চাকরির সা‌থে জামদানির ব্যবসায় তান‌জিনা

ঢাকার বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিবেশবিজ্ঞানে পড়াশোনা করেছেন তানজিনা হক। চাকরি করেন বসুন্ধরা গ্রুপের সফটওয়ার কম্পানি চ১-এ বিজনেস অ্যানালিস্ট হিসেবে।
চাকরির পাশাপাশি করছেন জামদানি শা‌ড়ির ব্যবসা। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও যাচ্ছে তাঁর ডিজাইন করা নানা রঙের শাড়ি। স্বপ্ন দেখেন তাঁর জামদানি একদিন হয়ে উঠবে আন্তর্জাতিক কোনো ব্র্যান্ড। তানজিনার উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প শোনাচ্ছেন রাতিব রিয়ান
একবার স্বামী রাসেল মাহমুদের কর্মস্থল রংপুরে গিয়েছিলেন তানজিনা। ঘটনাচক্রে যাওয়া হয় রংপুরের তাঁতিপাড়ায়। কিন্তু ওখানে গিয়ে তাঁর বেশ মন খারাপ হয়ে যায়। কারণ তাঁতিপাড়ার সেই জৌলুস আর নেই। একসময়ের ব্যস্ত তাঁতিদের এখন সময় কাটে বসে বসে! তবু যতটুকু কাজ, মনহরণকারী। জামদানি, কাতান প্রভৃতি দেখে মুগ্ধ হন তানজিনা। নিজের জন্যই শাড়ির বায়না দিলেন। একটা ডিজাইন দেখিয়ে তাঁতিকে বললেন, ‘আমাকে এভাবে শাড়িটা বানিয়ে দেন। ’ সেই শাড়ি পরে ফেসবুকে দিয়েছিলেন নিজের ছবি। এরপর ফেসবুকের মাধ্যমে আসতে থাকে একের পর এক অনুরোধ ‘আপু আমার জন্য একটা’, ‘আমাকে এই শাড়িটা বানিয়ে দাও প্লিজ। ’ অভূতপূর্ব সাড়া। এক শাড়িতেই বুঝি বাজিমাত!
তানজিনা চিন্তা করলেন, ‘বাহ্, চাইলে তো আমি জামদানির ব্যবসাই শুরু করতে পারি!’ এরপর তানজিনার উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প শুরু। তবে শুরুটা এতটা মসৃণ ছিল না। তিনি বলেন, ‘বাণিজ্যিকভাবে শুরু করতে গেলে ক্রেতাদের কাছ থেকে কেমন সাড়া পাব—এটা নিয়ে চিন্তায় থাকতাম। কারণ এখন প্রযুক্তির যুগ। গ্রামীণ তাঁতিরা যেসব শাড়ি বানায় তা হাতে টানা মেশিনের। এটির কদর কেমন সে সম্পর্কে ধারণা ছিল না। তার পরও শুরু করলাম। কিন্তু তাঁতিদের কনভিনস করতে কিছুটা বেগ পেতে হয়েছিল। তাঁতিরাও বলল, ‘এখন এসব শাড়ির বাজার নেই। বাজারে বিভিন্ন কম্পানির শাড়ি আছে। হাতে চলা মেশিনের শাড়ি কিনবে কে?’ তার পরও আশ্বস্ত করলাম তাঁতিদের। চেষ্টা করেই দেখি না। তাঁতিদের কিছু ডিজাইন আমার পছন্দ হলো। এরপর আমিও কিছু ডিজাইনের লেআউট করে দিলাম। তাঁতিরা সে অনুযায়ী সাঁচ বানিয়ে নিল। এরপর আর পিছিয়ে থাকতে হয়নি’, বলেন তানজিনা।
নিজের চাকরি থেকে জমিয়েছিলেন ৫০ হাজার টাকা। শুরুতেই ১০-১২টি শাড়ি দিয়ে ব্যবসাটা শুরু হয়েছিল তাঁর। ফেসবুকে একটি পেজ খুললেন অংশু নামে। সিল্ক কাতান, জামদানি কাতান, কটনের সংগ্রহ তাতে। ‘ক্রেতারাই সেরা’ এমন মূলমন্ত্র নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকলেন তানজিনা। এ কারণে ক্রেতাদের চাহিদা মাথায় রেখেই শাড়ির যাবতীয় ডিজাইন তাঁর। তানজিনা বলেন, ‘ডিজাইনগুলো আমার নিজের আইডিয়া থেকে আসা। ডিজাইন করার সময় উৎসবের চিন্তা মাথায় রাখি। ধরা যাক ঈদের সময় কোন ডিজাইন চলবে, শরতে কোনটি, পহেলা বৈশাখে কোনটি—এসব ডিজাইন মাথায় রেখে সেই অনুযায়ী শাড়ির অর্ডার দিই। এ ছাড়া কালারের বিষয়টি মাথায় রাখতে হয়। আমার যে কালেকশন তাতে লাল, নীল, সবুজের সমারোহ। কারণ বেশির ভাগ ক্রেতার কাছে এই রংগুলো পছন্দের। ’
