পা‌য়ের ব্লক: সতর্কতা ও চি‌কিৎসা

‌বিষয়ঃ পায়ের ব্লক কী, কেন হয়? পায়ে ব্লক প্রতিরোধে কোলেস্টেরল পরীক্ষা; পায়ে ব্লক হলে চিকিৎসা কী? পায়ের বাইপাস কীভাবে করা হয়? পায়ে ব্লক হয়েছে, কীভাবে বুঝবেন?
এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৫৯৬তম পর্বে পা‌য়ের ব্লক বিষয়ে কথা বলেছেন ডা. এস এম জি সাকলায়েন।
বর্তমানে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাসকুলার সার্জারি বিভাগের বিশেষজ্ঞ ভাসকুলার সার্জন হিসেবে কর্মরত।
পায়ের ব্লক কী, কেন হয়?
পায়ে অনেক সময় ব্লক হয়। এটি পায়ের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে।


প্রশ্ন : পায়ের ব্লক বিষয়টি কী?
উত্তর : সহজ উত্তর হলো ব্লকটা হয় রক্তনালিতে। তাই যেখানে রক্তনালি আছে, সেখানেই ব্লক হবে। সেটি যদি হৃৎপিণ্ডে হয়, এর নাম হলো হার্ট অ্যাটাক। সেই রক্তনালির ব্লক যদি হয় মস্তিষ্কে, সেটির নাম স্ট্রোক। এটি যদি পায়ে হয়, আমরা বলি পায়ে অ্যাটাক। একিউট লিম্ব ইসকেমিয়া। এটি যেকোনো জায়গায় হতে পারে। পায়ে অনেক রক্তনালি আছে। যাদের হার্টে হয়, তাদের পায়ে হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি।

প্রশ্ন : পায়ে ব্লক হলে কী সমস্যা হয়?
উত্তর : পায়ের ঝুঁকি আছে। পা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আপনি রাস্তাঘাটে বের হলে যে ভিক্ষুকগুলো দেখবেন, এদের অধিকাংশই ব্লকের কারণে সমস্যায় ভোগে। তারা ভারজার ডিজিজের রোগী। ৯৯ ভাগ ক্ষেত্রে এটি ভুল রোগনির্ণয়। পায়ে ব্লক তাদের থাকে। দেখা যায়, যারা চিকিৎসা নেয় না, তাদের সমস্যা তৈরি হয়। অথবা অপচিকিৎসার শিকার হয়। তাদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, পা হারানোর আশঙ্কা বেশি। এককথায় পা নষ্ট হয়ে যায়।

প্রশ্ন : পায়ে ব্লক হলে কী ঘটে? এ সমস্যা হয় কেন?
উত্তর : একজন মানুষ যদি খুব আরাম-আয়েশে জীবনযাপন করেন, তার ওজন যদি বেশি থাকে, একই সঙ্গে তিনি যদি অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসে ভুগে থাকেন, তার প্রেশার যদি নিয়ন্ত্রণে না রাখা থাকে এবং এই ব্যক্তিটি যদি আবার ধূমপান করে থাকেন, সে যেকোনো পর্যায়ে হোক, এমনকি ধূমপান না করেও যদি ধূমপায়ীর পাশে থাকেন, তারও একই ক্ষতি হবে। এই ক্ষেত্রে তাদের দেখা যায় রক্তে চর্বি জমে জমে আস্তে আস্তে এই ঘটনা ঘটতে পারে।
এটি সাধারণত ধীরে ধীরে তার পা ব্লক করে দেয়। আর কারো কারো ক্ষেত্রে হঠাৎ বন্ধ করে ফেলতে পারে। যেমন কোনো একজনের হার্টের রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। তার হয়তো হার্টে কৃত্রিম ভালভ আছে, সেখানে জমাট বাঁধা রক্ত দ্রুত ছুটে গিয়ে পায়ের মধ্যে চলে গেল, তার পায়ে অ্যাটাক হয়ে যেতে পারে। অথবা কোনো কারণে তার পায়ে বা ঊরুতে আঘাত পেয়েছেন, সেই আঘাত পাওয়ার কারণে রক্ত জমাট বেঁধে নিচের দিকে চলে যেতে পারে। তাই হঠাৎ ব্লক হতে পারে। কারো কারো ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে ব্লক হতে পারে। মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ড, পা তিনটিরই কারণ এক।

