বাইরের ঝামেলা সেখানেই রাখা, ঘরে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ না করা। কিন্তু অনেক সময় আমরা বাহিরের ঝামেলা-জঞ্জাল বাসায় নিয়ে হাজির হই এবং প্রিয়জনের সাথে শুরু করি দুর্ব্যবহার। অথচ তারা রান্নাবান্না করে ঘর গুছিয়ে আমাদের আসার অপেক্ষায় থাকে। প্রত্যাশা করে একরাশ মুচকি হাসি ও হাস্যোজ্জ্বলতা। কামনা করে একটু আদর-সোহাগ, মমতা ও ভালোবাসা।
আর স্ত্রীরাও বউ-শাশুড়ির ঝগড়া, ভাবি-ননদের দ্বন্দ্বের বাহানায় স্বামীকে অহেতুক বিরক্ত করে, ক্ষেপিয়ে তুলে। তখন আমরা পুরুষিত পদক্ষেপ গ্রহণ করি না। বিচক্ষণতা-বুদ্ধিমত্তার সাথে পরিস্থিতি সামাল দেই না। উল্টো আমরাও ক্ষেপে যাই। লিপ্ত হই স্ত্রীর সাথে বাক-বিতণ্ডায়। স্ত্রীরাও নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে না। ধৈর্য ও সহনশীল হয় না। ফলে যা হওয়ার তাই হয়। স্বামী রাগের মাথায় হুট করেই দিয়ে বসেন তালাক। তাও একটি নয়, তিনটি। বরং হাজারটি।
ফলে নিমিষেই পরিসমাপ্তি ঘটে দীর্ঘদিনের সুখের দাম্পত্য জীবনের। জ্বলে উঠে জীবন সংসারে এক অনির্বাণ অগ্নি, ভস্ম করে দেয় নিজেদের ও সন্তানদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। হাওয়ায় উড়ে যায় গোটা পরিবারের সুখ-শান্তি। তারপর সৃষ্টি হয় আক্ষেপ ও অনুশোচনা। শুরু হয় দৌড়ঝাঁপ। কিন্তু ততক্ষণে আর করার কিছুই থাকে না। আমরা যাতে এরূপ বিড়ম্বনা ও কঠিন পরিস্থিতির শিকার না হই, সেজন্য ইসলাম আমাদেরকে তালাক প্রদানের বিষয়ে দিয়েছে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা। কিন্তু শত আক্ষেপ ও পরিতাপ আমাদের প্রতি, আমরা সে নীতিমালা জানি না। জানার চেষ্টাও করি না। জানলে অনুসরণের প্রয়োজন বোধ করি না। এখনো যদি আমরা সেই নীতিমালা অনুসরণ করি, আমাদের সাংসারিক জীবনে বাস্তবায়ন করি, তাহলে আমাদের সংসার হবে সুখময় ও শান্তিময়। অকারণে ভাঙবে না আর কোনো সংসার। বন্ধ হবে তালাকের দুর্বিষহ যন্ত্রণা।
তালাক প্রদানের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা
আয়াত দুটোতে আল্লাহ তায়ালা স্বামীকে তার চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেয়ার পূর্বে চারটি পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। নির্ভরযোগ্য তাফসির গ্রন্থের আলোকে সেগুলো তুলে ধরা হলো-
প্রথম পদক্ষেপ
নম্র ও কোমল ভাষায় স্ত্রীকে বুঝানো।
অর্থাৎ স্বামীর আনুগত্য করলে স্ত্রী দুনিয়া ও আখরাতে কী প্রতিদান পাবে? অবাধ্যতা করলে তার জন্য কী ভয়াবহ শাস্তি অপেক্ষা করছে? সংসার গঠন, সন্তানদের লালন-পালন ও তাদেরকে সুসন্তান হিসেবে গড়তে পারলে কী বিনিময় পাবে? মহীয়সী নারীগণ কিভাবে তাদের স্বামীদের মনোরঞ্জন করেছেন? তাদের সংসার গুছিয়েছেন? কেমন ছিল তাদের জীবনযাপন? এসব বিষয়গুলো স্বামী স্ত্রীর সামনে ভালোবাসা ও আন্তরিকতার সাথে তুলে ধরবে, কোমল ও নম্র ভাষায় বুঝাবে। তার দিলের ওপর মেহনত করে আনুগত্যের যোগ্যতা তৈরি করবে এবং তার অন্তরে আল্লাহ ও আখেরাতের ভয় সৃষ্টি করবে।