প্রথম দিনের শাড়ি বিক্রির অম্লান স্মৃতি এখনো গাঁথা তানজিনার মনে। তিনি বলেন, ‘পিনাজ নামে এক আপু ফেসবুকের মাধ্যমে নমুনা দেখে আমার কাছ থেকে শাড়ি নিয়েছিলেন। শাড়ি বাবদ তিনি ৫০ শতাংশ টাকা অগ্রিমও দিয়েছিলেন। প্রথম শাড়িটা বিক্রি করেছিলাম তিন হাজার ৬০০ টাকায়। ’ তানজিনা জানান, সিল্ক কাতান রকমভেদে বিক্রি করেন এক হাজার ৫০০ থেকে ৫০০০ টাকা, জামদানি তিন হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার ৮০০ টাকা, কটন ৮০০ থেকে চার হাজার টাকা। গত দুই বছরে নেট দুনিয়ায় তিনি পাঁচ হাজারের বেশি শাড়ি বিক্রি করেছেন।
ঈদের সময়ও দারুণ ব্যস্ততা যাচ্ছে তানজিনার। বলছিলেন, ‘হাতে বেশ কিছু অর্ডার আছে। এগুলো সময়মতো ডেলিভারি দিতে হবে। কারণ ক্রেতারা ঈদে শাড়ি পরবে এই কারণে ডেলিভারি দেওয়ার তাড়া আছে। তবে সব সময় শাড়ি ডেলিভারি দেওয়াও কিছুটা কষ্টের। কেননা একটা ভালো মানের শাড়ি হাতে টানা মেশিনে নামাতে, শাড়ির ফিনিশিং সব কিছু প্রক্রিয়া সামলে সময় লাগে ছয়-সাত দিন। ’ পণ্যের মানের ব্যাপারে বেশ যত্নশীল তানজিনা। তিনি বলেন, ‘মেশিনে একটা শাড়ি এক দিনেই নামানো সম্ভব, এমনকি একাধিক শাড়িও তৈরি সম্ভব। কিন্তু দেশীয় প্রযুক্তিই আমার পছন্দের। ’ তিনি বলেন, ‘পণ্যের গুণগত মানের ব্যাপারে আমার কোনো আপস নেই। আমি বিশ্বাস করি, আমার সরবরাহ করা পণ্যটি যদি গুণগত মানের হয় তাহলে ওই ক্রেতা আমাকে মনে রাখবে, কিংবা তার পরিচিত কারো মাধ্যমে আমি নতুন ক্রেতা পাব। যেহেতু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যবসা করা হয়, চাইলে সেখানে ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ আছে। ন্যায্য দামের থেকে বেশি দাম নেওয়ার সুযোগও আছে। কিন্তু সৎ থাকতে হবে। কারণ ক্রেতা ঠকিয়ে অর্থ উপার্জন করা গেলেও সুনাম কিন্তু আসবে না। ’
শুধু কি ব্যবসা, যিনি ব্যবসা করবেন তাঁর কী গুণ থাকতে হবে? এমন প্রশ্নের উত্তরে এই উদ্যোক্তা বলেন, ‘অবশ্যই নিজেকে আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। চিন্তায় সৎ থাকতে হবে। ক্রেতার কাছে বিশ্বস্ত হতে হবে। কারণ ক্রেতা পূজনীয়। ক্রেতা যদি সন্তুষ্ট না থাকে, তবে সেই ব্যবসা বেশি দূর এগোনো সম্ভব না। ’
