করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে কার কী করণীয়?

লেখক
জাফরুল্লাহ চৌধুরী,
ট্রাস্টি, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র।

ছোঁয়াছে রোগের সূচনা
আফ্রিকার মুর মুসলমানরা তারিক বিন জাহিদের সেনাপতিত্বে ৭১১ সালে জিব্রালটার বিজয় করে ক্রমে ৭২০ সালের মধ্যে পুরো স্পেন ও পর্তুগালে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করে এবং কর্ডোভায় রাজধানী স্থাপন করে। বর্তমানের বহুল প্রশংসিত কর্ডোভা ক্যাথিড্রাল ৭০০ বছর (৮০০-১৫০০) ধরে পরিচিত ছিল আকর্ষণীয় কর্ডোভা মসজিদরূপে, যা স্থাপন করেছিলেন মুসলিম মুর শাসকরা। পনেরো শতাব্দীতে মুসলিম শাসনের পতন হলে স্পেনিয়ার্ডরা কর্ডোভা মসজিদের নতুন নামকরণ করে কর্ডোভা ক্যাথিড্রাল নামে। কর্ডোভা ক্যাথিড্রালের স্পেনীয় নাম হচ্ছে ‘La Megquita’’–মানে ‘দ্য মস্ক—মসজিদ’।

মুসলমানদের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও দ্বিধাবিভক্তির কারণে ১৪৯২ সালে স্পেনে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। একই বছর পরিব্রাজক ক্রিস্টোফার কলম্বাস নতুন মহাদেশ আমেরিকা আবিষ্কার করে স্পেনে ফিরে আসেন, তিনি নতুন মহাদেশে দিয়ে আসেন ইউরোপের রোগ—হাম, বসন্ত ও যৌনরোগ গনোরিয়া। সঙ্গে নিয়ে আসেন বিস্তর স্বর্ণখণ্ড ও যৌন ছোঁয়াচে রোগ সিফিলিস। সিফিলিস রোগের জীবাণুর নাম ট্রেপেনোমা প্যালিডিয়াম। কলম্বাসের নাবিকদের অবাধ যৌনবিহার ও গণিকা পেশার মাধ্যমে সিফিলিস পুরো আন্দুলুসিয়া, পর্তুগাল ও ইতালিতে ছড়িয়ে পড়ে। ১৪৯৬ সালে ছড়িয়ে পড়ে ডেনমার্ক ও সুইজারল্যান্ডে। ফ্রান্সের সম্রাট অষ্টম চার্লস বিভিন্ন দেশ থেকে সংগৃহীত বিরাট ভাড়াটে সেনাদল নিয়ে ১ সেপ্টেম্বর ১৪৯৫ সালে ইতালিতে প্রবেশ করেন, পথিমধ্যে ব্যাপক যৌন আমোদে অংশ নিয়ে নেপলস পৌঁছেন ১২ মে ১৪৯৫ সালে। প্যারিসে প্রত্যাবর্তন করেন জুলাই মাসে, সঙ্গে নিয়ে আসেন ‘রেনেসাঁ জীবাণু’, যা ফ্রান্সে পরিচিতি লাভ করে ‘নেপোলিয়ন ব্যামো’ বা ফরাসি ব্যামো নামে, যার দ্রুত বিস্তৃতি ঘটে জার্মানি ও উত্তর-পূর্ব ইউরোপে।

ভাস্কো দা গামা ৮ জুলাই ১৪৯৭ সালে বিরাট নৌবহর নিয়ে লিসবন ছাড়েন এবং ভারতের পশ্চিম উপকূলে কালিকটে তরি ভেড়ান ১৭ মে ১৪৯৮ সালে। তাঁর নাবিকরা ভারতীয় রমণীদের মধ্যে প্রসার ঘটায় ফিরিঙ্গি রোগ নামে খ্যাত সিফিলিসের। এ রোগ ১৫১০-২০ সালের মধ্যে আফ্রিকা, মালয় দ্বীপপুঞ্জ, জাপান ও চীনে ছড়িয়ে পড়ে। চীনে সিফিলিসের পরিচিতি ছিল ‘চেনিক ঘা’ নামে।

