ঈদে ভাড়া বে‌শি নি‌লে অভিযোগ করবেন কোথায়?

প্রতিবছরই দুই ঈদে অনিয়মকে নিয়ম মেনেই বাড়তি ভাড়া আদায় করে বাস মালিকরা। কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, ‘ঈদে ঘরমুখো মানুষের কাছে বাড়তি ভাড়া আদায় করা যাবে না, বাড়তি ভাড়া আদায় অবৈধ।
প্রমাণ হলে শাস্তি হবে। ’ তবু কর্তাব্যক্তিদের এসব হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করেই চলে বাড়তি ভাড়া আদায়ের মহা উৎসব! যুক্তি—‘ঈদের সময় বাস ঢাকায় ফিরতিকালে যাত্রী পায় না, তাই একটু বেশি নেয়!’ অন্যদিকে বাড়তি ভাড়া আদায়ের শাস্তির জন্য আইন আছে; কিন্তু শাস্তি কী বা অভিযোগ কোথায় জানাতে হবে তা জানা নেই বেশির ভাগ যাত্রীরই। এই যখন পরিস্থিতি, তখন রাজধানী ঢাকায় বসবাসরত প্রায় পৌনে দুই কোটি মানুয়ের সঙ্গে প্রতিদিন নতুন করে যুক্ত হচ্ছে এক হাজার ৪০০ নতুন মুখ। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে রাজধানীতে আসা এই মানুষগুলো পুরো বছর শিকড়ের টানে গ্রামে যেতে না পারলেও বছরের দুটি ঈদে ফেরার চেষ্টা করে। শুধু ঈদ এলেই ছুটে চলা এই মানুষগুলোর যাতায়াতের গুরুত্বপূর্ণ বড় একটি মাধ্যম হয় দূরপাল্লার বাস। কিন্তু বাড়তি আনন্দ নিয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলেও প্রথমেই গুনতে হয় বাড়তি ভাড়া। বিআরটিএর দেওয়া ভাড়ার তালিকা সে সময় হয়ে যায় দুই অথবা তিনের ঘরের নামতার মতো।

বিআরটিএর দেওয়া তথ্য মতে, মে ২০১৬-র সর্বশেষ নির্ধারিত ভাড়া অনুযায়ী কিলোমিটারপ্রতি ১.৪২ টাকা হারে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। বিভাগীয় শহর, রাজধানীসহ ৩৭৬টি রোডে দূরপাল্লার বাসের ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে বিআরটিএ। অথচ ব্যতিক্রম ছাড়া ঈদের সময় বিআরটিএর নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে ১০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া নেওয়া হয়। বিগত কয়েক বছরের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এনে এবারের ঈদে ভাড়া বাড়ার আগেই গাবতলী, মহাখালী, সায়েদাবাদ, গুলিস্তান বাস টার্মিনালগুলোতে ঘুরে আসন্ন ঈদে এই পরিস্থিতিতে সাধারণ একজন যাত্রী আইনগত কী সুবিধা পেতে পারে এবং বাড়তি ভাড়া আদায়ের কোনো বৈধতা আছে কি না, সে বিষয়ে অনুসন্ধান করে কালের কণ্ঠ। এ সময় নির্ধারিত ভাড়া থেকে যেকোনো সময় বাড়তি আদায় করাটাই অপরাধ বলে জানায় বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ। তবে অনেক চেষ্টা করেও জানা গেল না কী শাস্তি হতে পারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআরটিএর এক কর্মকর্তা জানালেন, ‘বাড়তি ভাড়া আদায় অবশ্যই একটি বড় সমস্যা। মূল সমস্যার কথা কেউ বলে না। তাই এর কোনো সমাধানও সম্ভব নয়। এই বাড়তি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ ও নির্ধারণ আসলে সরকারেরই একটি শক্তি নির্ধারণ করে। তাই এর সমাধানও অনেকটা কঠিন!’ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মাত্র কয়েক হাজার বাস ব্যবসায়ীর অর্থ আর ক্ষমতার কাছে কিভাবে ১৬ কোটি সাধারণ মানুষ নতি স্বীকার করে ভোগান্তি মেনে নেবে?

