যিশুর পুনরুত্থান নবজীবনের আহ্বান

ইস্টার সানডে
আজ ২১ এপ্রিল রোববার। সারা পৃথিবীতে খ্রিষ্টবিশ্বাসীরা আজ মহাসমারোহে পালন করছে মৃত্যুঞ্জয়ী প্রভু যিশুর গৌরবময় পুনরুত্থান মহোৎসব পাস্কা বা ইস্টার। সবাই উচ্চ কণ্ঠে গেয়ে উঠছে: আল্লেলুইয়া অর্থাৎ জয়, মৃত্যুঞ্জয়ী প্রভুর জয়। ১৯ এপ্রিল ছিল গুড ফ্রাইডে বা পুণ্য শুক্রবার; স্মরণ করা হয়েছে মানব মুক্তিদায়ী যিশুর ক্রুশ-মৃত্যু। মানুষ কৃচ্ছ্রসাধন করে, উপবাস বা রোজা রেখে নিজ পাপের জন্য অনুতপ্ত হয়েছে; নিজ পাপ স্বীকার করে, ঈশ্বর ও মানুষের সঙ্গে হয়েছে পুনর্মিলিত। আজ আনন্দের সঙ্গে স্মরণ করা হচ্ছে, পালন করা হচ্ছে প্রভু যিশুর গৌরবময় পুনরুত্থান, পাস্কা বা ইস্টার।


পুনরুত্থান রোববার বা পাস্কা রোববার
হিব্রু শব্দ পাস্কা মানেই হলো পেরিয়ে যাওয়া বা পার হয়ে যাওয়া, ডিঙিয়ে যাওয়া। যিশুর পুনরুত্থান মানবজাতির পাপের ওপর বিজয় এনেছে। মানুষকে পাপ থেকে মুক্ত করেছে। এই অর্থেই আজকের এই মহোৎসবের নাম পাস্কা। যিশুর পুনরুত্থানে মানুষের জীবনে উষার আলোর উদয় হয়েছে। তাই এই পর্বের নাম ইস্টার।

উৎসব উদ্‌যাপন শুরু
বস্তুত শনিবার রাত থেকেই এই নবজীবনের মহোৎসব শুরু হয়। সে রাতেই, আসলে দিবাগত রাতে, রোববারের ভোররাতে উপাসনায় যিশুর পুনরুত্থান ঘোষণা করা হয় এবং সবাই মেতে ওঠে পুনরুত্থানের আনন্দে। জ্বালানো হয় পুনরুত্থানের প্রদীপ, এক বিরাট আকারের মোমবাতি, যা ঘোষণা করে যে যিশুর পুনরুত্থান দূরীভূত করেছে পাপের অন্ধকার; যিশুর পুনরুত্থান মানুষের জীবনে এনেছে নতুন আলো, নতুন জীবন। আজকের এই মহোৎসব নবজীবনের মহোৎসব। এই উৎসব আমাদের সবাইকে নতুন জীবনে আহ্বান করে; যিশুর সঙ্গে পুনরুত্থিত হয়ে সবাইকে ‘পুনরুত্থিত’ মানুষে পরিণত হতে আহ্বান জানায়।

পুনরুত্থিত আলোকিত জীবন
পুনরুত্থিত বা আলোকিত জীবনের দর্শনীয় বৈশিষ্ট্যগুলো কী কী হতে পারে? যে জীবনে মিলন ও ভ্রাতৃত্ব, শান্তি-সম্প্রীতি, যেখানে নেই কোনো ঝগড়া-বিবাদ; বরং আছে ক্ষমা, যেখানে আছে সরলতা ও স্বচ্ছতা, যেখানে নেই মূল্যবোধের অবক্ষয়; যেখানে আছে আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি, সেখানেই তো নবজীবন, পুনরুত্থিত জীবন। অপ্রিয় হলেও সত্য যে আমাদের দেশে বর্তমান বাস্তবতাগুলোর সামনে আলোকিত মানুষ হওয়া একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বিষাদময় এই বাস্তবতাগুলোর সামনে এবারের ইস্টার বা পুনরুত্থানপর্ব বাংলার সব পর্যায়ের মানুষকে আলোকিত, পুনরুত্থিত মানুষ হওয়ার আহ্বান জানায়।

ইস্টার ও আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি
বাংলাদেশের মানুষ ঐতিহ্যগতভাবেই শান্ত মানুষ; উগ্রতা তার ধর্ম নয়, তা মানায় না। ঐতিহ্যগতভাবেই আমাদের দেশের মানুষ মিলনের কৃষ্টির মানুষ; হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মানুষ একত্রে বাস করে আসছে যুগ যুগ ধরেই। বাংলার মানুষের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে যান বিদেশি বন্ধুরা। অতএব আমাদের শক্তি আছে এই মূল্যবোধগুলো নিয়ে বর্তমান নৈরাশ্যজনক সব বাস্তবতার সম্মুখীন হওয়ার, ধ্বংসাত্মক এসব পাপকে নৈতিক মূল্যবোধ দ্বারা জয় করে ব্যক্তিক ও সামগ্রিকভাবে পুনরুত্থিত মানুষে পরিণত হওয়ার। আর এ প্রসঙ্গে যিশুর পুনরুত্থান আমাদের প্রত্যেকের জন্য পাপকে পরাজিত করার একটি বড় চেতনা ও প্রেরণা।

