এ প্রশ্নটি সকল অটিস্টিক শিশুর বাবা-মায়ের কমন একটি জিজ্ঞাস্য। আকুল প্রাণের নিরব আর্তি ভরা এই প্রশ্নের জবাব সত্যি সত্যিই দেয়া কঠিন। কারণ, আমরা সবাই জানি প্রতিটি অটিস্টিক শিশুই আলাদা আলাদা সক্ষমতার অধিকারী এবং প্রত্যেকের আগ্রহের বিষয়ও স্বতন্ত্র। এ জন্যে কিভাবে তাকে কথা বলা শেখাবেন তার কোনো 'একক দাওয়াই' জাতীয় সমাধান নেই।
তবে এক একজন শিশুর সক্ষমতা এবং আগ্রহকে বিবেচনায় এনে এ ব্যাপারে কিছু পরীক্ষিত সমাধান রয়েছে- যেগুলোর যেকোনোটির বা একাধিক মডেলের মিশ্রনে চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।
যখন আপনি নিজে বসে ভাবছেন যে কিভাবে আপনি আপনার শিশুটিকে কথা বলা শেখাবেন- তখন আপনি আপনার শিশুটির দিক থেকে ভেবে দেখুন; সে যদি ভেবে থাকে যে “আমি কেন কথা বলব?”
আপনি আপনার শিশুর দিকে ভালো করে লক্ষ্য করুন। আপনি লক্ষ্য করবেন যে, একটি শিশু চারপাশের কারো সঙ্গে সংযোগ এড়ানোর জন্য নিজে নিজে বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকছে, একই সঙ্গে সে তার চারপাশের পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে যাতে সবকিছু তার অনুকূলে থাকে। এজন্যে সে হয়তো চিৎকার করছে বা নিজেকে আঘাত করছে বা মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে- এবং এসব করে সে তার চাহিদাকৃত ইচ্ছা পূরণের চেষ্টায় থাকে। প্রশ্ন আসতে পারে যে শিশুটি অমন করছে কেন? আমরা এসব ক্ষেত্রে নিজেরাই অনেক জবাব দিয়ে দেই। যেমন-
১। শিশুটি অটিস্টিক
২। শিশুটি কথা বলতে পারে না
৩। তার সকল সেন্স বা অনুভূতি অন্য কোনো কিছু নিয়ে ব্যস্ত
৪। সে নিজের মতো করে থাকতে চায়, নিজস্ব পরিমণ্ডলের কোনো পরিবর্তন গ্রহণ করে না
৫। তার নিউরোলোজিক্যাল ডেভেলপমেন্ট ঠিকমতো হয়নি। অথবা
৬। সে তার নিজের আচরণ বা অভ্যাসকে নিজের মতো করে নিয়েছে এবং স্বীয় আচরণবোধের বলয় থেকে বেরোতে চায় না।
বাস্তবতা হচ্ছে যে আমরা সুনির্দিষ্টভাবে কি কারণে এটি হচ্ছে তা জানি না। এটি উপরের যেকোনো একটি কারণ বা একাধিক কারণের জন্যে এমন হচ্ছে।
প্রাথমিকভাবে বাবা মা হিসেবে আপনি তার সঙ্গে আচরণে এমন একটি এপ্রোচ তৈরি করুন যাতে শিশুটি তার চারপাশের পরিবেশের প্রতি মনোযোগী হয়। যেহেতু অটিস্টিক শিশুরা খুব সীমিত বিষয়ের প্রতি আগ্রহী হয়, তাই তার প্রতি যে এপ্রোচ আপনি ফলো করবেন সেটি যেন তার আগ্রহের বা কৌতূহলের বিষয়কেন্দ্রিক হয়।
আমরা সবাই জানি যে, অটিস্টিক শিশুদের সঙ্গে ইন্টারেকশন (কথাবার্তায় বা ইশারায় যোগাযোগ) একটি কঠিন তথা কষ্টসাধ্য বিষয়। আগেই বলেছি যে তার পছন্দের জিনিস দিয়ে শুরু করুন। যত বেশি তার সঙ্গে ইন্টারেকশনের চেষ্টা করবেন- মনে রাখবেন ততই পদ্ধতিটি আপনার কাছে সহজ হয়ে আসবে। যেসব খেলনা বা বস্তু তাকে আকর্ষণ করে সেগুলো দিয়েই আপনাকে চেষ্টার শুরুটা করতে হবে। এমন বস্তু বা খেলনাসমূহ কি কি হতে পারে তার একটা সাধারণ ধারণা এখানে দেওয়া হলো-
১। তার যেকোনো পছন্দনীয় সুনির্দিষ্ট খেলনা
২। আধো আধো বোলে শব্দ করা
৩। সুড়সুড়ি দেয়া বা তাকে hug করা
৪। টিভি রিমোট
৫। কোনো নির্দিষ্ট ভিডিও
৬। কোনো নির্দিষ্ট খাবার
৭। কোনো নির্দিষ্ট পানীয় বা
৮। কোনো মিউজিক্যাল খেলনা।
