ঢাকা: একটি চাকরি ও প্রতারণার শিকার এক তরুণীর গল্প

এক মেয়ে আসছে যশোর এমএম কলেজে থেকে ঢাকায় চাকরি করবে। ধরেন ওর নাম লিপি। যমুনা ফিউচার পার্কের গেইটের কাছ দিয়ে রাস্তা ক্রস করার সময় ইয়া বড় লাগেজ নিয়ে বলল 'ভাইয়া একটু হেল্প করবেন?' আমি তাকে হেল্প করলাম। রাস্তার ওইপাড়ে তার ভারি লাগেজ পৌঁছায় দিলাম। এ
-গাবতলী কিভাবে যাব?
-যেই বাসে আমি মিরপুর যাব সেইটাতে মিরপুর ১ নম্বরে গিয়া রিকশা নিয়া গাবতলি চলে যে‌তে পারবেন।

মিরপুরগামী আকিক বাসে চড়লাম, সেই মেয়ে উঠলো। আমার পাশেই এসে বসলো।
-আমি আসলে কিছুই চিনি না আমারে মিরপুর থেকে রিকশায় উঠায়ে দিবেন?
-দিব, কিন্তু আপনার বাসা কোথায়?'
-যশোরের বেনাপোলে।
পড়ে ম্যানেজমেন্টে এমএম কলেজে। কেবল মাত্র ফার্স্ট ইয়ার।
-ঢাকায় কার বাসায় আসছিলেন এতো বড় লাগেজ নিয়া?
-কারো বাসায় না, চাকরির জন্য আসছিলাম।

চাকরি হয়ে গেছে। ১০ তারিখ থেকে জয়েন করতে বলছে।
মেয়ের ক্লান্ত চোখেও রঙিন স্বপ্নের ঝলকানি খেলে গেল।
-তাহলে আজকে এতো বড় লাগেজ নিয়া আসছিলেন ক্যান?'
তার নাকি আজকেই জয়েন করার কথা ছিল। তো কম্পানি তারে ১০ তারিখে জয়েন করতে বলছে। সেইটা ছিল ১ তারিখ। কম্পানির নাম জিজ্ঞেস করলাম, ঠিকমতো বলতে পারে না। আরো জানলাম তাকে এপয়েন্টমেন্ট লেটার দিছে। আমি বললাম দেখি এপয়েন্টমেন্ট লেটার। সে যেই কাগজটা দেখাইলো তাতে চাকরিতে জয়েন করার মতো কিছু লেখা ছিল না। শুধু ট্রেনিং পিরিয়ড ৬ মাস। আর কি কি হাবিজাবি। এড্রেসও ক্লিয়ার না। খটকা লাগলো।
-আজকে জয়েন করলেন না কেন? আপনি তো আজকেই সব প্রিপারেশন নিয়া আসছিলেন।
-আজকে হোস্টেলে থাকার জায়গা, আর অফিসের কিছু কাজ ক্লিয়ার করলাম।
-টাকা পয়সা কিছু দিতে হইছে নাকি?
-হোস্টেল টোস্টেল আর অফিসিয়াল কাজের জন্য সাড়ে ৫ হাজার টাকা।
আমি মনে মনে বললাম 'খাইছে। '
-কেউ যদি চাকরি দেয় তাহলে কোনো টাকাপয়সা নিবে না। প্রাইভেট সেক্টরে এইসব নাই।
সে আমাকে বুঝ দেওয়ার চেষ্টা দিল।
-আপনার আসলে এতো অল্প বয়সে চাকরি করার চিন্তা করা ঠিক হয় নাই।
-আসলে আমি ঢাকায় থাকতে চাই
-বাবা-মাও কি সেটাই চায়?
না বাবা মা সেটা চায় না। পত্রিকা মারফতে বিজ্ঞাপন পেয়ে যোগাযোগ করেছিল। প্রথমে দুই হাজার টাকা বিকাশে পাঠাইছি। আর আজকে সাড়ে ৫ হাজার। টাকা খুব বেশি না, কিন্তু এই টাকাও কারো জন্য অনেক অনেক বেশি।
-তবে ১০ তারিখ জয়েন করতে আসার আগে ভালোভাবে জেনে আসবেন।
এর আগে আমার দুইবন্ধু এইরকম ঢাকায় চাকরি করতে এসে বিপদে পড়ছিল। শেষে টাকা খোয়ানোর সাথে সাথে ক্যার্দানি দেখায়ে জীবনও খোয়াইতে ধরছিল। ঢাকার এক স্থানীয় বন্ধু তাদের উদ্ধার করে। মিরপুর ১ নম্বরে নেমে লিপিকে নাস্তা করালাম। মেয়ে সারারাত জার্নি করে এসেছে। কিছু খায় নাই, আবার এখন ব্যাক করতেছে যশোর। ওকে রিকশায় উঠায়ে দিলাম। যাওয়ার সময় সে আমার নাম্বার নিয়া গেছিল। তারপরে তার কথা ভুলে গেছিলাম। এর ৮ দিন পরে সেই আমাকে ফোন দেয়। বলে-
-ভাইয়া ওরা আমাকে আরো ৫ হাজার টাকা বিকাশ করে দিতে বলল, আর পরশু আমাকে গিয়ে জয়েন করতে বলেছে।
-আপনি কি টাকা দিবেন এখন?
-হুম আমি তো ঢাকায় যেতে চাই, আমার বান্ধবীদের কাছে ধার নিয়েছি। আমি বললাম তাহলে ওদের নাম্বারটা দেন আমি একটু কথা বলে দেখি। সে নম্বর দিল। আমি ফোন দিলাম। জিজ্ঞেস করলাম আপনারা চাকরি দিবেন কিন্তু টাকা কিসের জন্য। তারা চাকরি দেওয়ার ব্যাপারটা পুরো অস্বীকার করে বসল। সুর বদল করে বলল তাদের এটা ফ্যাশন হাউজ ট্রেনিং করায়।
আমি বললাম, আপনাদের বাটপারি দাঁড়ান, ভাটারা থানায় ফোন দিচ্ছি, আপনাদের সবকয়টাকে থানায় ঢুকাচ্ছি, আপনি তো আমাকে চেনেন না। ওপার থেকে এক ভদ্র মহিলার (!) উচ্চস্বরে হাসি শুনলাম। তারপরে বলে আমাদের আপনি পাবেন কোথায়? আমাদের তো কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানাই নাই... আসলেই তো তাদের নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানাই নাই।   

