ককাটেল পাখি পালন লাভজনক ও সৌ‌খিন

ককাটেল (Cockatiel) হলো কাকাতুয়া পরিবারের একটি পাখি। ককাটিয়েলকে ক্যারিওন এবং উইরো নামেও ডাকা হয়। আমা‌দের দেশে এটি 'ককাটেল' বা 'ককাটেল পাখি' নামেই বেশি পরিচিত। ককাটিয়েল মূলত অস্ট্রেলিয়া অঞ্চলের এন্ডেমিক প্রাণী; এর বৈজ্ঞানিক নাম Nymphicus hollandicus। বন্য প্রজাতি হিসেবে একে অস্ট্রেলিয়া ছাড়া কোথাও পাওয়া না গেলেও বিশ্বব্যাপি এটি খাঁচায় পোষা গৃহপালিত পাখি হিসেবে পালিত হয়। সহজে বাচ্চা উৎপাদন, সৌন্দর্যের জন্য এটি বাজিরিগারের পরে খাঁচায় পোষা দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রজাতি ।

পাখি প্রেমিকদের কাছে অত্যন্ত পছন্দের পাখি ককাটেল। আদুরে ককাটেল এর সৌন্দর্যের জন্য খুবই বিখ্যাত। বন্য ককাটেল ধূসর বর্ণের হয়।

সৌখিন পাখি পালকদের দীর্ঘদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে এদের এখন এদের অনেক মিউটেশনের সৃষ্টি হয়েছে। এদের মধ্যে লুটিনো, ফন, গ্রে, রুবিনো, হোয়াইট ফেস, সিলভার প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। মাথায় ঝুটি দেখে এ পাখিকে সহজেই অন্য পাখি থেকে আলাদা করা যায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে ককাটেলের মেল এবং ফিমেল পাখি দেখতে হুবহু একই রকম। আপনি যদি অভিজ্ঞ ব্রিডার না হন তবে, এদের শনাক্ত করতে বেশ ঝামেলাই পোহাতে হবে আপনাকে। শুধু পাখি চেনাই নয় এদের খাবার দাবার, পালন পদ্ধতি কিংবা ব্রিডিং কৌশল জানার জন্য অভিজ্ঞ ককাটেল পালকদের পরামর্শ নেয়া উচিত।

জীবনকাল
খাঁচাবন্দি ককাটেল সাধারণত ১৬ থেকে ২৫ বছর বাঁচে । রেকর্ড অনুযায়ী কিছু কিছু ক্ষেত্রে ককাটেল ১০ থেকে ১৫ বাঁচে; ককাটেলের ৩২ বছর বেঁচে থাকারও রেকর্ড আছে । একটি ককাটেল পাখি অবশ্য ৩৬ বছর বেঁচে ছিল । এগুলো সাধারণত নির্ভর করে খাবার, পরিবেশ আর ওড়ার জায়গার উপর ।

বাসস্থান ও বিস্তরণ
ককাটেল অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয় পাখি । যেসব অঞ্চলে মরু, বিস্তৃত অনুর্বর ভূমি বা কিছুটা শুস্ক বিস্তীর্ণ ভূমি আছে, সেসব অঞ্চলে এদের বেশি দেখা গেলেও সবসময় পানির কাছাকাছি থাকে । এরা যাযাবর শ্রেণীর পাখি । যেখানে খাবার আর পানির প্রাচুর্য, সেখানে এরা উড়ে যেতে সময় নেয় না । প্রকৃতিতে ককাটেলকে সাধারণত জোড়া বা ছোট ঝাঁক হিসেবে পাওয়া যায় । অনেক সময় অনেকগুলো ককাটেলকে একসাথে ঝাঁক বেঁধে পানি খেতে দেখা যায় । অনেক কৃষকের কাছে এরা মূর্তিমান আতঙ্ক । এরা প্রায়ই ক্ষেতে হামলা করে চাষ করা ফসল খেয়ে আসে । অস্ট্রেলিয়ার অতি উর্বর দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে, সুবিশাল ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ান মরুভূমিতে এবং কেপ ইয়র্ক পেনিনসুলা উপদ্বীপে এরা অনুপস্থিত । ককাটেল একমাত্র কাকাতুয়া প্রজাতি যারা কিছু কিছু ক্ষেত্রে জন্মের প্রথম বছরের শেষের দিকেই বাচ্চা দেয়া শুরু করে দেয় ।

