ক্রিপ্টোকারেন্সি এক ধরণের সাংকেতিক মুদ্রা। যার কোন বাস্তব রূপ নেই। এর অস্তিত শুধু ইন্টারনেট জগতেই আছে। এটি ব্যবহার করে লেনদেন শুধু অনলাইনেই সম্ভব। যার পুরো কার্যক্রম ক্রিপ্টগ্রাফি নামক একটি সুরক্ষিত প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়। ২০১৭ সাল থেকে এটি একটি উঠতি মার্কেটি পরিণত হয়েছে।
ক্রিপ্টো মুদ্রা আবিষ্কারের প্রচেষ্টা চলছে দীর্ঘদিন ধরে। সংকেত রীতি বিদ্যা বা ক্রিপ্টোগ্রাফি থেকে যে এমন একটি মুদ্রা আবিষ্কার করা সম্ভব, সেটা গবেষকেরা জেনেছেন আশির দশকে। কিন্তু কয়েকটি সমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থ হন তাঁরা। ২০০৮ সালে অজানা এক গবেষক সুচারুভাবে সেসব সমস্যার সমাধান দিয়ে একটি গবেষণাপত্র ইন্টারনেট ফোরামে পাঠান। বিস্ময়করভাবে তাঁর সমাধান কাজে লাগে। তাঁর সমাধানের নাম ব্লক চেইন। তার ওপরে ভিত্তি করে প্রথম ক্রিপ্ট মুদ্রা উদ্ভাবন হয়, যার নাম বিটকয়েন। এর গগনচুম্বী দাম আর ঊর্ধ্বগতির কারণে একে বর্তমানে অনেকে মুদ্রা না ভেবে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করছেন।
পরে আরও অনেক ক্রিপ্টো মুদ্রার উদ্ভাবন হয়েছে—যেমন ইথারিয়াম, রিপল, লাইট কয়েন ইত্যাদি। কিন্তু বিটকয়েন প্রথম ক্রিপ্টো মুদ্রা হওয়ায় এবং অনেক গবেষক ও বিনিয়োগকারীর মনোযোগ আকর্ষণে সক্ষম হওয়ায় অন্য কয়েন থেকে এটি এগিয়ে আছে। তবে আরেকটি ক্রিপ্টো মুদ্রা বিটকয়েনকে সম্পূর্ণ দেউলিয়া করে দিতে পারে, সেটাই বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটা বড় ঝুঁকির বিষয়। কোনটা এগিয়ে যাবে, তা-ও কেউ বলতে পারে না। এখন আবার বাজারে প্রায় কয়েক শ ক্রিপ্টো মুদ্রা আছে এবং অবশ্যই আরও অনেক নতুন মুদ্রার আমদানি হবে।
অনেকেই প্রশ্ন করেন, এই মুদ্রা দেখতে কেমন? এই মুদ্রার বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই। এটি কম্পিউটারের একটা সফটওয়্যার। অনেক ছবিতে স্বর্ণমুদ্রায় বড় করে ইংরেজি যে ‘বি’ অক্ষরটি লেখা থাকতে দেখা যায়, সেটা কাল্পনিক। এমনকি সে রকম স্মারকও পাওয়া যায়। সেটা বিটকয়েন নয়।
ক্রিপ্টো ওয়ালেট
ওয়ালেট অনলাইন মানিব্যাগ। যা অনলাইন ও অফলাইন, এই দুই ধরণের হয়। এই ওয়ালেট থেকে প্রেরণকারী অর্থ পাঠাতে পারে। আর গ্রহণকারী নিজের ওয়ালেটে ভর্তে পারে। প্রতিটি ওয়ালেটের এক একটি নিদির্ষ্ট এনক্রিপ্টেড ঠিকানা থাকে।বিটকয়েন বা ক্রিপ্টো মুদ্রার প্রয়োজন কী?