রংপুরের এক বন্ধু মাত্র কিছুদিন আগে, প্রথমে বিকাশে ৫ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেয়। এরপরে পরীক্ষা দিতে আসবে। তার আগে আমাকে ওই প্রতিষ্ঠানের এড্রেস দেয়। সেখানে গিয়ে আমি ওই কম্পানির ঠিকানা মেলাতে পারি নি। আর অধিকাংশই গার্মেন্ট সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নাম। বেচারা ধরা খেয়েছে বুঝতে পেরেই ভেঙে পড়ে। বেকার জীবনের এক টাকারও অনেক দাম।

লিপিকে বললাম ঘটনা। লিপি বুঝলো কি না কে জানে।
-ভাইয়া, আমি তারপরেও ঢাকা যাব, দেখি কি হয়!
-আসলে ফোন দিয়েন আমাকে।
সে যেদিন আসবে সেদিন রাতে ফোন দিল।
-আপনি এসে আপডেট জানায়েন। সাবধানে থাকবেন।
পরেরদিন সন্ধ্যা হয়ে গেল। লিপি ফোন দিল না। আমি একবার ফোন দিলাম। রেসপন্স পেলাম না। পরেরদিন দিলাম তাও রেসপন্স পেলাম না। দেড় সপ্তাহ পরে আবার ফোন দিলাম- সে ফোন ধরলো। বললাম-
-ঢাকার জীবনে বেশ ভালোই আছেন তাহলে, চাকরি বাকরি করছেন
-না ভাইয়া, আমি যশোরে অনেক অসুস্থ... অনেক... এরপরে সে ফোন কেটে দেয়...
তার ৩ দিন পরে ফোন দিলাম, ফোন বন্ধ। আজ আরেকবার ট্রাই করলাম। ফোন বন্ধ...

আমার মনে হয়, জরুরি ভিত্তিতে নিয়োগ, আজই নিয়োগ, থাকা খাওয়ার সু-ব্যবস্থা ও আকর্ষণীয় বেতন- এই টাইপের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে সাড়া দেওয়ার আগে একবার ভেবে নেওয়া দরকার। কেননা ওই যে বললাম, বেকার জীবনের এক টাকারও অনেক দাম...

No comments:

Post a Comment