আব্দুল্লাহ ইবনে আবি আউফা রা: মুআয ইবনে জাবাল রা: থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আমি যদি একজন আরেকজনকে সিজদা করার আদেশ দিতাম তাহলে স্ত্রীকে তার স্বামীর সিজদা করার আদেশ দিতাম। সেই স্ত্রী আল্লাহর হক পূর্ণরূপে আদায় করতে পারে না যে তার স্বামীর হক পরিপূর্ণভাবে আদায় করে না। স্ত্রী উটের পিঠে হাওদায় থাকা অবস্থায়ও স্বামী যদি তাকে কাছে পেতে চায়, তাহলে সে তার কাছে যাবে। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৮৫৩) কোনো স্ত্রী তার স্বামীর বিছানা থেকে আলাদা রাত যাপন করলে ভোর পর্যন্ত ফেরেশতারা তার ওপর অভিসম্পাত করতে থাকে। (মুসলিম শরীফ, হাদিস :১৪৩৬)
দ্বিতীয় পদক্ষেপ
বিছানা আলাদা করে দেয়া।
এতে যদি স্ত্রীর বুঝ এসে যায়, সংশোধন হয়ে যায়, তাহলে স্বামী সহনশীল হবে। তিক্ত অতীতের স্মৃতিচারণ করে স্ত্রীকে খোঁটা দেবে না এবং তার ওপর স্বামী হওয়ার অহংকার ফলাবে না। মনে রাখতে হবে, স্বামী যত বড়ই হোক না কেন সেও তো আল্লাহর বান্দা। আল্লাহই মহান, সকল গৌরব-গরিমা তার জন্যই শোভনীয়। তিনি সর্বশক্তিমান এবং তিনি অসহায় ও মজলুমে আশ্রয়স্থল। এই ভদ্রতাজনিত ব্যবস্থায় কাজ না হলে স্বামী তৃতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
তৃতীয় পদক্ষেপ
প্রয়োজন অনুযায়ী কিছু শাসন করা।
আল্লামা মাহমুদ আলুসী বাগদাদী রহ: বলেন, স্ত্রীদের প্রহার করার চেয়ে তাদের রুঢ় আচরণ, অত্যাচার ও মানসিক নির্যাতনের প্রতি ধৈর্য ধারণ করাই উত্তম। তবে আল্লাহর প্রকাশ্য অবাধ্যতা প্রকাশ পেলে ভিন্ন কথা। (তাফসীরে রুহুল মাআনী-৩/২৫) ইসলাম সকল ক্ষেত্রেই বাড়াবাড়ি এবং ছাড়াছাড়ি এই দুই প্রান্তিকতা পরিহার করে ভারসাম্যপূর্ণ পন্থা গ্রহণের আদেশ করেছে।
চতুর্থ পদক্ষেপ
উভয় পক্ষের সালিস ডাকা।
এসব চেষ্টাও যদি ব্যর্থ হয় এবং তার সাথে সংসার করা কোনোভাবেই সম্ভব না হয়, তাহলে স্বামীর জন্য তালাক তথা বিবাহ বিচ্ছেদের পন্থা অবলম্বন করতে আর কোনো বাঁধা নেই। তবে এক্ষেত্রেও ভেবে-চিন্তে, সুস্থির হয়ে শরিয়ত নির্দেশিত পন্থা অবলম্বন করবে। (তাফসীরে রুহুল মাআনী-৩/২৭; তাফসীরে ইবনে কাসীর-২/৩২৯) আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন এবং সে অনুযায়ী আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন
- মুফতি সাদেকুর রহমান
মুফতি ও মুহাদ্দিস- শেখ জনুরুদ্দীন রহ: দারুল কুরআন মাদরাসা
sadekurrahman1989@gmail.com
No comments:
Post a Comment