এবার আপনাকে যা করতে হবে তা হচ্ছে তার এসব পছন্দনীয় বস্তু বা খেলনা বা বিষয়টির নিয়ন্ত্রণ নেয়া। শুরুতে এটি নিঃসন্দেহে একটি কঠিন কাজ হবে। কারণ, শিশুটিকে তার নিয়ন্ত্রিত পরিবেশের বাইরে আপনি নিয়ে আসছেন। তার পছন্দের বিষয় বা বস্তু বা খেলনা নিয়ে আপনি যেভাবে তার সঙ্গে কমিউনিকেট করার চেষ্টা করবেন তা যেন স্পেসিফিক হয়, সে যেন বোঝে যে আপনি কী চাচ্ছেন বা তাকে কী করতে বলছেন। তার সঙ্গে তার প্রিয় ওই বস্তু বা খেলনা বা বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে এমন কিছু খেলা বের করুন যাতে সেও অংশগ্রহণ করে।
আপনাকে আপনার শিশুর সামর্থ্য এবং সাধ্য অনুযায়ী নিজে নিজে পদ্ধতি বের করতে হবে। লক্ষ্য করুন, আপনি তার ওই খেলনা বা বস্তু নিয়ে কি কি আচরণ করলে সে আপনার দিকে তাকায় বা আপনি তার ওই জিনিষ নিয়ে কিছু করলে সেও আপনাকে অনুসরণ করছে কিনা।
অনেক অটিস্টিক শিশু ভিজ্যুয়াল লার্নার (দৃশ্য দেখে শিখে)। তাদের মনোযোগের অভাব বা কোনো কোনো সময়ে শ্রবণশক্তির সীমাবদ্ধতার জন্যে তারা তাদেরকে কিছু বললে সেটি তারা অনুকরণ করতে পারে না বা করে না। এজন্যে অটিস্টিক শিশুদের ক্ষেত্রে ভিজ্যুয়াল অ্যাপ্রোচ সাধারণত বেশি উপযোগী। এক্ষেত্রেও আপনাকে আপনার শিশুর পছন্দ অনুযায়ী পরিকল্পনা করতে হবে।
এ পদ্ধতিতে বিভিন্ন ছবি দিয়ে বা দৃশ্য দেখিয়ে তাকে ভার্বাল কমিউনিকেশনের প্রতি উৎসাহ তৈরি করাতে পারেন। ছোট ছোট কার্ডে ছবি প্রিন্ট করে সেগুলোকে লেমিনেট করে সেগুলো দিয়ে আপনি এটি করতে পারেন। ছবি প্রিন্ট করার সময় আপনাকে স্পেসিফিক হতে হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এ পদ্ধতিতে আমার শিশুর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে উপকৃত হয়েছি।
আমি প্লেয়িং কার্ড বা তাসের আকারের ৫টি কাগজে ১, ২, ৩, ৪ এবং ৫ নম্বরগুলো বড় বড় করে প্রিন্ট করিয়েছি। (প্রতি কার্ডে শুধু একটি করে সংখ্যা)। এরপর কার্ডগুলো পাশাপাশি ধারাবাহিকভাবে রেখে প্রতিটির উপর একটি আঙুল রেখে রেখে ১, ২, ৩, ৪, ৫ বলেছি। যখন যে কার্ডে আঙুল রাখি, তখন সেটিই উচ্চারণ করি। প্রথমে আমার অটিস্টিক মেয়ে এতে সাড়া দিচ্ছিল না। আমি যখনই দেখি যে সে একটু শান্ত হয়ে বসে আছে, তখনই তার সামনে কার্ডগুলো বিছিয়ে ১,২, ৩, ৪, ৫ বলে যাচ্ছি। এভাবে ২/৩ দিন পর আমি লক্ষ্য করলাম যে আমার আঙুলের সঙ্গে সঙ্গে তার দৃষ্টিও পরের কার্ডের দিকে যাচ্ছে। এতে আমি বুঝলাম যে সে এতে আগ্রহ নিচ্ছে। তখন আমি আরো কয়েকবার এক থেকে পাঁচ পর্যন্ত বলে তারপর তার ওপর পরীক্ষাটি চালালাম।
পরীক্ষাটি ছিল আমি আঙুল দিয়ে কার্ড স্পর্শ করে করে এক, দুই, তিন বলে পরের কার্ড যাতে চার লেখা আছে সেখানে আঙুল রেখে চুপ করে থাকলাম। তখন আমার মেয়ে কিছুক্ষণ সে কার্ডটির দিকে তাকিয়ে থেকে আধো স্বরে বলল, “চার”। এটি ছিল আমার এবং আমার মেয়ে- দুজনের জন্যে এক বিরাট সাফল্য। এ সাফল্যের ধারাবাহিকতায় পরে তাকে ইংরেজি বর্ণমালার বইয়ে একের পর এক বর্ণের ওপর স্পর্শ করে করে তাকে সকল বর্ণমালা শেখানো হয়েছে এবং সে এখন নিজে নিজে ইংরেজি পড়তে পারে।
এ কারণেই বলেছি যে, ভিজ্যুয়াল পদ্ধতি অটিস্টিক শিশুদের ক্ষেত্রে খুবই উপযোগী একটি পদ্ধতি। শিশু যে পদ্ধতিতে আনন্দ পায়, এরকম একটা পদ্ধতি বের করুন। আনন্দের ভেতর রেখে শেখানো সহজ। বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলুন এবং তার সাথে নিজের ক্রিয়েটিভ আইডিয়া প্রয়োগ করুন।
বোরহান মাহমুদ
borhan.mahmud@gmail.com
No comments:
Post a Comment