যদি নবজাতক অন্তত ৩৭ সপ্তাহের আগেই জন্মলাভ করে, যদি তার ওজন আড়াই কেজির কম হয়, তাহলে জরুরি ব্যবস্থা নিতে হবে। জন্মের একেবারে প্রথম ঘণ্টার মধ্যেই। তখন তার জীবন-মরণ সমস্যা। যা করার সেই স্বল্প সময়ের মধ্যেই করতে হবে। সে জন্যই একে বলা হয় গোল্ডেন আওয়ার।
সম্প্রতি প্রথম আলো গোলটেবিল বৈঠকে সময়ের আগে জন্ম নেওয়া এবং বিশেষভাবে কম জন্ম-ওজনের নবজাতকদের জন্য জরুরি করণীয় বিষয়ে আলোচনা হয়। সহযোগিতায় ছিল ইউনিসেফ। আলোচনায় বাংলাদেশ নিওনেটাল ফোরামের সভাপতি তাহমিনা বেগম সাধারণ একটি কথা চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, জন্মের আগে শিশু মায়ের পেটে একটি নিরাপদ পরিবেশে বড় হয়। তার খাওয়াদাওয়ার সমস্যা থাকে না। আরামদায়ক থাকার পরিবেশ। নেই কোনো ঝুটঝামেলা। কিন্তু জন্মলাভের পরই সে এক অচেনা পরিবেশে অস্বস্তির মধ্যে পড়ে। চারদিকে শব্দ। বাতাস ভারী। অক্সিজেন কম। মায়ের পেটের স্নেহময় পরিবেশটা যেন কোথায় চলে গেল। একেবারে স্বর্গ থেকে পতন আরকি!
নবজাতকের জন্য এই অবস্থাটা আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় সে মায়ের বুকের দুধ পাচ্ছে না। কেন? কারণ হয়তো এটাও হতে পারে যে তাকে ঠিক অবস্থানে কোলে নিয়ে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়নি। অন্য সমস্যাও থাকতে পারে। তবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মিডওয়াইফ মাকে ঠিকভাবে বুঝিয়ে দিতে পারেন বাচ্চাকে কীভাবে কোলে নিয়ে বসতে হবে। এই বসার ভঙ্গিটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটু এদিক-ওদিক হলে নবজাতক দুধ পাবে না। অথচ প্রথম থেকেই মায়ের দুধ খাওয়া তার সুস্থ–সবল হয়ে বেড়ে ওঠার জন্য খুব দরকার। আমরা অনেকে খেয়াল করি না যে প্রথম ছয় মাস শিশু শুধু মায়ের বুকের দুধ খাবে। এর বাইরে অন্য কিছু তো নয়ই, এমনকি পানি পর্যন্ত না। এর বহুমুখী উপকার। অসুখ-বিসুখ প্রায় হয়ই না। রোগ প্রতিরোধক্ষমতাও অনেক বেশি থাকে। এই ছয় মাস মায়ের খাবারের প্রতি খুব বেশি যত্ন নিতে হবে। কারণ, মায়ের খাদ্যমান ও পুষ্টিই তো শিশুর একমাত্র খাবার।
সময়ের আগে জন্ম নেওয়া নবজাতকদের ওজন খুব কম হলে শ্বাসকষ্ট হতে পারে। কানে কম শুনতে পারে। এমনকি শব্দপ্রতিবন্ধীও হতে পারে। তাহলে সে বাক্প্রতিবন্ধীও হবে। কারও চোখের দৃষ্টির সমস্যা থাকতে পারে। সে অটিস্টিক হতে পারে। গোলটেবিল বৈঠকে বিশেষজ্ঞ আলোচকেরা বেশ গুরুত্ব দিয়ে এই সমস্যাগুলো ও প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁরা বলেন, সময়ের আগে জন্ম নেওয়া এবং কম ওজনের নবজাতকদের চোখ-কান পরীক্ষা করানো দরকার। সময়োচিত চিকিৎসায় সুফল পাওয়া যায়। মোট কথা কম জন্ম-ওজনের শিশুদের প্রতি বিশেষ যত্ন দরকার।
যে নবজাতকেরা ৩৭ সপ্তাহের দু-চার দিন আগে জন্মলাভ করেছে কিন্তু ওজন আড়াই কেজি বা তার বেশি, তাদেরও কিছু সমস্যা থাকতে পারে। যেমন: চোখ দিয়ে পানি পড়া, ঘুমের পর চোখের কোনায় ময়লা জমা, খাওয়ার পর কিছু দুধ মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসা ইত্যাদি। শিশু বিশেষজ্ঞেরা বলেন, সময়ের সামান্য আগে জন্মলাভের জন্য তাদের নেত্রনালি পুরোপুরি বিকশিত হয়নি, খাবার কতটা খেতে হবে, সেটা বুঝতে পারে না। ফলে