সমাজ ও জীবন যেমন এগিয়ে যাচ্ছে, বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে তেমনি অর্থনৈতিক ইনস্ট্রুমেন্টেরও অগ্রগতি হচ্ছে। মুদ্রা নামের জিনিসটার অনেক বিবর্তন ঘটেছে। স্বর্ণ, রৌপ্য বা ধাতব মুদ্রা থেকে সেটা কাগুজে মুদ্রায় পরিণত হয়েছে। এর নকল ঠেকাতে উন্নততর প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। তারপর এল ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড। তা দিয়ে অর্থনৈতিক বিনিময় আরও সহজ হয়ে গেল। এগুলোকে ‘ডিজিটাল কারেন্সি’ বলা যেতে পারে। কিন্তু সবচেয়ে অভাবনীয় অগ্রগতি এনেছে ক্রিপ্টো মুদ্রা। এর কয়েকটি চরিত্র তুলে ধরা যাক।
১. এর কোনো সরকার বা প্রতিষ্ঠান নেই। পৃথিবীজুড়ে বিপুল জনগোষ্ঠী একধরনের নিরাপদ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এই মুদ্রার প্রচলন করছে। কেউ নীতিনির্ধারক নয়, সবাই সমান, নেটওয়ার্কের একটি নোড মাত্র। ক্রেতা থেকে বিক্রেতার কাছে সরাসরি, কারও মধ্যস্থতা ছাড়াই, নিরাপদ ও নিশ্চিতভাবে এই মুদ্রা চলে যাবে। এই মুদ্রাব্যবস্থার কোনো কেন্দ্রীয় রূপ নেই, এখানে সম্পূর্ণ বিকেন্দ্রীকরণ হয়েছে। এটাকে সরাসরি ক্রেতা-বিক্রেতার (পিয়ার-টু-পিয়ার) নেটওয়ার্ক বলে।
২. বিটকয়েনের ফলে এক মুহূর্তে যে কেউ ঘানা থেকে চীনে মুদ্রা পাঠিয়ে কোনো কিছু কিনতে পারবে। কোনো ব্যাংকের ব্যাপার নেই, কোনো মুদ্রা বিনিময় হারের ব্যাপার নেই। মধ্যবর্তী কোনো সংস্থা নেই, সেটাই এই মুদ্রার ডিজাইন।
৩. এই মুদ্রা ত্বরিত এক দেশ থেকে আরেক দেশে চলে যেতে পারে। বিটকয়েনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১০ মিনিট লাগছে। কিন্তু অন্য কিছু ক্রিপ্টো মুদ্রা আরও কম সময়ে হাত বদল হতে পারে। অথচ বর্তমান মুদ্রা স্থানান্তর ব্যবস্থায় এক দেশ থেকে আরেক দেশে যেতে কয়েক দিন লেগে যায়।
৪. এই মুদ্রা একজনের কাছ থেকে আরেকজনের কাছে পাঠাতে নামমাত্র ফি লাগে। এটি আবার পাঠানো অর্থের পরিমাণের ওপর নির্ভরশীল নয়। একটি বিটকয়েন আর এক লাখ বিটকয়েন পাঠাতে একই ফি। বর্তমান মানি ট্রান্সফারে বেশ অর্থ ব্যয় হয়।
৫. ক্রিপ্টো মুদ্রার লেনদেন জাল করা যায় না। একবার ট্রান্সফার হয়ে গেলে ওটাকে কোনোভাবে ফিরিয়ে নিতে বা পরিবর্তন করা যায় না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, হাজার হাজার মেশিনে এটা লিপিবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। এই লেনদেন অপরিবর্তনীয়।