পায়ে ব্লক প্রতিরোধে কোলেস্টেরল পরীক্ষা করানঃ
পায়ে ব্লক সাধারণত হয় রক্তনালিতে চর্বি জমে। এটি কমাতে প্রতিরোধ জরুরি। 

প্রশ্ন : ব্লক কেন হয়? প্রতিরোধে পরামর্শ কী?
উত্তর : সাধারণ মানুষের ধারণা, হৃৎপিণ্ড কেমন আছে সেই পরীক্ষা করতে আমি ইসিজি করব। আর মস্তিষ্কে হলে সিটিস্ক্যান করব। আমি বলব যে আপনি রক্তের একটি পরীক্ষা করেন। ১২ ঘণ্টা না খেয়ে আপনি একটি লিপিড প্রোফাইল করান। অর্থাৎ কোলেস্টেরলের মাত্রাটা করান। যদি দেখা যায় আপনার কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে নেই, ধরে নেওয়া যায় আপনার মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ড ও পায়ের যেকোনো জায়গায় ব্লক হতে পারে। অনেকের আবার ধারণা, আমার তো শরীর স্বাস্থ্য পাতলা, আমার কোনো সমস্যা নেই, আমার চর্বিজাতীয় সমস্যা হবে না। তবে এখন আসলে চর্বিজাতীয় সমস্যাগুলো কোনো বয়স, ওজন কোনো কিছুই মানে না। শরীরে না থাকলেও রক্তনালির ভেতরে থাকতে পারে। দেখা গেল, তার বংশের কারণেই শরীরের মধ্যে রক্ত জমে যাওয়ার প্রবণতা বেশি। তাই একটি পরীক্ষাই তাকে করতে হবে, এটি হলো কোলেস্টেরল। একে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। যার ডায়াবেটিস বেশি, তাকে সেটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। প্রেশার বেশি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এবং অবশ্যই ধূমপান ও ধূমপায়ী দুজনের কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে। এ ছাড়া আর কোনো সুযোগ নেই এই রোগ থেকে ভালো থাকার জন্য। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। সমস্যা হলে অবশ্যই যেখানে-সেখানে না দেখিয়ে একজন ভাসকুলার সার্জনের কাছে আসতে হবে।

পায়ে ব্লক হলে চিকিৎসা কী?
পায়ে ব্লকের চিকিৎসা দ্রুত করতে হয়। নয়তো পা হারানোর মতো বিপদও ঘটতে পারে। 

প্রশ্ন : পায়ে ব্লক হলে কী চিকিৎসা দিয়ে থাকেন?
উত্তর : ৮ থেকে ১০ ঘণ্টার মধ্যে যদি তিনি চলে আসেন, তাহলে ইতিহাস নেই। নিয়ে দেখার চেষ্টা করি যে এই ব্লক হওয়ার কোনো কারণ আছে কি না। যেমন, হৃৎপিণ্ডে হয়তো তার ভালভ লাগানো আছে, সে ওষুধটি খায় কি না রক্ত পাতলা করার জন্য। যদি না খায়, আমি হয়তো তাকে ঠিক করে দিলাম, আবার কিন্তু ব্লক হবে। এটা প্রথমে আমরা দেখার চেষ্টা করি। এরপর আমরা নির্দিষ্ট চিকিৎসায় চলে যাই। আমরা খুব সাধারণ একটি চিকিৎসা করি। আমরা তার কুঁচকির কাছে যে রক্তনালি আছে, এটা খুলে ওই দিক দিয়ে চিকন কিছু তার ঢুকিয়ে দিই। পুরো পায়ের মধ্যে তারগুলো ঢুকিয়ে দিই। ঢুকিয়ে দিয়ে যে রকম আম পেড়ে নিয়ে আসা হয়, বড় লাঠি দিয়ে, যন্ত্রের মাধ্যমে ফাঁস লাগিয়ে আমরা ঠিক সেভাবে ময়লাটাকে বের করে নিয়ে আসার চেষ্টা করি। এর পর আমরা তাকে কিছু ইনজেকশন দিয়ে দিই। অস্ত্রোপচারের টেবিলেই আমরা দেখি, রোগীর ব্যথা চলে গেছে, পা গরম হয়ে গেছে এবং তখন আমরা তাকে খুশির খবর দিতে পারি যে আপনার পা এ মুহূর্তে নিরাপদ। আর যদি তিনি দেরি করে ফেলেন, বেশির ভাগ সময় রোগীরা দু-তিন দিন পরে আসে, তখন আমরা পায়ের পরীক্ষা করে দেখি যে পা আসলে জীবিত আছে কি না। যদি জীবিত থাকে, তখনই আমরা কেবল ওই রক্তনালিতে হাত দিই। আর যদি জীবিত না থাকে, সে ক্ষেত্রে আমাদের আর কিছুই করার থাকে না। হয়তো পা কেটে ফেলার জন্য আমরা অর্থোপেডিকসের কাছে পাঠিয়ে দিই।

