সাক্ষাৎকার (Interview) কি শুধু মৌখিক কথাবার্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ? কিছু প্রশ্নের উত্তর ঝটপট বলে ফেলা ও নিজের জ্ঞানের গভীরতাকে প্রশ্নকর্তার কাছে জাহির করাটাই একটি সফল সাক্ষাৎকার বলে না। বরং শব্দহীন আচার আচরণ, প্রস্তুতি আর উপস্থাপনার মাঝেও ইন্টারভিউয়ের সফলতা নির্ভর করে। অনেকে মনে করেন চাকরির সাক্ষাৎকারের সফলতার জন্য প্রশ্নের উত্তরগুলো পারার ওপরই সব সফলতা নির্ভর করে। কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়। বরং চাকরির সাক্ষাৎকারের সফলতার জন্য একটি বড় অংশ হলো শব্দহীন বা অমৌখিক যোগাযোগ। ইংরেজিতে যাকে বলে Nonverbal Communication. কথা বলার মধ্যেও শারীরিক ভাষা, স্বরভঙ্গি, কথার গতি, মুখের অভিব্যক্তি, বিরতি, শ্বাস ও মুদ্রাদোষ গুরুত্বপূর্ণ। অশাব্দিক যোগাযোগ রক্ষার মধ্যে পোশাক ও সাজগোজও গুরুত্বপূর্ণ।
কেন অশাব্দিক যোগাযোগ গুরুত্বপূর্ণ?
অশাব্দিক যোগাযোগ গুরুত্বপূর্ণ এমনকি অনেক সময় সাক্ষাৎকারের মৌখিক অংশের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। একজন সাক্ষাৎগ্রহণকারী সাক্ষাৎ সময়ের পুরো সময় জুড়ে ইন্টারভিউ প্রদানকারীর শব্দহীন যোগাযোগ ও আচরণগুলো লক্ষ্য করেন। মৌখিক উত্তরগুলো যতই ভালো হোক তার Nonverbal Communication-এর দক্ষতাগুলো যদি সন্তোষজনক না হয় তবে কাঙ্ক্ষিত সফলতা নাও আসতে পারে। ইন্টারভিউ প্রদানকারী যখন অফিসের গেটে প্রবেশ করেন তখনই Nonverbal Communication ইন্টারভিউ শুরু হয়ে যায়। সিগারেট খেতে খেতে কিংবা চুইংগাম চিবাতে চিবাতে গেট দিয়ে প্রবেশ করাটা Nonverbal Communication-এর বিপরীত কাজ। অনেক সময় অতিরিক্ত সুঘ্রাণ ব্যবহার কিংবা সঠিক পোশাক না পরিধান করাও সাক্ষাৎকারে প্রভাব রাখে। আবার এমনটিও দেখা যায় ইন্টারভিউ প্রদানকারী যখন সাক্ষাৎকারের জন্য রুমে অপেক্ষা করছেন তখন মোবাইলে কারও সঙ্গে কথা বলছেন কিংবা হেডফোনে গান শুনছেন যা তার সাক্ষাৎকারের জন্য নেতিবাচক ভূমিকা রাখে। সুতরাং সাক্ষাৎকারে Nonverbal Communication-কে সফল করতে এই বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে।
করণীয়
সাক্ষাৎকারে Nonverbal Communication-কে সফল করতে হলে সাক্ষাৎকারের আগে ও পরে কিছু করণীয় আছে। যেমন সাক্ষাৎকারের আগে পেশাধারী পোশাক পরা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হওয়া, ভালো জুতা পরা, অতিরিক্ত সুগন্ধি ব্যবহার না করা। সাক্ষাৎকারে সময় কিছু জিনিস নিজের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের জন্য নিয়ে আসা এবং কিছু জিনিস বাসায় রেখে আসা। এই বিষয়গুলো ইন্টারভিউ প্রদানকারীর Nonverbal Communication-কে উন্নত করবে।
যে জিনিসগুলো সঙ্গে নিয়ে আসা প্রয়োজন
*কয়েক কপি রেজুমি (RESUME)।
*কয়েকজন রেফারেন্সের লিস্ট (প্রোফেশনাল)।
*কাজের নমুনা কপি (যদি থাকে)।
*নোটপ্যাড ও কলম।
*ব্রেথ মিন্ত (ভবনে প্রবেশের পূর্বে চিবিয়ে আসা। যাতে কথা বলার সময় মুখ থেকে গন্ধ না আসে)।
*একটি ফোল্ডার (সকল কাগজপত্র তথা রেজুমি, রেফারেন্সের লিস্ট, নোটপ্যাড ও কলম রাখার জন্য)।
*কয়েকটি টিসু।
যে জিনিসগুলো সঙ্গে আনা উচিত নয়
*মোবাইল (যদি প্রয়োজনে আনতে হয় তবে ভবনে প্রবেশের আগে বন্ধ করা)
*আইপ্যাড বা আইপড।
*গাম, ক্যানডি, সিগারেট ও সোডা বা কফি।
*পলিসবিহীন জুতা ও অপরিচ্ছন্ন পোশাক।
যখন আপনি সাক্ষাতের জন্য অপেক্ষা করবেন
দেখুন যেভাবে আপনি সাক্ষাতের জন্য অপেক্ষা করবেন, অভ্যর্থনাকারী বা সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর সঙ্গে কুশল বিনিময় করবেন এই সবই সাক্ষাৎকারের অংশ। এ সব সাক্ষাৎকারের সফল হওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বন্ধুত্বসুলভ ও অমায়িক হোন কিন্তু অতিরিক্ত করবেন না। যখন অপেক্ষা করবেন তখন ধৈর্যশীল হয়ে নীরবে অপেক্ষা করুন। মোবাইল ফোনে কথা বা গান শুনবেন না। অপেক্ষা করার সময় যদি আপনার হাত, মুখ ঘেমে যায় তবে রেস্ট রুমে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে মুছে নিন। হ্যান্ডশেক করার সময় হাতকে অতিরিক্ত শক্ত বা নরম করতে যাবেন না বরং স্বাভাবিক রাখুন।