৬. ক্রিপ্টো মুদ্রার কোনো মুদ্রাস্ফীতি নেই। এই মুদ্রার সংখ্যা পূর্বনির্ধারিত, তাই টাকার মতো তা আরও ছাপানো যায় না। বিভিন্ন দেশ প্রকাশ্যে বা গোপনে তাদের মুদ্রা বেশি ছাপিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে, ফলে মুদ্রা যুদ্ধ শুরু হয়ে যাচ্ছে। ক্রিপ্টো মুদ্রায় এটি একেবারেই অসম্ভব। বিটকয়েনের সর্বোচ্চ সংখ্যায় ২ দশমিক ১ কোটিতে নির্ধারিত করা আছে।
বিটকয়েন
অনলাইনে ডলার-পাউন্ড-ইউরোর
পাশাপাশি কেনাকাটা করা যায় বিটকয়েনে। তবে অন্যান্য মুদ্রাব্যবস্থায় যেমন সে
দেশের সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক জড়িত থাকে, বিটকয়েনের ক্ষেত্রে তা নয়।
২০০৯ সালে সাতোশি নাকামোতো ছদ্মনামের কেউ কিংবা একদল সফটওয়্যার ডেভেলপার
নতুন ধরনের ভার্চ্যুয়াল মুদ্রার প্রচলন করে। এ ধরনের মুদ্রা
ক্রিপ্টোকারেন্সি নামে পরিচিতি পায়। নাকামোতোর উদ্ভাবিত সে
ক্রিপ্টোকারেন্সির নাম দেওয়া হয় বিটকয়েন।
বিটকয়েন
লেনদেনে কোনো ব্যাংকিং ব্যবস্থা নেই। ইলেকট্রনিক মাধ্যমে অনলাইনে দুজন
ব্যবহারকারীর মধ্যে সরাসরি (পিয়ার-টু-পিয়ার) আদান-প্রদান হয়। লেনদেনের
নিরাপত্তার জন্য ব্যবহার করা হয় ক্রিপ্টোগ্রাফি নামের পদ্ধতি।
বিটকয়েন
(Bitcoin) কম্পিউটার সফটওয়্যার, কোনো আকার নেই। বিটকয়েনকে কেউ যদি ভীষণ
ঝুঁকিপূর্ণ স্টক বা শেয়ার বলে মনে করেন, তাহলে তাঁকে মোটেও দোষ দেওয়া যায়
না। এর মধ্যে প্রায় পুরোটাই কারসাজি ও জালিয়াতি, এই কয়েন আজ যে আমির, কাল
তাঁকে ফকির বানিয়ে দিতে পারে। সেই রকম ঘটনা প্রায়ই শোনা যাচ্ছে এবং লোকমুখে
ছড়াচ্ছে। ঝুঁকির ব্যাপারটা ভুলও নয়। বিটকয়েনের পক্ষের মানুষও বিষয়টি
স্বীকার করছেন। বিটকয়েন অবশ্যই অন্যতম আবিষ্কার, ব্লক চেইন প্রযুক্তি, যার
ওপর ভিত্তি করে প্রথম তৈরি হয়েছে ‘ক্রিপ্টো-মুদ্রা’। বিটকয়েন নিরাপদ একটি
সফটওয়্যার। বিশেষজ্ঞরা একমত, বিটকয়েনের মূলে যে ব্লক চেইন প্রযুক্তি, তা
অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য। ব্যাংক, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানকেও ব্লক চেইন প্রযুক্তি
ব্যবহার করা উচিত।
বিটকয়েনের এত মূল্য কেন?