প্রশ্ন : একজন মানুষের যদি এই সমস্যা ধীরে ধীরে হয়, সে ক্ষেত্রে তার সমস্যা কী হতে পারে এবং উভয় ক্ষেত্রে আপনারা সাধারণত কী পরীক্ষা করেন বা কী প্রক্রিয়ায় নির্ধারণ করেন যে পায়ের কোনো রক্তনালিতে বা কোথায় ব্লকটা আছে?
উত্তর : ধীরে ধীরে যে ব্লক হয়, সেই রোগীর সংখ্যা আমাদের দেশে বেশি। যাঁরা সিগারেট খান, এঁদের ক্ষেত্রে দেখা যায় হাঁটতে গেছেন, ভালো লাগছে। কিছুদূর হাঁটার পর দেখা যায় তার পায়ে কামড়াচ্ছে বা খিল ধরে ব্যথা হচ্ছে। সে একটু ম্যাসাজ করলে ভালো লাগে। একটু এগোলো আবার ব্যথা হচ্ছে। বিশ্রাম নিল ভালো লাগছে। দেখা যায় অল্প একটু হাঁটলে ভালো হয় এবং রোগের তীব্রতায় এক সময় দেখা যায় সে বসে আছে, অথচ পায়ে ব্যথা হচ্ছে। একটি সময় দেখা যায় কিছুই নয়, পায়ের আঙুলের মাথায় ঘা হয়েছে। সে দিনের পর দিন সেটি ড্রেসিং করছে, সার্জারি করছে। অনেক চিকিৎসকও আছেন, যেহেতু গ্যাংরিন, সেটুকু কেটে ফেলছেন। আসলে মাথায় রাখতে হবে আমি যে কেটে ফেললাম, সেই জায়গাটা শুকাবে কী দিয়ে? তার তো রক্তের প্রবাহ আনতে হবে। সে কারণে আমরা তখন প্রথমে পালস দেখি যে কতদূর পর্যন্ত আছে। যদি পালস না থাকে, খুবই সহজ একটি পরীক্ষা, যাকে সাধারণ মানুষ আলট্রাসনোগ্রাম বলে, একে আমরা ডুপ্লেক্স বলি, কম্পিউটারে পরীক্ষা করে ডুপ্লেক্স করলে আমরা বুঝতে পারি কোন পর্যায়ে ব্লক আছে। হৃৎপিণ্ডে যে রকম এনজিওগ্রাম করা হয়, এখানেও ঠিক একইভাবে এনজিওগ্রাম করে, রোগের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়, একই সঙ্গে চিকিৎসার পদ্ধতিও ঠিক করা হয়। আমি কি এর ময়লা পরিষ্কার করে দেব? আমি কি এর বাইপাস করে দেব? নাকি আমি ইনজেকশন থেরাপি দেব? আমাকে এনজিওগ্রাম নিশ্চিতভাবে এটি বলে দেবে। এই পরীক্ষাগুলো করার পর আমরা ঠিক করি যে আমি তার চিকিৎসাটা ওইভাবে দিতে চাই।