শুধু শাড়ি নয়, বুটিকের কালেকশনও আছে তানজিনার। বুটিকগুলোর ডিজাইনও নিজেই করেন। সেই অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘নিজেই বুটিকের কাজ শুরু করলাম। দেখলাম মানুষ মূল্যায়ন করছে। অনেকেই সাড়া দিচ্ছে। ’ কারা ক্রেতা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বেশির ভাগ ঢাকার বাসিন্দা। এ ছাড়া ঢাকার বাইরের জেলা থেকেও ক্রেতারা তাঁর শাড়ি নিয়ে যায়। ’ শুধুই কি দেশের সীমানা, দেশের বাইরে অন্য কোথাও তাঁর শাড়ি যাচ্ছে কি না? তানজিনা বলেন, ‘পাঁচ-ছয়টি দেশে তাঁর শাড়ি যাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ভারত, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া। তাদের বেশির ভাগই প্রবাসী ক্রেতা। হয়তো কোনো আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে তারা তথ্য জেনে এসব অর্ডার দেয়। ’
তবে বিদেশে শাড়ি পাঠানো বেশ সময়সাপেক্ষ ও হয়রানিমূলক বলে জানালেন তিনি। বলেন, ‘নির্দিষ্ট সময় ডেলিভারি পাঠানো যায় না। একাধিকবার চেকিং করা হয়। কী পাঠাচ্ছি তা জায়গায় জায়গায় দেখা হয়। এরপর কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত হয়ে ছাড়ে। ’ পোস্ট অফিস ও এয়ার মেইলের মাধ্যমে এসব পাঠানো হয় বলে তানজিনা উল্লেখ করেন। সে ক্ষেত্রে পাঠানোর খরচটা একটু বেশি।
উপার্জন সম্পর্কে তানজিনা বলেন, ‘খণ্ডকালীন সময় দিলে প্রতি মাসে অন্তত ৩০ হাজার টাকা উপার্জন করা সম্ভব। আর কেউ যদি পূর্ণ সময় দেন তাহলে তার উপার্জন মাসে ৫০ হাজার টাকার বেশি হবে। ’ যাঁরা উদ্যোক্তা হতে চান তাঁদের প্রতি তানজিনার পরামর্শ—‘কেউ একটা কাজ করে সফল হলো অন্য কেউ যে সেই একই কাজ করে সফল হবে তার নিশ্চয়তা নেই। যা কিছুই শুরু করুন না কেন, নিজস্ব চিন্তা থাকতে হবে; ক্রেতাদের মানসিকতা বুঝতে হবে। তার জন্য প্রচুর স্টাডি দরকার। আর সবার আগে বুঝতে হবে, আমি কী করতে পারব। নিজের অবস্থানটা পরিষ্কার থাকতে হবে। যা করতে পারব সেটাতেই লেগে থাকতে হবে। ’
কথার ফাঁকে তানজিনা জানালেন তাঁর স্বপ্নের কথা। ফেসবুক দুনিয়ার পাশাপাশি ঢাকার কোথাও একটা শোরুম দিতে চান তিনি।
এ ছাড়া তাঁর অন্য একটা পরিকল্পনাও রয়েছে—বিশ্বজনীন কিছু করা। জামদানি, কাতান আমাদের দেশীয় ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যকে সারা বিশ্বে পরিচিত করাতে চান তিনি। তানজিনা চান আমাদের দেশীয় এই পণ্য একদিন হয়ে উঠুক বিশ্বখ্যাত কোনো ব্র্যান্ড। সেই লক্ষ্যে তাঁর অবিরাম শ্রম। অবিরাম শ্রমের প্রেরণা পেয়েছেন মা নীলুফা বেগমের কাছ থেকে। মা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কিন্ডারগার্টেন স্কুল চালাতেন। মাকে কখনো বসে থাকতে দেখেননি। অফিসের কাজের পাশাপাশি মা ব্যস্ত থাকেন নিজের কাজ নিয়ে। মায়ের কাছ থেকেই পরিশ্রমের দীক্ষা নিয়ে তানজিনা পা রাখতে চান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।

No comments:

Post a Comment