সম্প্রতি বিটকয়েনের অবিশ্বাস্য মূল্য বিস্ফোরণে সবার টনক নড়েছে। কেউ আর একে
হেলাফেলা করতে পারছেন না। শিকাগো এক্সচেঞ্জে বিটকয়েনের ফিউচার বিক্রির
অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ম্যারিল লিঞ্চ, ব্যাংক অব আমেরিকাসহ অনেক নামি
প্রতিষ্ঠান বলছে, এটা বুদ্বুদ নয়। এই মূল্য বৃদ্ধির পেছনে অবশ্যই কারণ
রয়েছে। কারণ অনেক গভীরও বটে। যতটা না অর্থনৈতিক, তার চেয়ে বেশি প্রযুক্তিগত
ও বৈজ্ঞানিক। ইতিমধ্যেই ব্লক চেইন নতুন সম্ভাবনাময় প্রযুক্তি হিসেবে গৃহীত
হয়েছে।
বিটকয়েনের মূল্য বাড়ার বেশ কিছু কারণ আছে বলে ধারণা করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে—
১. মনে করা হচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবীজুড়ে সবাই ক্রিপ্টো মুদ্রা ব্যবহার করবে। এটিকে এভাবে বোঝানো যায়, কেউ যদি ২০ বছর আগে বলত, পৃথিবীজুড়ে সবাই মুঠোফোন ব্যবহার করবে, সেটা হয়তো তখন খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হতো না। এখানেও ঠিক তেমনটি ঘটছে বলে অনেকেই মনে করছেন।
২. বিটকয়েনের সংখ্যা সীমিত। তাই একটি বিটকয়েনের দাম অনেক বেশি হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ, পৃথিবীর সব সম্পদ ওই সীমিত বিটকয়েন দিয়ে কিনতে হবে, তাই একেকটির দাম হবে গগনচুম্বী।
ক্রিপ্টোকারেন্সির তালিকা
সারা পৃথিবীতে প্রায় হাজারেরও উপরে সাংকেতিক মুদ্র রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে__ • বিটকয়েন • ইথেরিয়াম • লাইটকয়েন • ডগিকয়েন • রিপল • মোনেরো • ড্যাশ • বাইটকয়েন • ডোজকয়েন ইত্যাদি। তবে এগুলোর মধ্যে বিটকয়েন সবার পূর্বসূরি ও সবচেয়ে পরিচিত। মূলত এর সফলতার কারণেই আরো প্রতিদ্বন্দী কারেন্সির জন্ম হয়।
বিটকয়েন দিয়ে কি কিছু কেনা যায়?
বিটকয়েন দিয়ে বর্তমানে অনেক কিছুই কেনা যায়। যেমন ওভারস্টক ডট কম থেকে যেকোনো পণ্য বিটকয়েনের মাধ্যমে কেনা যাবে। এমন আরও অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বর্তমানে বিটকয়েনকে মুদ্রা হিসেবে নিচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, এখন যেমন অর্থের বদলে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার হচ্ছে, ভবিষ্যতে তেমনি টাকা ও ক্রেডিট কার্ডের বদলে বিটকয়েন বা অন্য কোনো সাংকেতিক মুদ্রা ব্যবহৃত হবে।
ক্রিপ্টো মুদ্রা বা বিটকয়েনেরে দাম এত অস্থিতিশীল কেন?
উল্লিখিত সব সম্ভাবনার জন্য বিটকয়েনের দাম বাড়ে। আবার হঠাৎ কোনো জালিয়াতি হলে বা ধরা পড়লে এর দাম কমে। আবার কোনো দেশ আগে অবৈধ ঘোষণা করলে, অথবা কোনো দেশ এই মুদ্রার পক্ষে অবস্থান নিলে মুহূর্তেই দাম অনেক কমে বা বেড়ে যায়। দাম বাড়া-কমা অনেকটাই মানুষের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার। তারপর আছে অন্যান্য সাংকেতিক মুদ্রার অবস্থান। যদি খবর রটে, ইথারিয়াম অথবা রিপল হবে ভবিষ্যতের মুদ্রা, তাহলে বিটকয়েনের দাম কমবে। এসব নানা কারণে বিটকয়েনের দাম বাড়ে-কমে। এর মধ্যে মুনাফালোভী বড় বড় কুমিররূপী বিনিয়োগকারী হঠাৎ অনেক বিনিয়োগ করে বিটকয়েনের দাম বাড়াতে পারে, আবার হঠাৎ সব টাকা তুলে নিয়ে ধস নামাতে পারে।
ক্রিপ্টো মুদ্রা নিয়ে জালিয়াতি কারা করছে?