প্রশ্ন : পায়ের বাইপাস কীভাবে করা হয়?
উত্তর : বাইপাস মানে হলো আপনার মূল রাস্তা ভেঙে গেছে, এখন গাড়িগুলো জমি দিয়ে পার হবে। একে বাইপাস বলে। তার মূল রক্তনালি বন্ধ। আমরা তার পায়ের একটি রক্তনালি দিয়ে, কৃত্রিম একটি রক্তনালি দিয়ে ওই রাস্তাকে বাইপাস করে রক্ত পাঠানোর ব্যবস্থা করি। আপনি শুনে আনন্দিত হবেন, এখন আর সেই বাইপাস করারও দরকার নেই। হাতে যে রকম রিং পরাচ্ছেন, পায়েও সে রকম রিং পরানো যায়। ভারজার ডিজিজ বলে যে ভুল কথাগুলো বলা হচ্ছে, সেটি আমাদের দেশে খুবই কম। এ ক্ষেত্রে দেখা যায় বাইপাস করাও যাবে না। রিং পরানোও যাবে না। তাহলে কি তার পা কেটে ফেলতে হবে? না। আমরা এক ধরনের ইনজেকশন দিই যে প্রকৃতগতভাবে কিছু রক্তনালি তৈরি হয়ে যাচ্ছে। একে আমরা প্রকৃতগত বাইপাস বলি। তিনি পা ততটুকু পর্যন্ত সুরক্ষিত রাখতে পারেন, যতটুকু তার গ্যাংরিন হয়নি। আমরা আগে একটি জিনিস দেখেছি পালস নেই যে পর্যন্ত, সে পর্যন্ত পা কেটে ফেলা হয়। এখন সেটি করতে হচ্ছে না। এখন চেষ্টা করা হয় নতুন করে পা বাঁচাতে।

পায়ে ব্লক হয়েছে, কীভাবে বুঝবেন?
পায়ের রক্তনালিতে চর্বি জমে ব্লকের তৈরি হয়। এ দেশের অনেক লোকই এ সমস্যায় ভুগে থাকেন। 

প্রশ্ন : হঠাৎ ব্লক হলে পায়ের কী অনুভূতি হবে, কেমন লাগবে এবং যদি ধীরে ধীরে হয় তাহলে কী অনুভূতি হবে?
উত্তর : বাংলাদেশে আসলে প্রচুর সংখ্যক লোক এ সমস্যায় ভোগেন এবং না জেনে ভুল চিকিৎসার শিকার হন। হয়তো স্বাভাবিকভাবেই মানুষ চলছিলেন, হঠাৎ করে তার পায়ে তীব্র ব্যথা হবে। উনি দেখবেন যে ওনার পায়ে এতটাই ব্যথা যে পা নাড়াতে কষ্ট হচ্ছে। একটি পর্যায়ে হাত দিলে দেখবেন পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। কারো যদি পায়ে হঠাৎ তীব্র ব্যথা হয়, পা নাড়াতে কষ্ট হয়, একই সঙ্গে পা ঠান্ডা হয়ে যায় এবং তিনি যদি সামান্যতম সচেতন হয়ে পালসটি দেখতে পারেন, যদি পালস সেখানে পাওয়া না যায়, তবে নিশ্চিতভাবে তিনি পায়ের ব্লকজনিত সমস্যায় ভুগছেন।
পায়ের ব্যথা হলে কেউ যায় নিউরোমেডিসিনের কাছে, কেউ যায় ফিজিওথেরাপির কাছে। দেখা যায় এমআরআই করছে, তবে পায়ে যে পালস নেই, এই অনুভূতিটা অনেকের মধ্যে থাকে না। তাই দেখা যায় তিনি এমআরআই করছেন, এক্স-রে করছেন, কিছুই ধরা পড়ছে না। অথচ এর জন্য তিনটি আঙুলই যথেষ্ট। একজন মেডিকেল শিক্ষার্থীও এই পালস দেখতে পারেন। তাই যদি তার পালস না থাকে তীব্র ব্যথা হয়, পা ঠান্ডা হয়, বুঝতে হবে তার হঠাৎ করে পায়ের রক্তনালিতে কোনো না কোনো কারণে ব্লক হয়ে গেছে। তার হাতে সময় আছে মাত্র ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা। এর মধ্যে তিনি যদি চিকিৎসা না নেন, তার পা হারানোর ঝুঁকি থাকবে।

No comments:

Post a Comment