেখেন

পোষা পাখি পালনে একদিন বাংলাদেশ বিশ্বসেরা হবে। সেলিমের পক্ষীশালা নতুন করে সাজানোর কাজ চলছে। আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যেতে চান তিনি। পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজও চালাচ্ছেন সমানতালে। এমনও স্বপ্ন দেখেন, পোষা পাখিতে দেশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে। বললেন, পোষা পাখিতে প্রচুর বাণিজ্যিক সম্ভাবনা রয়েছে। অনেক ছেলে-মেয়ে পড়াশোনার টাকা পাখি পুষেই জোগাড় করতে পারে।

No comments:

Post a Comment