ইস্টার ও বাংলা নববর্ষ
অত্যন্ত মজার দিকটা হলো, মাত্র এক সপ্তাহ আগেই ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষ পয়লা বৈশাখ ঘটা করে পালন করেছি। নববর্ষ তো নতুন জীবনই ঘোষণা করে। নতুনকে বছরকে স্বাগত জানিয়ে সেদিন গেয়ে উঠেছি, ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’; নতুনের আমেজ নিয়ে, বাণী নিয়ে তুমি এসো। প্রাসঙ্গিকভাবে আমরা এই পুনরুত্থান উৎসবেও প্রত্যাশিত সেই নতুন জীবনকে স্বাগত জানাই। আমাদের জীবন ঘোষণা করুক যে আমরা কথায়, কাজে, আচরণে, সম্পর্কে ধর্মীয়, সামাজিক এমনকি রাজনৈতিক অঙ্গনে হয়েছি নতুন।
সর্বজনীন আনন্দ-উৎসব
আজ নতুন সাজে ছোট–বড় সবাই পুনরুত্থানের খ্রিষ্টযাগে, তথা উপাসনায় অংশগ্রহণ করে। গির্জাঘর থাকে খ্রিষ্টভক্ত দিয়ে পূর্ণ। চিরকুমার যাজকের (ফাদার) পরিচালনায় আড়ম্বরপূর্ণ খ্রিষ্টযাগ বা নামাজ বা পূজা-উপাসনার পরেই চলে আপন আপন কৃষ্টিতে ইস্টারের শুভেচ্ছা বিনিময়। ঘরে ঘরে আজ আয়োজন করা হয় দই, চিড়া, মুড়ি-মুড়কির মতো হরেক রকম মুখরোচক আহারসামগ্রী। এতে অংশগ্রহণ করবে ঘরের সবাই ও পাড়া–প্রতিবেশী। এই আসরে অনেক সময়ই নিমন্ত্রিত হয় হিন্দু, মুসলমান ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ভাইবোনেরাও। ইস্টার মহোৎসব খ্রিষ্টানদের, কিন্তু উৎসব ও উৎসবের আনন্দ সবার।

সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি জোর আবেদন, এই দিনে ছুটি না থাকায় আক্ষেপ থাকে বরাবর। বিভিন্ন গণমাধ্যমের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত করা হয়েছিল এই আক্ষেপ। ইস্টার, তথা যিশুর পুনরুত্থান-রহস্য খ্রিষ্টধর্মের একটি প্রধান ধর্মীয় বিষয়, ধর্মীয় অনুষ্ঠান। খ্রিষ্টীয় বিশ্বাসের ভিত্তিই হলো যিশুর এই পুনরুত্থান। অন্যান্য ধর্মের যেমন রয়েছে প্রধান প্রধান ধর্মীয় উত্সব, তথা পূজা বা ঈদ, খ্রিষ্টানদের জন্য ইস্টার বা যিশুর পুনরুত্থান তেমনিই একটি মুখ্য খ্রিষ্টীয় ধর্মীয় মহোত্সব। এই দিনকে ঐচ্ছিক নয়, বরং সাধারণ ছুটি বা পাবলিক হলিডে হিসেবে অনুমোদন দিলে পুনরুত্থান রোববারে মুক্ত মন নিয়ে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ছাত্রছাত্রীরা গির্জায় যেতে পারবে এবং পারিবারিক, সামাজিক, কৃষ্টিগত ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারবে; সর্বোপরি সর্বজনীনভাবে খ্রিষ্টবিশ্বাসের কেন্দ্রীয় রহস্যভিত্তিক এই মহোৎসব সবার কাছেই সর্বাধিক গুরুত্ব পাবে, পরিচিত হবে।

পুনরুত্থিত যিশুর শান্তি-আশীর্বাদ ও আনন্দ সবার ঘরে ঘরে বিরাজ করুক। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সবার প্রতি রইল শুভ ইস্টার পর্বের প্রীতিপূর্ণ শুভেচ্ছা।

শুভ পাস্কা, শুভ পুনরুত্থান, হ্যাপি ইস্টার! উচ্চ রবে ঘোষণা করি, খ্রিষ্ট সত্যই পুনরুত্থান করেছেন, আল্লেলুইয়া, আল্লেলুইয়া! জয়! জয়! পুনরুত্থিত খ্রিষ্টের জয়!


ফাদার প্যাট্রিক গমেজ: ক্যাথলিক ধর্মযাজক, সাধুজন মেরি ভিয়ান্নি ক্যাথলিক মিশন, মুণ্ডুমালা, তানোর, রাজশাহী এবং আহ্বায়ক, খ্রিষ্টীয় ঐক্য ও আন্তধর্মীয় সংলাপ কমিশন, রাজশাহী ক্যাথলিক ধর্মপ্রদেশ।

No comments:

Post a Comment