ইসলামে পোশাকের নির্দিষ্ট নীতিমালা আছে। নীতিমালা অনুসরণ করে নিজস্ব সংস্কৃতির যেকোনো পোশাক পরিধান করার অবকাশ আছে।
তবে সুন্নাহসম্মত পোশাক পরিধান করা উত্তম। স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সা.) জামা, লুঙ্গি, চাদর ও পাগড়ি পরিধান করেছেন। তিনি সালোয়ার কিনে অন্যদের হাদিয়া দেওয়ার বিষয়টিও প্রমাণিত। তাই মুসলমানদের উচিত সুন্নাহসম্মত পোশাক পরিধান করা। পশ্চিমাদের কৃষ্টি-কালচার ও সভ্যতা-সংস্কৃতি থেকে দূরে থাকা জরুরি। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে কোট-স্যুট ও প্যান্ট-শার্ট পশ্চিমাদের সংস্কৃতি থেকে আমাদের সংস্কৃতিতে ঢুকে পড়েছে। তাই কাফিরদের সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়ায় মৌলিকভাবে এগুলো নিষিদ্ধ হওয়ারই কথা। এ জন্য প্রথম দিকে মুফতি সাহেবরা এগুলো পরিধানকে মাকরুহ বলেছেন। যেমন—মুফতি কেফায়েত উল্লাহ (রহ.) লিখেছেন : ‘কোট-স্যুট এখনো ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়নি, বরং এগুলো খ্রিস্টান ও তাদের অনুসারীদের পোশাক।
আল্লামা জাফর আহমদ থানভি (রহ.) লিখেছেন : ‘কোট-স্যুট ইত্যাদি পরিধান করা ইংরেজদের জাতিগত ঐতিহ্য। সুতরাং এটা পরিধান করা মাকরুহ। আর ইচ্ছাকৃত তাদের আদলে জীবন গঠনের নিয়্যাতে এগুলো পরিধান করা হারাম। ’ (এমদাদুল আহকাম : ৪/৩৪১)
মাওলানা ইউসুফ লুদয়ানুভি (রহ.) লিখেছেন : ‘প্যান্ট-শার্ট পরিধান করা মাকরুহে তাহরিমি। ’ (আপ কে মাসায়েল : ৮/৩৭১)
কিন্তু আজকাল মুসলমানদের মধ্যে কোট-স্যুট, প্যান্ট-শার্ট পরিধান করা ব্যাপকভাবে প্রচলিত। অধিক প্রচলনের কারণে এগুলোকে কাফিরদের ঐতিহ্যবাহী ও জাতিগত নিদর্শনমূলক পোশাক বলা কঠিন। তাই মুফতি মাহমুদ হাসান গাংগুহি (রহ.) বলেছেন : ‘পাক-ভারত উপমহাদেশে কোট-স্যুট পরিধান করা হারাম নয়, তবে এটি নেককার ও ওলি-আউলিয়াদের পোশাক নয়। তাই এগুলো থেকে দূরে থাকা উচিত। ’ (ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়া : ১৯/২৬০)
স্মরণ রাখতে হবে, ব্যাপকভাবে প্যান্ট পরিধান করার প্রথা থাকলেও দুটি শর্তে তা পরিধান করা বৈধ। এক. টাখনুর নিচে প্যান্ট পরিধান করা যাবে না। দুই. প্যান্ট ঢিলেঢালা হতে হবে। আঁটসাঁট ও চিপা প্যান্ট পরিধান করা হারাম। কেননা এতে লজ্জাস্থান দৃশ্যমান থাকে।
ভারতবর্ষের আধুনিক যুগের আলেম আল্লামা তকি উসমানি (দা. বা.) লিখেছেন : ‘কেউ যদি গুরুত্বের সঙ্গে এ বিষয়টি আমলে নেয় যে তার প্যান্ট ঢিলেঢালা হবে এবং টাখনুর নিচে তা পরিধান করবে না, তাহলে এমন প্যান্ট পরিধান করা বৈধ। যদিও তা অনুত্তম। ’ (এসলাহি খুতুবাত : ৫/২৯৪)
নারীদের জন্য শার্ট-প্যান্ট পরিধানের বিধান
ওপরে প্যান্ট সম্পর্কে যে আলোচনা করা হলো, তা শুধু পুরুষদের জন্য প্রযোজ্য। প্রাচীন ও আধুনিক ইসলামী পণ্ডিতরা মনে করেন, নারীদের জন্য প্যান্ট পরিধান করা বৈধ নয়। কেননা প্রথমত, এটি কাফিরদের সাদৃশ্যপূর্ণ। দ্বিতীয়ত, এটি পুরুষদের সাদৃশ্যপূর্ণ পোশাক। হাদিস শরিফে এমন সাদৃশ্যপূর্ণ পোশাক পরিধানে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। তৃতীয়ত, প্যান্ট পুরুষদের তুলনায় নারীদের জন্য অধিক লজ্জাহীনতা, পর্দাহীনতা ও উলঙ্গপনার কারণ। এ জন্য নারীদের সর্বাবস্থায় এটি প্রত্যাখ্যান করা উচিত। আর বর্তমানে চুরি বা কুঞ্চিত পায়জামার প্রচলন ঘটেছে। এটা আর প্যান্টের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এটা পরিধান করলেও নগ্নতা প্রকাশিত হয়।
নারী-পুরুষ একে অন্যের সাদৃশ্য অবলম্বনের বিরুদ্ধে ইসলামে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। তাই চালচলন, ফ্যাশন, পোশাক পরিধান ও সাধারণ অভ্যাসের ক্ষেত্রে একে অন্যের সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়া নিষিদ্ধ। এ বিষয়ে এখানে কিছু হাদিস উল্লেখ করা হলো : ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) লানত করেছেন নারীদের বেশভূষা ধারণকারী পুরুষদের এবং পুরুষদের বেশভূষা ধারণকারী নারীদের। ’ (বুখারি শরিফ, হাদিস : ৫৮৮৫)
হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) এক মহিলাকে পুরুষদের মতো জুতা পরিধান করতে দেখে তাকে অভিশাপ দিয়েছেন। ’ (শুআবুল ঈমান, হাদিস : ৭৪১৮)
নারী-পুরুষের প্রাকৃতিক পার্থক্য ধরে রাখতে হবে জীবনের সব ক্ষেত্রে। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) নারী হতে আগ্রহী পুরুষদের এবং পুরুষ হতে আগ্রহী নারীদের অভিসম্পাত করেছেন এবং বলেছেন, এদের ঘর থেকে বের করে দাও। ’ (বুখারি শরিফ, হাদিস : ৫৮৮৬)
নারী-পুরুষের সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়ার বিষয়টি ইসলাম খুবই কঠোরভাবে দেখেছে। তাই রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন : ‘পুরুষের সাদৃশ্য অবলম্বনকারী নারীরা আমাদের দলভুক্ত নয়। নারীদের সাদৃশ্যপূর্ণ পুরুষেরা আমাদের দলভুক্ত নয়। ’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৪৬২)
কলারবিশিষ্ট জামাকাপড়ের বিধান
প্রথমদিকে আলেমরা কলার লাগাতে নিষেধ করতেন। যেমন—মাওলানা জফার আহমদ উসমানি (রহ.) লিখেছেন, ‘এতে সন্দেহ নেই যে কলার লাগানো খ্রিস্টানদের সাদৃশ্যপূর্ণ কাজ। তাই এটা নাজায়েজ। ’ (এমদাদুল আহকাম : ৪/৩৩৫)
মাওলানা ইউসুফ লুদয়ানুভি (রহ.) বলেন, ‘কলার লাগানো ইংরেজদের ঐতিহ্য। মুসলমানদের তা বর্জন করা উচিত। (আপ কে মাসায়েল : ৮/৩৭০)
কিন্তু এখন মুসলমানদের মধ্যে কলারবিশিষ্ট জামার ব্যাপক প্রচলন ঘটেছে। ফলে একে কাফিরদের ঐতিহ্যবাহী ও জাতিগত পোশাক বলা কঠিন। কিন্তু তার পরও যথাসম্ভব এ থেকে বেঁচে থাকা প্রয়োজন। কেননা এটি সালেহিন ও নেককারদের পোশাক নয়। মুফতি মাহমুদ হাসান গাংগুহি (রহ.) লিখেছেন : এখন এটি কাফির-মুশরিক ও ফাসেকদের নিদর্শনসংবলিত পোশাক নয়। তাই এটি তাদের সাদৃশ্যপূর্ণও নয়। (ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়া : ১৯/২৬৭)
গলায় টাই ঝোলানোর বিধান
গলায় টাই ঝোলানো মুসলমানদের পোশাক নয়। এটা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অংশ। সুতরাং এটা বর্জন করা উচিত। মাওলানা ইউসুফ লুদয়ানুভি (রহ.) লিখেছেন : ‘আমি কোনো একটি গ্রন্থে অধ্যয়ন করেছি যে এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটেনিকার যখন প্রথম সংস্করণ বের হয়েছে, তখন টাই সম্পর্কে লেখা ছিল যে এটা খ্রিস্টানদের ক্রুশ চিহ্নের নিদর্শনস্বরূপ খ্রিস্টানরা গলায় ঝুলিয়ে থাকে। কিন্তু এই এনসাইক্লোপিডিয়ার পরবর্তী সংস্করণগুলোতে এ কথা পাল্টে দেওয়া হয়েছে। যদি এ কথা সত্য হয়, তবে বলা যায়, পৈতা পরা যেমন হিন্দুদের ধর্মীয় প্রতীক, একইভাবে টাই ব্যবহার খ্রিস্টানদের ধর্মীয় প্রতীক। আর অন্য জাতি বা ধর্মের লোকদের ধর্মীয় ঐতিহ্যবাহী কোনো কিছু গ্রহণ করা নাজায়েজ। এটি ইসলামী মর্যাদাবোধের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। ’ (আপ কে মাসায়েল : ৮/৩৭১)
কিন্তু বর্তমানে টাই লাগানোও মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক হয়ে গেছে, এখন আগের মতো সাদৃশ্যের অর্থ কার্যকরও নয়, তাই টাই ব্যবহারে আগের মতো কঠোরতা আরোপ করা হবে না। তবে এটিও নেককার ও সালেহিনদের পোশাক নয় বলে বর্জন করা উচিত। মুফতি মাহমুদ হাসান (রহ.) লিখেছেন : টাই একসময় খ্রিস্টানদের নিদর্শন ছিল। তখন এর হুকুমও কঠোর ছিল। এখন অন্যদের মধ্যেও অধিকহারে এর ব্যবহার দেখা যায়। অনেক মুসলমানও টাই পরে থাকে। তাই এখন বিধানে কিছুটা শিথিলতা এসেছে। এখন এটাকে শিরক বা হারাম বলা যাবে না। তবে এখনো এটা পরিধান করা ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে পছন্দনীয় নয়। (ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়া : ১৯/২৮৯)
মুফতি তাজুল ইসলাম
ইসলামী চিন্তাবিদ।
ইসলামী চিন্তাবিদ।
No comments:
Post a Comment