দৈন‌ন্দিন খাবার তা‌লিকা
নবীন  ব্রিডারদের যাতে ককাটেল পালন সহজ হয় তাই এদের প্রতিদিনের খাবারের একটি তালিকা দেয়া হলঃ
১| সীড মিক্স
২| যেকোনো ১ টি শাক / পাতা : পালং / কলমি /পুদিনা পাতা / সজনে পাতা / নিম পাতা / লাল শাক / ধনে পাতা ইত্যাদি
৩| যেকোনো ১ টি সবজি : এসপারাগাস/ ব্রকোলি/ বরবটি/বাধা কপি/ মিষ্টি কুমড়া/ ঝিঙ্গা / চিচিঙ্গা/শসা/সজনে ডাটা /মটরশুটি/সীম/ সীম এর বিচি/ কাচা পেপে/ পটল/ ঢেঁড়শ
৪| যেকোনো ১ টি ফল : আপেল / স্ট্রবেরি/ ফুটি / তরমুজ/ পেপে/ নাশপাতি/ পেয়ারা /কামরাঙ্গা/ আমড়া
৫| কাটল ফিশবোন্ (সাগরের ফেনা)
৬| ফুটানো এবং ফিল্টার করা টাটকা পানি : সকালে ১ বার & সন্ধায় ১ বার বদলে দিবেন
৭| সজনে পাতা লিফ – সাপ্তাহিক 2 দিন (এতে প্রচুর পরিমানে ক্যালসিয়াম , প্রোটিন, সবরকমের ভিটামিন ও মিনারেল আছে)
৮| অঙ্কুরিত বীজ – সাপ্তাহিক ২ দিন
৯| সেদ্ধ বুটের ডাল – সাপ্তাহিক ২ দিন
১০| শুকনো কুমড়ো বীজ – সাপ্তাহিক ২ দিন
১১| ঘৃতকুমারী টুকরা – সাপ্তাহিক ২ দিন
১২| সপ্তাহে ১ বার অথবা চিকিত্সার প্রয়োজন অনুযায়ী – তুলসী দ্রবণ (ঠান্ডায়), অ্যালোভেরা /ঘৃতকুমারী দ্রবণ (গরমে, হজম & পালকের সমস্যায়)| সকাল থেকে ৬ ঘন্টা রেখে এরপর বদলে দিয়ে সাধারণ পানি দিবেন|

* শাক সবজি ফল দেয়ার আগে সবসময় বড় একবাটি পানিতে ভালমত ধৌত করবেন|
* ফল দেয়ার আগে বিচি ফেলে দিবেন|
ককাটিয়েল পাখির সীডমিক্স অনুপাত
চিনা ৩ কেজি, কাউন ১ কেজি ৫০০ গ্রাম, সূর্যমুখী বীজ ২৫০ গ্রাম, পোলাও চালের ধান ১ কেজি ৫০০ গ্রাম, ক্যানারি ১ কেজি, গুজি তিল ২৫০ গ্রাম।
সীডমিক্স অবশ্যই ভালো করে ধুয়ে টানা ৩ দিন কড়া রোদে ভালো করে শুকিয়ে নিতে হবে।
শাক সবজিঃ এসপারাগাস (বাংলায় শতমূলী), ব্রকোলি, গাজর, বরবটি, সবুজ শাক সবজি (বাধাকপি, পালং শাক, কলমি শাক,লেটুস পাতা প্রভৃতি), মটর, মরিচ(যেকোনো রঙ সবুজ কিংবা লাল) ,   মিষ্টি কুমড়াঝিঙ্গা / চিচিঙ্গা,শসা।
ফলঃ আপেল, কলা, জাম জাতীয় রসালো ফল (ব্ল্যাক বেরি/ কালো জাম, ব্লুবেরি, ক্রানবেরি,  রাজবেরি, স্ট্রবেরি), ফুটি / খরমুজ, চেরি ফল, আঙ্গুর, লেবু,আম, তরমুজ,  কমলা, পেপে, পিচ, নাশপাতি, পেয়ারা।

প্র‌য়োজনীয় টিপস্
স্ত্রী ককাটেল ৮- ১০ বছর এবং পুরুষ ১২-১৪ বছর পর্যন্ত বাচ্চা উৎপাদনে সক্ষম থাকে। ককাটেল পাখির বয়স ১ বছর না হলে তাদের ব্রিডিং এ আনা উচিত নয়। পাখির জোড়ায় কম অভিজ্ঞতা এবং কম বয়সের কারণে ব্রিডিং এ দুঃখ জনক ঘটনা ঘটতে পারে। যেমন, ডিম ভেঙ্গে ফেলা , ডিমের তা হতে সরে যাওয়া ইত্যাদি। তাই ককাটেল ব্রিডিং এ বয়স নির্বাচনটা খুবই জরুরী।
পাখির অনুৎপাদনশীল হওয়ার কারণে হতে পারে অপুষ্টি , অযত্ন, আচরণগত ও পরিবেশগত সমস্যা। গোসল করার জন্য পানির অভাব, ছানাদের খাবারের জন্য নরম খাবারের অভাব ইত্যাদি কারণ এ পাখির ব্রিডিং ও ছানা করা ব্যাহত হতে পারে। তাই ককাটেল ব্রিডিং এ আমাদের উচিত হবে সবসময় সতর্ক দৃষ্টি রাখা এবং অভিজ্ঞ ব্রিডারদের সাথে সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা।

No comments:

Post a Comment