বিশ্বপ্রভু তাঁর প্রিয় হাবিবকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম ও সর্বগুণে গুণান্বিত করে সৃষ্টি করেছেন। তাঁর শারীরিক গঠন, কথা-বার্তা, কাজ-কর্ম ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে কারো তুলনা নেই।
বরং তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। আল্লাহ তাআলা তাঁর গুণাবলি বর্ণনা করে বলেছেন, ‘অবশ্যই তুমি নীতি-নৈতিকতা ও উত্তম চরিত্রের সর্বোচ্চ শিখরে প্রতিষ্ঠিত। ’ তিনি আরো ইরশাদ করেন, ‘অবশ্যই আল্লাহর রাসুলের মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য সর্বোত্কৃষ্ট আদর্শ। ’ এ হিসেবে মহানবী (সা.)-এর সব কথাবার্তা ও কাজ-কর্ম মুমিনের জন্য আদর্শ ও অনুকরণীয় বিষয় (Model)। তিনি রুক্ষ ও কর্কশ মেজাজের ছিলেন না, কখনো অশ্লীল ও মন্দ কথা বলতেন না। রাজা-বাদশাহ ও নেতাদের মতো গম্ভীর হয়ে বসে থাকতেন না। বরং হাস্যরসের কথায় হাসতেন ও কৌতুক করতেন। কারণ হাস্যরস ও কৌতুক অন্তরের কূটিলতা ও দুশ্চিন্তা দূরীভূত করে দেয়।
মহানবী (সা.)-এর কৌতুক একটি নেয়ামত এবং উম্মতের জন্য উত্তম পাথেয়।
কৌতুক করা শরিয়তসম্মত ও বিশ্বনবী (সা.)-এর সুন্নত। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, সাহাবায়ে কেরাম মহানবী (সা.)-কে রসিকতা করতে দেখে বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি আমাদের সঙ্গে হাসি-তামাশার কথাও বলেন! তিনি বলেন, তবে হ্যাঁ, আমি কোনো অসত্য ও প্রকৃত ঘটনার বিপরীত কিছু বলি না। (তিরমিজি, মিশকাত, পৃষ্ঠা ৪১৬) হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন—রাসুলুল্লাহ (সা.) খোলামেলাভাবে আমাদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন। এমনকি তিনি আমার ছোট ভাই, যার নাম ছিল উমাইর, তার সঙ্গে কৌতুক করে বলেন, হে উমাইর! তোমার নুগাইর কোথায়? উমাইরের একটি ছোট নুগাইর তথা পাখি ছিল। উমাইরের সেই পাখিটি মারা গিয়েছিল। সে এই পাখিটি নিয়ে খেলা করত। (বুখারি ও মুসলিম) পাখিটির মৃত্যুতে উমাইর চিন্তিত ছিলেন বলে মহানবী (সা.) এ কথা বলে তাঁর সঙ্গে রসিকতা করেছেন।
মহানবী (সা.) একদা স্নেহের কন্যা হজরত ফাতেমা (রা.)-এর বাড়িতে গিয়ে জামাতা হজরত আলী (রা.)-কে রাড়িতে না দেখে কন্যাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমার সঙ্গে বাগিবতণ্ডা করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছেন। মহানবী (সা.) মসজিদে নববীতে গিয়ে সেখানে দেখেন, হজরত আলী (রা.) একটি চাদর ঘায়ে জড়িয়ে এমনভাবে শুয়ে আছেন যে তাঁর অর্ধেক দেহ মসজিদে আর অর্ধেক মাটিতে। তখন তিনি কৌতুক করে বলেন, উঠো! হে আবু তোরাব (মাটির পিতা)! এর পর থেকে হজরত আলী (রা.)-এর উপনাম হয়ে যায় আবু তোরাব। (বুখারি) মহানবী (সা.) একদা হজরত আবদুর রহমান (রা.)-এর বাড়িতে গিয়ে দেখতে পান যে তাঁর কোলে বিড়ালের বাচ্চা, তখন তিনি রসিকতা করে বলেন—হে আবু হুরায়রা (বিড়ালছানার পিতা)! এর পর থেকে হজরত আবদুর রহমান (রা.) এই উপনামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। জাহের ইবনে হারাম (রা.) নামে এক গ্রাম্য সাহাবি রাসুল (সা.)