১৯৪৬ সালে অ্যান্টিবায়োটিক পেনিসিলিন বাজারজাত না হওয়া পর্যন্ত যৌনাচারে সংক্রমিত সিফিলিস রোগ সারা পৃথিবীকে ৬০০ বছর ধরে পর্যুদস্ত করে রেখেছিল। অনেকটা আজকের ছোঁয়াচে রোগ করোনা সংক্রমণের ধারায়।

১৯২৮ সালে ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরিতে আলেকজান্ডার ফ্লেমিং, হাওয়ার্ড ফ্লোরি, আর্নেস্ট বরিস চেন ও নরমান হিটলি সম্মিলিত গবেষণায় অ্যান্টিবায়োটিক পেনিসিলিন আবিষ্কার করেন। যে কয়েকটি পাত্রে প্রথম পেনিসিলিন উৎপাদন করা হয়েছিল, তার একটি পাত্র বিজ্ঞানী নরমান হিটলি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে উপহার দেন ১৯৮০ সালে, যা বর্তমানে সাভার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে রক্ষিত আছে।

পেনিসিলিন প্রথম ব্যবহৃত হয় লন্ডনের পুলিশ আলবার্ট আলেকজান্ডারের প্রদাহ নিবৃত্তির জন্য ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪১ সালে। পেনিসিলিনের ব্যাপক উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে মার্কিন বহুজাতিক কম্পানি এাবট, লিডারলি, ফাইজার, মার্ক ও স্কুইবের ভূমিকা স্মরণযোগ্য।

ভয়ানক ছোঁয়াচে করোনাভাইরাসের ইতিবৃত্ত

ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রাক্কালে ষাটের দশকে যুক্তরাষ্ট্র কলেরার জীবাণুর মাধ্যমে জীবাণুযুদ্ধের বিস্তারের জন্য ব্যাপক গবেষণা করছিল ঢাকার মহাখালীস্থ সিয়োটা কলেরা ল্যাবরেটরিতে, যা বর্তমানে আইসিডিডিআরবি (ICDDRB) নামে বিশ্বখ্যাত।

 এই শতাব্দীর প্রথম দশ থেকে সার্স করোনাভাইরাস (SARS-CoV-2) সংক্রান্ত গবেষণা চলছিল যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের উহানের গবেষণাগারে। জনশ্রুতি আছে, জীবাণুযুদ্ধে ভাইরাস ব্যবহারের উপযোগিতা পরীক্ষা ছিল মূল লক্ষ্য। কথিত আছে, চীনের সবচেয়ে বড় প্রদেশ হুবাইর রাজধানী উহানে প্রাণিবাজার থেকে করোনাভাইরাস নভেম্বর ২০১৯ সালে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়। সার্স ভাইরাস ৩৮৪ বার পরিবর্তিত হয়ে করোনা নভেল রোগ কভিড-১৯রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ রোগকে কভিড-১৯ নামকরণ করে ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ সালে এবং কভিড-১৯ মহামারি হিসেবে ঘোষণা দেন ১১ মার্চ ২০২০ সালে।

কভিড-১৯ অন্যান্য ভাইরাস থেকে অপেক্ষাকৃত বড় এবং ভয়ানক ছোঁয়াছে, মানুষ থেকে মানুষে অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, এক রাষ্ট্র থেকে অন্য রাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ প্রবাসী নাগরিকদের দেশে প্রত্যাবর্তন, বিনোদন বা পরিজনের সঙ্গে সময়যাপনের নিমিত্তে আগমন।

কভিড-১৯-এর উপসর্গগুলো হচ্ছে—জ্বর, কফ-কাশি, হাঁচি, মাংসপেশির বেদনা, গলাদাহ, যা দুই থেকে ১৪ দিনের মধ্যে ফুসফুসে সমস্যা সৃষ্টি করে। দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণ করা না হলে স্পনজি ফুসফুস স্লেটের মতো শক্ত হয়ে যায়।