সাক্ষাৎকারের সময় করণীয়
সাক্ষাৎকারের সময় প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ছাড়াও কিছু জিনিস করণীয় রয়েছে। মূলত এই সবগুলো সঠিকভাবে করতে পারার মধ্যে সাক্ষাৎকারের সফলতা নিহিত। করণীয়গুলোর মধ্যে রয়েছে—
*সময়ে সময়ে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর চোখে চোখ রাখা।
*সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী কথা বলার সময় মুখে হাসি ভাব রাখা। কিন্তু এটা যেন অতিরিক্ত না হয়। জোরে হাসতে যাবেন না যদি না সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর কোনো কিছু নিয়ে নিজ থেকে প্রথমে হাসির উদ্রেক সৃষ্টি না করেন।
*কথা ও উপস্থাপনার মধ্যে বিনয়ী ভাব রাখুন। খুব জোরে বা খুব আস্তে কথা বলবেন না।
*সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময়ে নিজেকে আগ্রহী ও সংযুক্ত রাখুন। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসবেন না বরং কিছুটা এগিয়ে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর দিকে মনোযোগী হয়ে বসুন।
*জবুথবু হয়ে বসবেন না। পা মাটিতে রেখে এবং আপনার মেরুদণ্ডকে চেয়ারের শেষ অংশে রেখে সোজা হয়ে বসুন।
*সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর প্রতি পূর্ণ মনোযোগ রাখুন। প্রয়োজনে তার কথার নোট নিতে পারেন।
*সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী যখন কথা বলে মনোযোগ দিয়ে শুনুন। তার কথার মাঝখানে কথা বলবেন না।
*নিজেকে শান্ত ও স্থির রাখুন। কোনো বিষয়ে নিজের রাগ প্রকাশ করতে যাবেন না।
সাক্ষাৎকার শেষে করণীয়
সাক্ষাৎকার শেষে মুখে হাসি রাখুন এবং সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর সঙ্গে দৃঢ় হ্যান্ডশেক করে বের হোন। আসার পথে প্রথমে যাদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল যেমন অভ্যর্থনাকারী, অন্যান্য অফিস স্টাফদের বিদায়ী শুভেচ্ছা জানিয়ে আসুন।
কিছু অমৌখিক যোগাযোগের দক্ষতার উদাহরণ
নিচে কিছু অমৌখিক যোগাযোগের দক্ষতার উদাহরণ দেওয়া হলো যেগুলো আপনি ব্যক্তিগতভাবে কিংবা ক্যারিয়ার ক্লাবে চর্চা করে নিজেকে একজন সফল সাক্ষাৎকারের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন।
*সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর প্রতি মনোযোগী হওয়া এবং মনোযোগ সহকারে শোনা।
*সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর কথার মাঝে কথা না বলা।
*একটু সামনের দিকে হেলে বসা যাতে বোঝা যায় আপনি আন্তরিক ও মনোযোগী।
*মাথায় ও মুখে হাত না রাখা।
*অনর্থক হাত-পা না নাড়ানো।
*কথাবার্তার প্রতি পূর্ণ মনোযোগী থাকা।
*সঙ্গে ফোন না নিয়ে আসা যা আপনার মনোযোগকে বিঘ্নিত করতে পারে।
*নিজের পরিচয় দেওয়ার সময় মুখে হাসি রাখা এবং দৃঢ় হ্যান্ডশেক করা।
*নিজের কণ্ঠের মাঝে বিনয়ী ও ভদ্র ভাব রাখা।
*সাক্ষাৎ গ্রহণের সময়ে ঘড়ি, ফোন ও অন্যান্য ডিসপ্লের প্রতি না তাকানো।
*সাক্ষাৎকার গ্রহণকালে যদি একাধিক ব্যক্তি থাকেন তবে সকলের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করা।
*যখন সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন তখন মুখের হাসি ভাব দূর করে তার কথার গুরুত্ব অনুধাবন করা।
*আপনার উত্তরে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর প্রতিক্রিয়া অনুধাবন করা।
*নিজেকে পেশাধারী রূপে উপস্থাপন করা।
মৌখিক সাক্ষাৎকার যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি মৌখিক সাক্ষাৎকারকে সফল করতে Nonverbal Communicationও গুরুত্বপূর্ণ। আশা রাখি সঠিক চর্চা ও উপস্থাপনা আপনার সাক্ষাৎকারকে সফল করবে।
লেখক: আ হ ম করিম, নিউইয়র্ক (যুক্তরাষ্ট্র) |
© প্রথম আলো
No comments:
Post a Comment