সরাসরি বিটকয়েন বা ক্রিপ্টো মুদ্রা নিয়ে কেউ জালিয়াতি করছে না। এর ভিত্তি যে ব্লক চেইন, তা সবচেয়ে নিরাপদ বলে বিবেচিত। বিটকয়েন ক্রেতার অ্যাকাউন্ট নিয়ে জালিয়াতি হচ্ছে। বিটকয়েন বেচাকেনায় মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে জালিয়াতি হয়ে থাকে। মানুষ সতর্ক হচ্ছে। আরও নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান আসছে। পাসওয়ার্ড ও পরিচয় পদ্ধতি আরও নিরাপদ হচ্ছে। কাজেই কিছু সংবাদ যে বিটকয়েন বা ক্রিপ্টো মুদ্রাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে বা দেবে, তা পুরোপুরি ঠিক নয়।
ব্লক চেইন কী?
এক ঠিকানা থেকে অন্য ঠিকানায় ক্রিপ্টোকারেন্সি পাঠাতে তা এনক্রিপটেড লেজার বা উন্মুক্ত খতিয়ানে রেকর্ড হয়ে যায়। যাকে ব্লকচেইন বলে। এখানে জমা থাকা তথ্য পৃথিবী যে কোন স্থান থেকে দেখা সম্ভব।
ব্লক চেইন একটা প্রযুক্তি, যার ওপর ভিত্তি করে মূলত বিটকয়েন এবং অন্যান্য ক্রিপ্টো মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রতিটি লেনদেন এই ব্লক চেইনে থাকছে। একে বলে পাবলিক লেজার, বাংলা করলে দাঁড়ায় উন্মুক্ত খতিয়ান। এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। একটি লেনদেন পাকা হয়ে উন্মুক্ত খতিয়ানে যেতে হলে এই ব্লক চেইন নেটওয়ার্কের সিংহভাগ নোডকে (কম্পিউটার বা বিশেষ ধরনের কম্পিউটার জাতীয় মেশিন) সহমত হতে হবে। এই সহমত হওয়ার একটা অ্যালগরিদমও (কনসেনসাস অ্যালগরিদম) রয়েছে।
পরিশেষে জটিল একটি গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে হয়, যাকে বলে প্রুফ অব ওয়ার্ক। যারা এটা করে তাদের বলে মাইনার। প্রথম যে সমাধান করতে পারবে সে বিজয়ী, সে পুরস্কার হিসেবে বিটকয়েন পাবে। আগে এটি ছিল ২৫টি বিটকয়েন, এখন ১২ দশমিক ৫টি বিটকয়েন। কিছুদিন পরপর এটা অর্ধেক হয়ে যাবে, সেটাও ব্লক চেইন প্রযুক্তির একটা প্রটোকল। মাইনাররা আবার সহমত হতে ভোট দিচ্ছে। অসংখ্য মাইনার কাজ করে যাচ্ছে। এ কারণেই ক্রিপ্টো মুদ্রার লেনদেন জালিয়াতি বা ভুল হতে পারে না। পৃথিবীর যে কেউ বিশেষ শক্তিসম্পন্ন নির্ভরযোগ্য কম্পিউটার বা মেশিন কিনে এই নেটওয়ার্কে যোগ দিয়ে মাইনার হতে পারে, এমনকি কিছু টাকাপয়সাও উপার্জন করতে পারে। এই ব্লক চেইন প্রযুক্তির সম্ভাবনা অপরিসীম। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, বাড়িঘর ও জমির মালিকানায় যদি ব্লক চেইন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, তাহলে মালিকানা বা দলিল জাল করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। এটি উন্মুক্ত খতিয়ানে থাকার ফলে সবাই জানবে, কে কোন জায়গার মালিক।
ক্রিপ্টো মুদ্রার অভিশাপ