গাবতলী টার্মিনালে গিয়ে দেখা গেল, কয়েকজন যাত্রী চুয়াডাঙ্গা যাওয়ার জন্য পূর্বাশা বাসের জন্য অপেক্ষা করছেন। কথা বলার চেষ্টা করতেই তাঁরা এগিয়ে এলেন এবং জানালেন, একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন তাঁরা। একজন বললেন, ‘যেতাম আরো পরে, কিন্তু ওই সময় বাড়তি ভাড়ার সঙ্গে যুক্ত হয় অসহনীয় যানজট, যা কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল। ’ মহাখালী বাস টার্মিনালে গিয়ে কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে কথা বললে জানালেন, ‘বাড়তি ভাড়া নেওয়া এ আর নতুন কী। প্রতিবছরই এমনটা ঘটে। পুরো বছর ভাড়া এক আর ঈদের সময় ভিন্ন।’
কাউন্টারগুলোতে গেলে কথা বলতে নারাজ অনেকেই। দু-একজন বললেন, যানজটের কারণে একবার ট্রিপ নিয়ে যেতেই কষ্ট হয়, আবার আসার সময় আসি খালি। যাত্রী পাওয়া যায় না। আসার সময়ের তেল খরচের টাকা কে দেবে! ভাড়া বাড়লেও কিছু করার নেই। আমাদের তো পোষাতে হবে!’ এ প্রসঙ্গে রাজশাহীগামী এক যাত্রীর সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, ‘তাহলে কি যানজট আর নানা সমস্যার দায় আমাদের মতো সাধারণ যাত্রীদেরই নিতে হবে? বাস মালিকরাও তো সারা বছর কোনো রকম বাধা ছাড়া ব্যবসা করে যাচ্ছে। তারা কেন দায় নেবে না?’
গোপলগঞ্জ যাবেন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তাহেরুল ইসলাম বাপ্পি, কথা হলো গুলিস্তান বিআরটিসি টার্মিনালে—বললেন, ‘ভাই, এসেছিলাম ঈদের অগ্রিম টিকিটের জন্য, এসে জানলাম ১৫ রমজানের পর নাকি টিকিট ছাড়বে! প্রতিবছর ৩০০ টাকার টিকিট ৫০০ বা তারও বেশি টাকা দিয়ে কিনতে হয়, এবার নাকি আরো বেশি হবে টিকিটের দাম! নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে এত বেশি ভাড়া নেওয়ার যৌক্তিকতা খুঁজে পাই নারে ভাই।

’টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেসের রাব্বি নামের এক কন্ডাক্টর বলেন, ‘ঢাকা থেকে ৪৫০ টাকার ভাড়া হবে ৬০০ টাকা আর এসি বাসে সব সময়ের ভাড়া ৫৫০ টাকা হলেও ঈদে এটা বেড়ে হতে পারে ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা। ’
ঈদে বাড়তি ভাড়া আদায়ের বৈধতার বিষয়ে বিআরটিএ সদর কার্যালয়ের পরিচালক (ইঞ্জি.) মো. নূরুল ইসলাম বলেন, ‘ভাড়ার বিষয়টি আমরাই নির্ধারণ করে থাকি। ঈদে বা অন্য যেকোনো সময় বাড়তি ভাড়া আদায়ের কোনো বৈধতা বিআরটিএ দেয় না। নির্ধারিত ভাড়ার বেশি আদায় করলে ভ্রাম্যমাণ আদালত ব্যবস্থা নেবেন, সেই সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তো আছেনই। এ ধরনের সমস্যার ব্যাপারে কেউ অভিযোগ করতে চাইলে আমাদের ওয়েবসাইটে (www.brta.gov.bd) গিয়ে অভিযোগের জন্য একটি ফরম পূরণ করতে হবে। তারপর কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবে।
’শাস্তি কী হতে পারে—এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমাদের মুখপাত্র পরিচালক রোড সেফটি বলতে পারেন। ’ বিষয়টি জানতে রোড সেফটির পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রাব্বানীর সঙ্গে কথা বলার জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।

একজন যাত্রী হিসেবে এ ধরনের ভোগান্তিতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর থেকে কী সুবিধা পাওয়া যেতে পারে? এ বিষয়ে কথা বললে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মঞ্জুর মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, ‘বাড়তি ভাড়া আদায়ের বিষয়ে যদি কোনো যাত্রী ওই বাসের ড্রাইভার, কন্ডাক্টর বা মালিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা দেয়, আমরা দুই পক্ষকে ডেকে বিষয়টি জানব। তারপর প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর কেন্দ্র।’
জানা যায়, অপরাধের ধরন অনুযায়ী শাস্তি হতে পারে এক বছর থেকে তিন বছরের জেল এবং ৫০ হাজার থেকে অনধিক দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করতে পারে। আদায়কৃত জরিমানার ২০ শতাংশ দেওয়া হবে অভিযোগকারীকে।
অভিযোগ করতে হবে অবশ্যই লিখিতভাবে, ফ্যাক্স, ই-মেইল (nccc@dncrp.gov.bd), ওয়েবসাইট (http://dncrp.portal.gov.bd/) এবং অফিস চলাকালে সরাসরি মোবাইলে ০১৭৭৭৭৫৩৬৬৮ নম্বরে।
এছাড়া সরাসরি কারওয়ান বাজার জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অফিসে অভিযোগ করা যাবে। অভিযোগের জন্য অভিযোগ ফরম সংগ্রহ করে পূরণের সঙ্গে অবশ্যই বাড়তি ভাড়া আদায়ের টিকিট অথবা প্রমাণ পেশ করতে হবে।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯-এর ধারা ৬০ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তিকে কারণ উদ্ভব হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে এ আইনের অধীনে অভিযোগ দায়ের করতে হবে; অন্যথায় ওই অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হবে না।

No comments:

Post a Comment