১৭ মার্চ ২০২০ সাল পর্যন্ত সাত হাজার ৫০০-এর অধিক কভিড-১৯ রোগীর মৃত্যু হয়েছে ১৭০টি দেশে এবং আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় দুই লাখ। সবচেয়ে বেশি রোগী আছে চীন, কোরিয়া, ইরান, ইতালি, স্পেন ও ফ্রান্সে। বাংলাদেশে প্রমাণিত কভিড-১৯ রোগী মাত্র ১৪ জন এবং একজন মারা গেছেন। বাংলাদেশে এ রোগে আক্রান্তদের সংখ্যা যে লাফিয়ে বেড়ে যাবে না, তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। তবে সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।

১. বাংলাদেশে কভিড-১৯-এর প্রবেশদ্বার

ক. ভারত সীমান্ত : ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দুই হাজার ৫০০ কিলোমিটারের অধিক সীমান্ত রয়েছে, কয়েক শ পথে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করা যায়। তদুপরি রয়েছে প্রতিদিন কয়েক শ ভারতীয় ট্রাকের বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ট্রানজিট ব্যবহার। বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ লাখ ভারতীয় নিয়মিত কর্মে লিপ্ত। অনুমোদনবিহীন ভারতীয় নাগরিকের বাংলাদেশে অবস্থানের সঠিক তথ্য নেই। প্রতিদিন কয়েক হাজার ভারতীয় স্থলপথে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং প্রত্যাবর্তন করে। তাদের মাধ্যমে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের অনুপ্রবেশের আশঙ্কা সমধিক। বাংলাদেশ থেকেও প্রতিদিন কয়েক হাজার বাংলাদেশি চিকিৎসা, বিনোদন ও হুন্ডি ব্যবসার নিমিত্তে ভারতে আসা-যাওয়া করে। এ যাতায়াত বন্ধের জন্য সরকারকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

খ. কারাগার থেকে কভিড-১৯ ভাইরাসের অগ্ন্যুৎপাত হওয়ার আশঙ্কা সমধিক : বাংলাদেশের সব কারাগারের মিলিত বন্দি ধারণক্ষমতা ৪০ হাজারের চেয়ে কিছু বেশি। কিন্তু রাজনৈতিক হয়রানি, পুলিশের ঘুষ বাণিজ্য ও আইন-শৃঙ্খলার অবনতির কারণে কারাবন্দি আছে প্রায় ৯০ হাজার ব্যক্তি। কারাগারের জনাকীর্ণতা কভিড-১৯-এর জন্য উন্মুক্ত দ্বার সৃষ্টি করতে পারে। প্রতিকার হিসেবে সরকারের উচিত হবে ফাঁসির আসামি, যাবজ্জীবন ও ১০ বছরের অধিক দণ্ডপ্রাপ্ত ছাড়া অন্য সব দণ্ডপ্রাপ্ত অভিযুক্তকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে মুক্তি দিয়ে দেওয়া এবং বুঝিয়ে বলা—পরিবারের বাইরে যেন বেশি বিচরণ না করেন।

গ. আদালত প্রাঙ্গণ ও কোর্টসমূহ : সব সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কয়েক লাখ চিন্তিত ব্যক্তি, উকিল, মুহুরি ও অন্যান্য কর্মচারী আদালত প্রাঙ্গণ থেকে শুরু করে এজলাস পর্যন্ত ভয়ানক ভিড় করে থাকেন। একে অপরের গায়ে প্রায় লেগে থাকেন। আদালতে এত মামলার মূল কারণ রাজনৈতিক হয়রানি ও পুলিশের অনৈতিক ঘুষ বাণিজ্য।

বিশ্ব কভিড-১৯-এর ছোঁয়াচে সংক্রমণ বিবেচনায় নিয়ে উচিত হবে ৭০ শতাংশ অভিযুক্তের ২০৫ ধারায় কোর্টে উপস্থিতি থেকে রেহাই দেওয়া, যত দিন না মামলার চূড়ান্ত শুনানি শুরু হয়। দ্বিতীয়ত, অন্যদের ক্ষেত্রে সব মামলার শুনানি ও উপস্থিতির জন্য তিন মাস অন্তর তারিখ দেওয়া।

