তায়েব পড়ছে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সে একটু হ্যাংলা-পাতলা। ইদানীং সে নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তিত। সে মনে করছে, সে অনেক শুকনো, বিশেষ করে সে তার মুখমণ্ডল নিয়ে উদ্বিগ্ন। সে মনে করে, তার ভাঙা গালের কারণে সবাই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। সে সবার কাছ থেকে নিজের ভাঙা গাল লুকিয়ে রাখতে চায়। এ কারণে সে কয়েক মাস ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। ঘরে একা বসে থাকে, পারতপক্ষে কারো সামনে যায় না।
সায়মার সমস্যাও প্রায় একই রকম। সে পড়ছে উচ্চ মাধ্যমিকে। সে মনে করে, তার নাকটি অনেক চ্যাপ্টা। প্রকৃতপক্ষে কিন্তু তা নয়। মনে মনে তার এই নাক নিয়ে সে বিব্রত। একাধিক চিকিৎসকের কাছে গিয়ে সে নাক অপারেশন করে ঠিক করে দেওয়ার আবদার করেছে। কিন্তু চিকিৎসকরা তাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে তার নাক ঠিকই আছে। সে বাইরে গেলে এখন নাক ঢেকে রাখছে।
তায়েব বা সায়মার এ সমস্যাটিকে বলা হয় বডি ডিসমরফিক ডিসঅর্ডার। এটি এক ধরনের মনের রোগ। সাধারণত ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়সীদের মধ্যে এ সমস্যা দেখা দিতে পারে। নারীদের মধ্যে এই সমস্যা হওয়ার হার কিছুটা বেশি। এক গবেষণায় দেখা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শতকরা ২ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষের মধ্যে বডি ডিসমরফিক ডিসঅর্ডার রয়েছে। এ সমস্যাটির সঙ্গে অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার, বিষণ্ণতা ও উদ্বেগজনিত সমস্যা থাকতে পারে। এ সমস্যার কারণে হতাশা থেকে কেউ কেউ মাদকও গ্রহণ করে থাকে।
ধারণা করা হয়, গায়ক মাইকেল জ্যাকসন বডি ডিসমরফিক ডিসঅর্ডার রোগে আক্রান্ত ছিলেন। তিনি মুখসহ অন্যান্য স্থানে ১১ বার কসমেটিক সার্জারি করান। এরসঙ্গে তাঁর মধ্যে বিষণ্ণতা ও মাদকাসক্তির সমস্যাও ছিল।
বডি ডিসমরফিক ডিসঅর্ডার সমস্যায় একজন মানুষের মনে তার ত্রুটিযুক্ত শারীরিক কাঠামো বা চেহারার গড়ন নিয়ে নানা অলীক চিন্তা তৈরি হয়। সাধারণভাবে এ ধরনের সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তির মনে তার নাক, চুল, গাল, দাঁত, গায়ের রং, কান বা ঠোঁটের গড়ন, পুরুষদের ক্ষেত্রে নিতম্ব, নারীদের ক্ষেত্রে স্তন প্রভৃতি নিয়ে খুঁতখুঁতানি থাকে। এ কারণে তারা আয়নায় বারবার নিজেদের দেখে বা পরিবারের সদস্য, বন্ধুদের কাছে নিজেদের ত্রুটিযুক্ত চেহারার গড়ন সম্পর্কে নানা প্রশ্ন করে।
নিজেদের শরীরের অংশবিশেষ সম্বন্ধে তার মনে নানা ভুল ধারণা জন্মায়। একপর্যায়ে সমস্ত সামাজিক যোগাযোগ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নেওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। কারো কারো মধ্যে মানসিক চাপ এতটাই বেড়ে যায় যে সার্জারির মাধ্যমে তারা তাদের চেহারার কাঠামোগত ত্রুটি দূর করতে উঠেপড়ে লাগে। যদিও এই পদ্ধতি অবলম্বন করা সত্ত্বেও তাদের মনের ভুল ধারণার কোনো পরিবর্তন হয় না।
এ ধরনের ব্যক্তি শরীর বা মুখমণ্ডলের স্বকল্পিত সমস্যা নিয়ে সব সময় আচ্ছন্ন থাকে, মনে করে তার এ সমস্যার জন্য তাকে কুৎসিত দেখাচ্ছে। তারা বেশিরভাগ সময় আয়নার সামনে থাকে। অন্য কারো সঙ্গে মিলে আয়না দেখতে চায় না, মনে করে তার এই কর্পিত সমস্যার জন্য অন্যেরা তাকে নিয়ে উপহাস করে, সমালোচনা করে। প্রায়ই বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় (কসমেটিক ব্যবহার, কৃত্রিম উপকরণ ব্যবহার বা প্লাস্টিক সার্জারি) এই কল্পিত অংশের পরিবর্তন ঘটাতে চায়। তারা সামাজিকতা পরিহার করে, বিষণ্ণতাসহ বিভিন্ন মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে।
এ রোগের চিকিৎসায় ওষুধের পাশাপাশি দীর্ঘ মেয়াদে সাইকোথেরাপি (কগনিটিভ থেরাপি, কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি, সোশ্যাল থেরাপি, ফ্যামিলি থেরাপি), রিলাক্সেশন থেরাপি কার্যকর। মনে রাখতে হবে যে এটি একটি মানসিক সমস্যা তাই সার্জারি করে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
ডা. আহমেদ হেলাল
সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা।
No comments:
Post a Comment