হাত বাড়া‌লেই অ্যান্টিবায়োটিক!

কেবল জীবাণুবাহিত রোগ সারাতে বা প্রতিরোধে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োগের কথা। কিন্তু দেশে কথায় কথায় চলে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার।
হাত বাড়ালেই মেলে অ্যান্টিবায়োটিক। জীবাণুবাহিত রোগ না হলেও অনেক ক্ষেত্রেই চিকিৎসকরা বুঝে না বুঝে অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের পরামর্শ দেন। এমনকি ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের প্রবণতা রয়েছে দেশে। আবার রোগীরাও স্পর্শকাতর এ ওষুধের কার্যকারিতা না বুঝে সঠিক নিয়মে ডোজ মেনে অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করে না। এভাবে রোগ সারিয়ে তুলতে গিয়ে উল্টো বিপদ ডেকে আনছে মানুষ। ফলে অনেক অ্যান্টিবায়োটিকই এখন আর মানুষের শরীরে কার্যকর হচ্ছে না।
কেবল মানুষের বেলাতেই নয়, অন্যান্য গবাদি পশু বা মাছেও প্রয়োগ হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক, যা খাদ্যের মাধ্যমে মানবদেহে ঢুকছে। এভাবে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে মানবদেহে নানা ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক মজুদ হয়ে তা রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অকার্যকর হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গ্লোবাল অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স পার্টনারশিপ (জিএআরপি) ও সেন্টার ফর ডিজিজ ডায়নামিকস, ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিসি (সিডিডিইপি)। সংস্থা দুটি বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারের নজরে এনে নিজেদের উদ্যোগেই অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার রোধে কাজ শুরু করেছে। এমনকি সরকারকে বাধ্য করেছে প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিকে বিক্রি নিষিদ্ধ করতে। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবেই গত ৩১ মে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর আনুষ্ঠানিকভাবে ‘প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করা নিষেধ’ সংক্রান্ত নির্দেশিকা জারি করেছে, যা ওই সংস্থা দুটি সারা দেশে ওষুধ বিক্রয়কেন্দ্রে বিতরণ করবে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক গোলাম কিবরিয়া কালের কণ্ঠকে জানান, ওই নির্দেশনায় একই সঙ্গে ভাইরাসজনিত সর্দি-জ্বর-কাশি-ডায়রিয়ায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার না করারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. মোস্তাফিজুর রহমান ওই নির্দেশিকা জারি করেন।
রোগ ও ওষুধ বিশেষজ্ঞরা জানান, ওষুধ বাণিজ্যের বড় অংশজুড়ে আছে অ্যান্টিবায়োটিক; মানুষ, অন্য প্রাণী কিংবা ফসল মিলে। কেবল মানুষের জন্য প্রযোজ্য অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ প্রস্তুতকারী দুই শতাধিক কম্পানির তৈরি করা ২০টির বেশি জেনেরিকের অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ আছে, যা ৪০০টিরও বেশি ব্র্যান্ড নামে ছড়িয়ে আছে বাজারে। এর সবটাই মানুষের হাতের নাগালে উন্মুক্ত অবস্থায় পাওয়া যায় যখন-তখন। চিকিৎসকরাও ওষুধ কম্পানির প্ররোচনায় কোনো অ্যান্টিবায়োটিকই সংরক্ষিত না রেখে সব কটি সাধারণভাবে ব্যবহার করে থাকেন।
অন্যদিকে হাঁস-মুরগি-গরু-ছাগলেও যথেচ্ছভাবে অতিমাত্রায় ব্যবহার চলছে অ্যান্টিবায়োটিকের। দেশে কিডনি ও লিভারের রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার বড় কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিকের বিপজ্জনক অপব্যবহারকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রোগতত্ত্ব কার্যক্রমের অন্যতম উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মাহামুদুর রহমান বলেন, অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার ও অপপ্রয়োগ খুবই বিপজ্জনক। অবশ্য সব অ্যান্টিবায়োটিক ক্ষতিকর নয়, তবে অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ম-নীতি মেনে সেবন না করলে কিংবা অপ্রয়োজনে প্রয়োগ ঘটলে ক্ষতি বয়ে আনবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. আ ব ম ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, অ্যান্টিবায়োটিকে উদার বাণিজ্য চলছে বাংলাদেশে। বিশ্বের কোথাও প্রেসক্রিপশন ছাড়া কোনো অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ বেচাকেনা সম্ভব নয়; কিন্তু বাংলাদেশে এটা কোনো ব্যাপারই না। যে কেউ যখন-তখন ওষুধের দোকানে গিয়ে যেকোনো অ্যান্টিবায়োটিক কিনতে পারছে প্রেসক্রিপশন ছাড়া। সরকারের গাইডলাইনও মানছে না কেউ। এ কারণেই ভয়াবহ পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে। ‘দেশে মানুষ ও গবাদি পশুর জন্য একই অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারেরও নজির আছে। এ ছাড়া মানুষের চেয়েও আরো বিশৃঙ্খল অবস্থা চলছে গবাদি পশুর অ্যান্টিবায়োটিকে, যা থেকেও ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে মানুষের ওপর। ’ যোগ করেন তিনি।
বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশে মাছ-মুরগিকে রোগমুক্ত রাখা কিংবা মড়ক ঠেকাতে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে নানা ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ। বিশেষ করে ইনজেকশনের মাধ্যমে এসব ওষুধ প্রয়োগ করা হয়; যার বেশির ভাগই রান্নার তাপেও নষ্ট হয় না। ফলে ওই অ্যান্টিবায়োটিক মানুষের শরীরে ঢুকে বয়ে আনে মারাত্মক ক্ষতি। কিডনিকে ক্ষতিগ্রস্ত করার বড় কারণ হিসেবে মাছ-মাংসের অনিয়ন্ত্রিত অ্যান্টিবায়োটিককে দায়ী করা হয়।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, দেশের বেশির ভাগ খামারি এসব ওষুধ সম্পর্কে সচেতন না হওয়ায় গবাদি পশুর শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করছে। তবে এখন মানুষের নিরাপদ খাদ্যের স্বার্থেই গবাদি পশু-পাখিকে অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প হিসেবে ‘প্রোবায়োটিক’ ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে খামারের ব্যবস্থাপনাগত কিছু কৌশল অবলম্বনেও জোর দেওয়া হয়, যাতে রোগ-বালাই কম হয়।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) উদ্যোগে অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার ও এর কার্যকারিতা নিয়ে এক সমীক্ষার ফলাফলে উঠে এসেছে ভয়ানক চিত্র। ওই সমীক্ষায় দেখা যায়, দেশে এখনই ৫৫.৭০ শতাংশ অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর। এর সরল অর্থ হচ্ছে ঢাকা শহরে যে রোগজীবাণু দ্বারা সংক্রমণ ঘটে তার বিরুদ্ধে ৫৫.৭০ শতাংশ অ্যান্টিবায়োটিক কোনো কাজ করে না।
পবার ওই সমীক্ষা থেকেই বেরিয়ে এসেছে—বাংলাদেশে মত্স্য খামারে ১০ প্রকারের ৫০ ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব রাসায়নিকের মধ্যে রয়েছে অ্যান্টিবায়োটিক, কীটনাশক ও গ্রোথ এজেন্ট। প্রাণিসম্পদ খাতে ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক মানুষের কিডনি, লিভার ও হৃপিণ্ডের ক্ষতিসাধন করছে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, অ্যান্টিবায়োটিকের মাত্রা, সেবনকাল এবং সেবনের মধ্যবর্তী বিরামের সময় কতটুকু, তা মেনে না চললে সংক্রমিত অণুজীব রেজিস্ট্যান্স হয়ে যেতে পারে। কেউ যদি নির্দিষ্ট মেয়াদের আগেই অ্যান্টিবায়োটিক সেবন বন্ধ করে দেয়, তাহলে যে সংক্রমণের জন্য তা নেওয়া হয়েছিল সেই অণুজীবটির বেঁচে যাওয়া কয়েকটি থেকে আবার সংক্রমণ ঘটতে পারে। এরা যদি এ সময়ে নিজেদের জৈবিক প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলতে পারে, তাহলে আগের অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করবে না। এ ছাড়া ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিক কোনো কাজে আসে না। কারণ অ্যান্টিবায়োটিক শুধু ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকের বিরুদ্ধে কাজ করে। সাধারণ হাঁচি-কাশি জাতীয় ঠাণ্ডা লাগা—ভাইরাসজনিত বা করোনাভাইরাস, রাইনোভাইরাস ইত্যাদি এ জন্য দায়ী। এদের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করে না। ফলে না জেনে-বুঝে ঠাণ্ডা-জ্বর হলেই অ্যান্টিবায়োটিক সেবন বিপদ বয়ে আনবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, প্রথমত, অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার না করা গেলে ভালো, আর করতে হলে অবশ্যই নিয়ম মেনে ব্যবহার করতে হবে। চিকিৎসকের কাছে গেলে ব্যবস্থাপত্রে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়েছে কি না তা জেনে নেওয়া, নির্দেশিত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ঝুঁকি ভালো করে জেনে নেওয়া, ব্যবস্থাপত্রে উল্লেখিত ডোজ ও সময় অনুসারে অ্যান্টিবায়োটিক সেবন, চিকিৎসকের অনুমতি ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক না নেওয়া, কোনো হাসপাতাল পরিদর্শনের সময় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা; কারণ হাসপাতালকে মাল্টি-ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স ব্যাকটেরিয়ার অভয়ারণ্য বলে ধরা হয়।

© কা‌লেরকণ্ঠ

No comments:

Post a Comment