ঘ. রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বাড়ানো প্রয়োজন : রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো অত্যন্ত জনাকীর্ণ এবং ক্যাম্পে সাধারণ জীবনযাপনের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই। রোহিঙ্গারা যেন ক্যাম্পের বাইরে না আসে, সেদিকে যেমন লক্ষ রাখতে হবে, একইভাবে স্থানীয় জনসাধারণের ক্যাম্পে প্রবেশ সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

২. মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা খোলা থাকবে, তবে—

উপাসনালয়ের প্রবেশপথে ভক্তদের ছয় থেকে ১০ ইঞ্চি দূর থেকে ইনফ্রারেড থার্মোমিটার দিয়ে তাপমাত্রা নির্ণয় করা উপযুক্ত কাজ হবে। খুতবায় কভিড-১৯ সম্পর্কে ভক্তদের তথ্য দিতে হবে, গুজব না ছড়িয়ে বা গুজবে কান না দিয়ে পাড়া-পড়শিদের বিদেশ প্রত্যাগত আত্মীয়-স্বজনকে ১৪ দিন আলাদা রাখার পরামর্শ দিতে হবে। একইভাবে বাড়ির সবাইকে সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত ধোয়া ও কনুই পর্যন্ত ধুয়ে অজু করার পদ্ধতি অনুসরণ করতে অনুপ্রাণিত করতে হবে। হাত মেলানো ও আলিঙ্গন পরিহার করতে হবে, না ছুঁয়ে সালাম দেওয়ার অভ্যাস করতে হবে—হ্যান্ডশেক নয়, সালাম দিন।

৩. বাস-ট্রেন স্টেশন, বন্দর, বাজার ও লঞ্চঘাটে যাত্রীদের তাপমাত্রা পরীক্ষা করার উদ্যোগ নিন হাতে ধরা ইনফ্রারেড থার্মোমিটার দিয়ে। বাড়িতে ফিরে সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত ধোয়া এবং আলিঙ্গন, হ্যান্ডশেকের পরিবর্তে হাত তুলে সালাম দেওয়ার অভ্যাস করার চেষ্টা নিন।

৪. বিদেশ থেকে প্রত্যাগত নাগরিকদের প্রতি সদয় ব্যবহার করুন

প্রবাসী বাংলাদেশিরা বাংলাদেশের সমৃদ্ধির জোগানদার। প্রায় এক কোটি প্রবাসীর মধ্যে ২৫ লাখ চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, ফার্মাসিস্ট, আইটি পেশাজীবী, শিক্ষক, ব্যবসায়ী স্থায়ীভাবে বিদেশে বসবাস করেন। তাঁরা তাঁদের উদ্বৃত্ত সম্পদ বিদেশে রাখেন। দেশে পাঠান না। বাকি প্রায় ৭৫ লাখ সাধারণ শ্রমজীবী প্রবাসী বাংলাদেশিরা ১০ মাসে ২০১৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশে পাঠিয়েছেন। পৃথিবীর প্রায় ১০০টি দেশে প্রবাসী বাংলাদেশিরা কঠিন শ্রম দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। প্রতি তিন-চার বছর পর পর তাঁরা স্ত্রী-পুত্র, পরিজন ও আত্মীয়দের দেখার জন্য দেশে ফেরেন ১০ থেকে ৪০ ঘণ্টা বিমানভ্রমণ করে।

কভিড-১৯ সংক্রমণ প্রতিরোধের নিমিত্তে বিমানবন্দরে পৌঁছার পর তাঁদের কোয়ারেন্টাইনে রাখা বিজ্ঞানসম্মত। তাঁরা যদিও ‘নবাবজাদার অভ্যর্থনা’ প্রত্যাশা করেন না, তবে সরকারের নৈতিক দায়িত্ব হবে যে তাঁদের ১৪ দিন আহার-বিশ্রামের জন্য পাঁচতারা অভ্যর্থনা ও সুযোগ-সুবিধা দেওয়া।