-কে গ্রামের জিনিস উপহার দিতেন। তিনিও তাঁকে শহরের জিনিস উপহার দিতেন। রাসুল (সা.) উপহাসের ছলে রসিকতা করে বলতেন, জাহের আমার গ্রাম্য বন্ধু আর আমি তার শহুরে বন্ধু। মহানবী (সা.) তাঁকে ভালোবাসতেন। জাহের ছিলেন কৃষ্ণকায় ব্যক্তি। একদিন তিনি মদিনায় প্রামের জিনিসপত্র বিক্রি করতেছিলেন, তখন মহানবী (সা.) পেছন দিক দিয়ে এসে তাঁকে জাপটে ধরেন। জাহের রাসুল (সা.)-কে দেখতে না পেয়ে বললেন—তুমি কে? আমাকে ছেড়ে দাও। জাহের চেহারা ফিরিয়ে প্রিয় নবী (সা.)-কে দেখতে পেয়ে নিজ দেহ প্রিয়নবী (সা.)-এর দেহ মুবারকের সঙ্গে লাগানোর চেষ্টা করেন। রাসুল (সা.) বলতে লাগলেন, এ গোলামকে কে কিনবে? আমি একে বিক্রি করব। জাহের বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমাকে সস্তায় বিক্রি করতে হবে। কারণ আমি কালো কুিসত। রাসুল (সা.) বললেন, তুমি সস্তা নও, আল্লাহর কাছে অনেক দামি। তা ছিল রাসুল (সা.)-এর রসিকতা। কারণ জাহের গোলাম ছিলেন না। (তিরমিজি, মিশকাত, পৃষ্ঠা ৪১৬)
রাসুলুল্লাহ (সা.) হাসতেন, তবে তা ছিল মুচকি হাসি। একজন দরিদ্র ও বৃদ্ধ সাহাবি স্বীয় স্ত্রীর সঙ্গে জেহার করেন। জেহার হলো—যাদের বিবাহ করা হারাম, তাদের কোনো পূর্ণ অঙ্গের সঙ্গে স্ত্রীর কোনো অঙ্গের তুলনা করা। এরূপ তুলনা করলে কাফ্ফারা দিতে হয়। সাহাবি যখন জেহার করেছেন বলে দাবি করেছেন, তখন রাসুল (সা.) তাঁকে বললেন, তুমি একাধারে ষাটটি রোজা রাখো। সাহাবি বললেন, আমার রোজা রাখার শক্তি নাই। তখন রাসুল (সা.) বললেন, তাহলে তুমি ষাটজন মিসকিনকে আহার করাও। সাহাবি বললেন, আমার এই সামর্থ্যও নেই। রাসুল (সা.) বললেন, তাহলে একজন গোলাম আজাদ করে দাও। সাহাবি বললেন, আমার কাছে গোলাম ক্রয়ের অর্থ নেই। মহানবী (সা.) বললেন, তাহলে একটু অপেক্ষা করো। একটু পরে একজন সাহাবি একটি পাত্রে করে খেজুর নিয়ে এলেন। রাসুল (সা.) তাঁকে বললেন, এ খেজুরগুলো নিয়ে যাও এবং তোমার আশপাশের দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করে দাও। সাহাবি বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমার আশপাশে আমার চেয়ে দরিদ্র আর কেউ নেই। তখন রাসুল (সা.) হাসেন এবং বলেন, তুমি তা খেয়ে ফেলো। এটাই তোমার কাফ্ফারা।
হজরত আনাস (রা.) ছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর একান্ত খাদেম। তিনি অল্প বয়স থেকে তাঁর খেদমত শুরু করেন। মহানবী (সা.) একদা তাঁকে একটি কাজের জন্য প্রেরণ করেন, কিন্তু বালক আনাস (রা.) মহানবী (সা.)-এর নির্দেশের কথা ভুলে গিয়ে অন্য বালকদের সঙ্গে খেলায় মত্ত হয়ে যান। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সা.) আনাস (রা.)-এর খোঁজে বের হন। অতঃপর গিয়ে দেখেন, বাজারে আনাস (রা.) অন্য ছেলেদের সঙ্গে খেলা করছেন। রাহমাতুল্লিল আলামিন (সা.) হজরত আনাস (রা.)-এর দিকে তাকিয়ে কিছু না বলে হাসতে থাকেন। হঠাৎ করে আনাস (রা.)-এর নজর রাসুল (সা.)-এর দিকে পড়লে তিনি হতবাক হয়ে যান। রাসুল (সা.) জিজ্ঞেস করেন, আনাস তুমি কি কাজটি করেছ? আনাস (রা.) বলেন—যাচ্ছি হে আল্লাহর রাসুল! (মুসলিম, মিশকাত, পৃষ্ঠা ৫১৮) হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, বিশ্বনবী (সা.) একদিন কোনো এক জরুরি কাজে যাচ্ছিলেন, তাঁর গায়ে ছিল নাজরানি চাদর। তখন একজন বেদুইন রাসুল (সা.)-কে দেখে তাঁর চাদর ধরে জোরে টান দিয়ে বলল, আমাকে আপনার মাল থেকে দেওয়ার নির্দেশ দিন। হাদিস বর্ণনাকারী আনাস (রা.) চাদরের দাগ রাসুল (সা.)-এর গলা মুবারকে প্রত্যক্ষ করছিলেন। কিন্তু বিশ্বনবী কিছু না বলে প্রচণ্ড ব্যথা সহ্য করে বেদুইনের দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকেন এবং তাকে মাল প্রদানের নির্দেশ দেন। (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত, পৃষ্ঠা ৫১৮)
হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, বাসুল (সা.) তাঁকে রসিকতা করে বলেছেন, হে দুই কানওয়ালা! তাঁর কর্ণদ্বয় তুলনামূলক বড় ছিল অথবা তিনি কানে অধিক শুনতেন বলে এ উপাধিতে ভূষিত করেন। (তিরমিজি) হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি মহানবী (সা.)-এর খেদমতে হাজির হয়ে একটি বাহনের আবেদন করল। মহানবী (সা.) তাঁকে বললেন, আমি তোমাকে একটি উষ্ট্রছানা দেব। লোকটি বলল, হে আল্লাহর রাসুল! উষ্ট্রছানা দিয়ে আমি কী করব? আমার তো এমন উটের প্রয়োজন, যার ওপর আমি আরোহণ করতে পারি। রাসুল (সা.) বললেন, ওহে শোনো! প্রত্যেক উটই তো কোনো না কোনো উষ্ট্রীর ছানা। (তিরমিজি)
হজরত হাসান বসরি (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.)-এর খেদমতে এক বৃদ্ধা এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমার জন্য দোয়া করুন যেন আল্লাহ আমাকে জান্নাত দান করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, জান্নাতে কোনো বৃদ্ধা প্রবেশ করতে পারবে না। মহানবী (সা.)-এর কাছে এ কথা শুনে বৃদ্ধা কেঁদে কেঁদে নিরাশ হয়ে ফিরে চললেন। মহানবী (সা.) তখন উপস্থিত সাহাবিদের বললেন, তাকে বলে দাও, সে বৃদ্ধা অবস্থায় জান্নাতে প্রবেশ করবে না। আল্লাহ তাআলা সব জান্নাতি মহিলাকে চিরকুমারী হিসেবে সৃষ্টি করবেন। যেমন আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আমি ওই সব নারীকে এক বিশেষ অবয়ব দিয়ে সৃষ্টি করেছি। অর্থাৎ তাদের কুমারী বানিয়েছি। সহবাসের পর পুনরায় তাদের কুমারীত্ব ফিরে আসবে। ’ (তিরমিজি)
একদিন জামাই-শ্বশুর—মানে নবী (সা.) ও আলী (রা.) একসঙ্গে বসে খেজুর খাচ্ছিলেন। নবী (সা.) খেজুর খেয়ে আঁটিগুলো আলী (রা.) যেখানে আঁটি রাখছিলেন সেখানে রাখছেন। একপর্যায়ে রসিকতা করে নবী (সা.) বললেন, আলী, তোমার দেখছি খুব খিদে পেয়েছে! তোমার পাশে দেখছ তো অনেক খেজুরের আঁটি! জামাইও ছাড়ার পাত্র নন। নবী (সা.)-কে লক্ষ্য করে আলী (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমার চেয়ে দেখছি আপনার অনেক বেশি খিদে পেয়েছে! কারণ আমি তো আঁটি ফেলে দিচ্ছি, কিন্তু আপনি তো আঁটিসমেত খেজুর খেয়ে ফেলছেন। এ কথার পর জামাই-শ্বশুর সমস্বরে হো হো করে হেসে উঠলেন।
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, হাদিসে হাস্যরস করতে নিষেধ করা হয়েছে। ইমাম নববী (রহ.) উভয় প্রকার হাদিসের মাঝে সামঞ্জস্য বিধান করে বলেন, যে কৌতুক ও হাস্যরস অন্তরে কাঠিন্য সৃষ্টি করে অথবা আল্লাহর জিকির ও স্মরণ থেকে গাফিল রাখে কিংবা কোনো মুসলমানের কষ্টের কারণ হয় বা গাম্ভীর্য দূর করে দেয়, এরূপ হাস্যরস ও কৌতুক বৈধ নয়। অন্যথায় মনকে প্রফুল্ল করার উদ্দেশ্যে হাস্যরস ও কৌতুক করা শুধু জায়েজ নয়, বরং মুস্তাহাব।
মুফতি মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম
প্রধান ফকিহ, আল জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী।
No comments:
Post a Comment