সব যুগান্তকারী আবিষ্কারেরই কিছু অভিশাপ থাকে। ক্রিপ্টো মুদ্রায়ও আছে। এখানে যদিও প্রতিটি লেনদেন ব্লক চেইনে লেখা থাকছে, কিন্তু সেখানে মানুষ বা প্রতিষ্ঠানটির নাম-ঠিকানা থাকছে না। শুধু একটি সাংকেতিক চাবি (পাবলিক কি) থাকছে, যেটা থেকে কোনোভাবেই সেই মানুষ বা প্রতিষ্ঠানটিকে বের করা সম্ভব নয়। ব্যাপারটা এ রকম, একেকজনের পরিচয় একেকটা নম্বর দিয়ে, কাজেই ১১১ নম্বরের ওয়ালেটে (ক্রিপ্টো মুদ্রার অ্যাকাউন্টকে ওয়ালেট বলা হয়) কোত্থেকে বিটকয়েন এসেছে, সে কোথায় পাঠিয়েছে—সব দেখা যাবে। এটা উন্মুক্ত খতিয়ানে থাকছে। কাজেই যে কেউ দেখতে পাবে, কিন্তু এই ১১১ নম্বরের পেছনের মানুষটা কে, তা কেউ জানতে পারবে না। তাহলে অপরাধীদের জন্য বিরাট সুবিধা। তারা পর্দার অন্তরালে থেকে অর্থ লেনদেন করতে পারবে।
সরকার ও বিটকয়েন
বিটকয়েনকে মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করা বা এটিকে অন্য কোনোভাবে কেনা বা বিক্রয় করাকে বিশ্বের সাতটি দেশ বেআইনি ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। অন্য দেশগুলো হচ্ছে নেপাল, ইকুয়েডর, বলিভিয়া, মরক্কো, আলজেরিয়া ও কিরগিজস্তান। উবার, লিফটসহ অন্যান্য নতুন উদ্ভাবনের মতোই এটিও নিয়মনীতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের সরকারকে মুশকিলে ফেলে দিয়েছে। তবে এর আয়কর-কাঠামো, উত্তরাধিকার ইত্যাদি নানান বিষয়ে নীতি প্রণয়নের কাজ চলছে। সরকারের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সত্ত্বেও গণমানুষের এই নতুন প্রযুক্তিতে উৎসাহের কোনো কমতি নেই। পৃথিবীর দেশে দেশে বিশেষ করে আমেরিকা, চীন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নাইজেরিয়া, ব্রাজিল, ইসরায়েল, ইংল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরে বিপুল উৎসাহে মাইনাররা বিটকয়েন নেটওয়ার্কে যুক্ত হচ্ছে। ব্লক চেইন প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে সেসব দেশে নতুন নতুন সম্ভাবনাময় কোম্পানি সৃষ্টি হচ্ছে। ব্যাপারটা যেন নজরুলের সেই কবিতার লাইন, ‘কে রোধিবি এই জোয়ারের টান, গগনে যখন উঠেছে চাঁদ’।
ক্রিপ্টো মুদ্রা বা বিটকয়েনেরে ভবিষ্যৎ কী?
মনে করা হচ্ছে ক্রিপ্টো মুদ্রাই ভবিষ্যতের মুদ্রা। এর মুলে যে ব্লক চেইন, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই তথ্য ও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা কাজ শুরু করেছেন। ইন্টারনেট যেভাবে দুনিয়া পাল্টে দিল, মুঠোফোন যেভাবে ঘরে ঘরে গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে, এটাও তেমনি ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু কোন মুদ্রাটা? বিটকয়েন, রিপল, লাইট কয়েন, ইথারিয়াম, নাকি মফিজ কয়েন? বলা মুশকিল। কেউ জানে না। কিন্তু একটা না একটা ক্রিপ্টো মুদ্রা আসন গেড়ে বসবে। ডলার ধীরে ধীরে উঠেই যাবে, ইউরো উঠে যাবে, টাকাও একদিন উঠে যাবে। ব্যাংকে মানুষ যাবে না, সবার ক্রিপ্টো মুদ্রার ওয়ালেট থাকবে, কম্পিউটারে বা মোবাইলে। অনেকে বলছেন, এই অ্যাকাউন্টটিকে শুধু ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে তুলনা করলেই হবে না। এর একেকটা নিজেই একটা ব্যাংক। ব্যাংকের নিয়মকানুন, ফি, সব ওই মানুষটিই নির্ধারণ করবে। আর এই মুদ্রার তো দেশের গণ্ডি থাকছেই না।
No comments:
Post a Comment