তাঁরা সারা দিন আত্মীয়-স্বজনের কাছে ফিরে যাচ্ছেন, তাঁদের আইসোলেশনের বৈজ্ঞানিক কারণ ভালোভাবে বুঝিয়ে দেওয়া, যাতে বাড়ির বাইরে ১৪ দিন ঘোরাফেরা না করেন। জরিমানা করা অমানবিক কাজ।

৫. সরকারি ব্যবস্থাপনা অনেক গুণ বাড়াতে হবে

পৃথিবীর সব দেশ কঠিন সমস্যায় পতিত হয়েছে, বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে দুর্বলতা হচ্ছে—হাসপাতাল, ক্লিনিক নামের অজস্র বিল্ডিং আছে; কিন্তু সেখানে পর্যাপ্ত জনবল নেই সরকারি ভুল নীতিমালার কারণে।

বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর-

‘Institute of Epidemiology, Disease Control, anud Reseach’-এ রিভার্স পলিসারজ চেইন রিঅ্যাকশন  (rrT-PCR) পরিচালনায় দক্ষ ৫০ জন ভাইরোলজিস্ট, এনটোমোলজিস্ট, মাইক্রোবায়োলজিস্ট নেই।

সব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ল্যাবরেটরিতে উন্নত মানের পিসিআর  (PCR) নেই। তদুপরি বাংলাদেশে মেডিক্যাল যন্ত্রপাতির ওপর অদ্ভুত ধরনের অতিরিক্ত শুল্ক ও বিবিধ ট্যাক্স প্রয়োগের নিয়ম প্রযোজ্য আছে। মেডিক্যাল শয্যার ওপর সর্বমোট ট্যাক্স হচ্ছে ৫৮ শতাংশ, গ্যাস অ্যানালিসিস, ভেন্টিলেটর, থার্মোমিটার অক্সিজেন সিলিন্ডারের ওপর ধার্য সর্বমোট শুল্ক হচ্ছে ৩১ শতাংশ। তদুপরি বিভিন্ন কর্মকর্তাকে খুশি করার জন্য অন্যান্য উপরি ব্যয় তো আছে।

সব মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি এবং প্রয়োজনীয় রি-এজেন্ট ও সামগ্রীর ওপর  ০% (জিরো ট্যাক্স) করা সরকারের আশু দায়িত্ব। সব প্রবেশপথে পর্যাপ্ত স্ক্যানার ছাড়াও কমপক্ষে ২০ থেকে ৩০টি হাতে ধরা ইনফ্রারেড থার্মোমিটারের ব্যবস্থা থাকা উচিত। তিন শিফটে কাজ হওয়ার মতো স্বাস্থ্যকর্মীর ব্যবস্থা রাখতে হবে।

পত্রিকান্তরে খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ভাণ্ডারে মাত্র এক হাজার ৭৩২ কভিড-১৯ রোগ-জীবাণু পরীক্ষার কিট আছে। আইইডিসিআর কভিড-১৯ শনাক্ত করার জন্য মাত্র ২৬৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করেছে, যা অত্যন্ত অপ্রতুল। যেকোনো একটি উপসর্গ থাকলেই চিন্তিত রোগীর নমুনা পরীক্ষা প্রয়োজন। প্রস্তুতি থাকতে হবে মাসে কয়েক লাখ সম্ভাব্য রোগীর নমুনা পরীক্ষার। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সাময়িকী দ্য ল্যানসেটে প্রকাশিত হয়েছে ডেঙ্গু রোগীদের মধ্যে কভিড-১৯ ভাইরাসের বিস্তৃতির তথ্য।