এসব উপসর্গ দেখা দিতে পারে। এ জন্য সাধারণত ওষুধের দরকার নেই। চোখের কোনায় দিনে তিনবার হালকা ম্যাসাজ করলে কিছুদিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে যায়। খাওয়ার সমস্যাও বেশি দিন থাকে না। তবে সমস্যা চলতে থাকলে নবজাতক-বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে হবে। এসব যত্ন যে শুধু ডাক্তার বা হাসপাতাল করবে, তা নয়। পরিবার ও পাড়া-প্রতিবেশীদের সহযোগিতাও দরকার। এ ব্যাপারে জনসচেতনতা বিশেষ প্রয়োজন।
ইউনিসেফের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ শামিনা শারমীন বলেন, আমাদের দেশে ক্যাঙারু মাদার কেয়ার (কেএমসি) সম্পর্কে সচেতনতা এখনো কম। এটা হলো মায়ের বুকে শিশুকে শুইয়ে রাখার একটি ব্যবস্থা। মায়ের ত্বক থেকে তাপ নিয়ে শিশু বাঁচে। যেসব শিশু সময়ের আগে কম ওজন নিয়ে জন্মায়, তাদের শরীরের তাপমাত্রা কম থাকে। তাদের জন্য কেএমসি ব্যবস্থা অনেক সময় যথেষ্ট সুফল দেয়।
তবে অনেক শিশুর স্ক্যানুতে বিশেষ যত্ন দরকার। স্ক্যানু মানে স্পেশাল কেয়ার নিউবর্ন ইউনিট। সেখানে ইনকিউবেটর থেকে শুরু করে অক্সিজেন—সব ব্যবস্থা আছে। সমস্যা হলো, স্ক্যানু সব হাসপাতালে হয়তো থাকে না। থাকলেও বেড কম। কিন্তু এটাও ঠিক যে সব নবজাতকের হয়তো স্ক্যানুর দরকার হয় না। সেখানে কেএমসি যথেষ্ট। অথচ মায়েরা ভাবেন স্ক্যানু না হলে চলবে না। তাঁরা কেএমসি ব্যবহার করতে চান না। অপেক্ষা করেন স্ক্যানুর জন্য। ফলে অনেক সময় নবজাতকের প্রাণ-সংকট দেখা দেয়।
যেখানে স্ক্যানু নেই বা স্ক্যানুর বেড কম, সেখানে তো নবজাতককে বাঁচাতে কেএমসি কাজে লাগানো যায়। এ বিষয়ে সচেতনতা দরকার।
কিন্তু মূল প্রশ্ন হলো কেন শিশু সময়ের আগে জন্ম নেয়? কেন তার ওজন কম হয়? এ বিষয়ে গবেষণার বিশেষ প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন স্বাস্থ্য বিভাগের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি জানতে পারি সমস্যা কোথায়, তাহলে হয়তো প্রতিকারের ব্যবস্থা করা যাবে এবং নবজাতকের মৃত্যুহার কমানো সহজ হবে।’
এ বিষয়ে আইসিডিডিআরবির সিনিয়র ডিরেক্টর শামস এল আরেফিনও এ ধরনের গবেষণার গুরুত্বের কথা বলেন। তবে সাধারণভাবে আমরা জানি, গর্ভধারণের আগে থেকেই মা যেন পুষ্টিকর খাবার খান সেদিকে নজর দিতে হবে। শুধু এক ধরনের খাবার নয়। খাদ্যতালিকায় পরিবর্তন আনতে হবে। খাদ্যের মধ্য দিয়ে মা যেন প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও মিনারেল পান, সেটা দেখতে হবে। মনে রাখতে হবে, সন্তানসম্ভবা মা শুধু নিজের জন্য না, তাঁর অনাগত শিশুর জন্যও খাবেন।
এখানেই সমস্যা। আমাদের গ্রামে গ্রামে পরিবারের সদস্যদের কতজন এ বিষয়ে চিন্তা করেন? দারিদ্র্য একটা কারণ বটে। কিন্তু এখন তো দারিদ্র্যের হার কমছে। গ্রামের মানুষের আয়-উপার্জন বাড়ছে। কিন্তু যদি সনাতন চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন না আসে তাহলে তো সন্তানবতী মা তঁার প্রয়োজনীয় পুষ্টি পাবেন না। তখন নবজাতক ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে।
এ কথাটা আমাদের সবার মনে রাখতে হবে।
আব্দুল কাইয়ুম প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক
quayum@gmail.com
No comments:
Post a Comment