প্রকৃতির সমস্ত প্রাণিকুলের মধ্যে মানুষকেই শুধু সবকিছু বুদ্ধি-বিবেচনা দিয়ে নির্ণয় করতে হয়। অন্য প্রাণীদের ক্ষেত্রে বেঁচে থাকার কিছু স্বাভাবিক দিকনির্দেশনা থাকে এবং সেই নির্দেশনা মেনে তারা টিকে থাকে। কিন্তু মানুষের পক্ষে না কাউকে সহজে চেনা সম্ভব, না জানা। তার জীবন চলার পথে কোনো নির্দিষ্ট নির্দেশনা কোথাও দেওয়া নেই। তাই তো মানুষ একসময় তার খুব কাছের মানুষটাকেও চিনতে ভুল করে।
যে একসময় ছিল তোমার প্রেমিক, পরবর্তীকালে স্বামী। একসময়ে এটা ভেবে তুমি অবাক হও, এই মানুষটাই একদিন তোমাকে বলেছিল, ‘তুমি সেই, যাকে পেয়ে আমি জানলাম কী সুতীব্রভাবে ভালোবাসা যায়।’ তার বাক চাতুর্যে তুমি কতই না সম্মোহিত হয়েছ। অথচ আজ তুমি উপলব্ধি করছ, তুমি উৎপাদনক্ষম একটা পণ্য ছাড়া আর কিছুই না। দাম্পত্য সম্পর্ক শুধু এক সেক্সুয়াল রিলেশনশিপ। এখানে তোমাকে শারীরিকভাবে, বিশেষ করে অঙ্কশায়িনী হিসেবে উপযুক্ত অতঃপর প্রোডাক্টিভ হতে হবে। তোমার ঘরের টিভি, ফ্রিজ, ওভেন, এসি, ওয়াশিং মেশিনটার মতোই তোমার অবস্থান ছিল তার জীবনে। তোমার একাডেমিক ক্যারিয়ার, তোমার মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির চাকরি, তোমার দেহগত সৌন্দর্য, মুখাবয়বের লাবণ্য সবকিছু নিয়ে কত গদগদ ভাব ছিল তার। তার বন্ধু ও পরিচিত মহলে যখন তোমার প্রসঙ্গ উঠত তখন তার চোখে-মুখে ফুটে উঠত গর্বের দ্যুতি, লেপ্টে থাকত অহংকারও। তুমি তখন সব ভুলেছিলে। তুমি জানতেই না যে তুমি একটা প্রোডাক্ট। তোমার ডেপ্রিসিয়েশন তার এই গর্বের ওপরে মরিচা হয়ে উঠবে। তোমার বিস্ময়ের সীমা থাকল না সেইদিন, যেদিন তোমাকে ছেড়ে সে চলে গেল। এ রকম একটা ক্ষতির বা খুঁতের কারণে তোমার প্রতি তার এত দিনের মোহে যে ছেদ পড়তে পারে তুমি ভাবো নাই কখনো, ভালোবাসা এখন তোমার কাছে শুধুই এক পিটুইটারি গ্রন্থির ক্ষরণমাত্র।
তুমি ব্রেস্ট ক্যানসার সারভাইভার। তুমি তখনো কোনো সন্তানের জন্ম দাওনি। তবে তোমার ক্যানসার সন্তান জন্মদানের জন্য বাধা ছিল না। তবে চিকিৎসাজনিত কারণে সময় নিতে হচ্ছিল। অবশেষে ডাক্তার যখন তোমাকে সন্তান জন্মদানের জন্য উপযুক্ত ঘোষণা করল, তত দিনে সে কেটে পড়েছে। একস্তনী স্ত্রী দিয়ে তার মতো উচ্চপদস্ত ব্যক্তির ঘর করা চলে না!