সরকারকে অনতিবিলম্বে আগামী এক মাসের মধ্যে এক লাখ চিকিৎসক ও দুই লাখ নার্স, টেকনিশিয়ান, প্যারামেডিক ও ফিজিওথেরাপিস্টকে কয়েক ঘণ্টা করে করোনা রোগের ধরন, উপসর্গের বিস্তৃতি, রোগ নির্ণয় পদ্ধতি ও প্রতিরোধক ব্যবস্থা, ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, আলিঙ্গন বা হ্যান্ডশেক না করে সালাম দেওয়ার অভ্যাস করা এবং সম্ভাব্য রোগীকে দেখে ভয়ে পালিয়ে না যাওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করতে হবে। শেখাতে হবে যে রোগীকে পরীক্ষা না করে পালানো রাসুলুল্লাহর মতে জিহাদের মাঠ থেকে পলায়নতুল্য। চিকিৎসক ও নার্সদের ভালো করে হাত না ধোয়া সম্পর্কে ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে একাধিক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল কয়েক বছর আগে।

৬. দেশীয় বিজ্ঞানীদের সহায়তা করুন, সম্মান দিন

সরকারি সহযোগিতা পেলে গণস্বাস্থ্য এক মাসের মধ্যে কভিড-১৯ নির্ণায়ক গণস্বাস্থ্য র‌্যাপিড ডট ব্লট (G-Rapid Dot Blot) বাজারজাত করবে। ড. বিজন কুমার শীল, যিনি সিঙ্গাপুরে ২০০৩ সালে সার্স ভাইরাস নির্ণায়ক—র‌্যাপিড ডট ব্লট উদ্ভাবক দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন। তিনি বর্তমানে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণস্বাস্থ্য অধ্যাপক ও ফার্মাসিউটিক্যালসের প্রধান বিজ্ঞানী। ড. বিজন কুমার শীল ও তাঁর তিনজন সহকারী ড. নিহাদ আদনান, ড. ফিরোজ আহমদ ও ড. বায়জিদ, জমির উদ্দীন গণস্বাস্থ্য ল্যাবরেটরিতে অ্যান্টিবডি এসেজ (ইমমিউনোগ্লোবিন-এ, ইমমিউনোগ্লোবিন-জি ও ইমমিউনোগ্লোবিন-এম ইমমিউনোত্রসেজ) পদ্ধতি ব্যবহার করে কভিড-১৯ ভাইরাস নির্ণায়ক পদ্ধতি র‌্যাপিড ডট ব্লট উদ্ভাবন করেছেন। সরকার দ্রুত বিভিন্ন করোনাভাইরাস অ্যান্টিবডি, নিউ ক্লোপ্রোটিন, স্পাইন গ্লাইকোপ্রোটিন, করোনাভাইরাস এনভেলাপ প্রোটিন প্রভৃতি ইংল্যান্ড থেকে সংগ্রহের অনুমতি দিলে বাজারজাতকরণের জন্য পর্যাপ্ত র‌্যাপিড ডট ব্লট প্রস্তুত হবে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে। প্রতিটির উৎপাদন খরচ হবে ২০০ টাকা, সরকার শুল্ক, বিভিন্ন প্রকার ট্যাক্স ও ভ্যাট মওকুফ করে দিলে জনগণ মাত্র ৩০০ টাকায় পরীক্ষা করে কভিড-১৯ সংক্রমণ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারবে।

পিসিআর পদ্ধতি অত্যন্ত ব্যয়বহুল বলে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ভিজিট কন্ট্রোল র‌্যাপিড ডট ব্লট উদ্ভাবনের উদ্যোগ নিচ্ছে এবং গণস্বাস্থ্যের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

শেষ কথা, সঠিক তথ্য দিন, গুজব ছড়াবেন না, বাংলাদেশের জনগণের ওপর আস্থা রাখুন। চিকিৎসক স্বাস্থ্যকর্মীসহ সবাই সাবান দিয়ে বারবার হাত ধোয়ার অভ্যাস করুন। হ্যান্ডশেক নয়, সালাম দিন। ‘আল্লাহর আজাব’ থেকে নিশ্চয়ই সবাই মুক্তি পাবেন।

No comments:

Post a Comment