নারী, তোমার স্তন আসলে কী জন্য প্রয়োজন? তুমি সঙ্গমে মন্থনেও তা উপলব্ধি করতে পারো নাই। স্তন শুধুই কি বাহ্যিক সৌন্দর্যের আকর! কামুক পুরুষের জুলজুলে চোখে তাকিয়ে থাকার বা বর্ণচোরা পুরুষের আড়চোখে দেখার বস্তু তো ওটা নয়। ও শুধু তোমার সন্তানের অমীয় সুধা দানের জন্যই ঈশ্বর প্রদত্ত ভাণ্ডার। অথচ পণ্য হিসেবে ওই অঙ্গের গুরুত্বই সবচেয়ে বেশি। ওখানে তেল চর্বির ঘাটতি থাকলে তাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোমরাই তো দর্শনযোগ্য করে তোলো। তুমি নারী তুমিও তো এই পুরুষতান্ত্রিক চোখকে উপেক্ষা করতে পার না। আর এখন তুমি বিস্মিত হচ্ছো ওই অঙ্গের গুরুত্ব ব্যক্তি তোমার চেয়েও বেশি দেখে!
শুধু ওই অঙ্গ নয়, তোমার উৎপাদন ক্ষমতার সঙ্গে সম্পৃক্ত অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, যা ঈশ্বর ষড়যন্ত্র করে শুধু তোমাকেই দিয়েছেন, সেই জরায়ু! তুমি যখন বিবাহিতা তখন তোমার সেই জরায়ুর ওপরেও তোমার নিজস্ব কোনো অধিকার নেই। ওর সুস্থতা ও অসুস্থতার ওপর তোমার সঙ্গীর যে মানসিক পরিবর্তন, সেখানে তোমার কোনো ইচ্ছা অনিচ্ছা খাটে না। সন্তানের জন্ম দিতে চাচ্ছো না হয়তো তোমরা দুজনেই, অথচ তাকে বাধা প্রয়োগের সব রকম কলাকৌশল তোমাকে গ্রহণ করতে হবে। কারণ এখানে যন্ত্রটা যে তুমি নিজে। তুমিই যে উৎপাদনের নিয়ামক। আর ওইসব নিরোধক ব্যবহারে তোমার যে ক্ষতি শারীরিক ও মানসিক সেও মেনে নিতে হবে তোমাকে। জরায়ুমুখের ক্যানসারে যখন তুমি কাতর, যখন তোমার দুটো ওভারিই কেটে ফেলার আশঙ্কা প্রকাশ করেন ডাক্তার, তখনো তোমার হৃদয়হীন স্বামী ডাক্তারকে বলবে, না কেটে পারা যায় না!’ যৌন সুখ কে দেবে তাকে! ওভারিয়ান টিউমারের কারণে রক্তশূন্যতায় ভোগা স্ত্রীর স্বামী যে কি না তিন সন্তানের জনক তাকে তুমি বলতে শোনো, ‘অপারেশন না করে পারা যায় না!’
তুমি নারী, তুমি সংসারে শুধুই এক পণ্য। তুমি পণ্য হতে চাও বা না চাও ঈশ্বর তোমাকে এই ষড়যন্ত্রের ফাঁদে ফেলে রেখেছেন। নারী তুমি শুধু সুন্দরী প্রতিযোগিতার মঞ্চে না, এই পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চেও এক পণ্য।
এই পণ্য হয়ে ওঠার দায় কি কিছুটা তুমি নিজেও বহন কর না? তাই বলছি শোনো, আজ বের হয়ে আসো তোমার যাবতীয় পণ্য হয়ে ওঠার বাসনা থেকে। প্রসাধনহীন তোমাকে দেখে অভ্যস্ত হোক চোখ। তোমার মনুষ্যত্ব পূর্ণতা পাক। সৌন্দর্য না, তুমি হয়ে ওঠো স্বাস্থ্য সচেতন।
গাজী তানজিয়া, ঔপন্যাসিক
No comments:
Post a Comment