এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৮৫৮তম পর্বে উচ্চ রক্তচাপ বিষয়ে কথা বলেছেন ডা. উম্মে সালমা খান। বর্তমানে তিনি এমএইচ শমরিতা হাসপাতাল অ্যান্ড মেডিকেল কলেজের কার্ডিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।
৮০ থেকে ৯০ ভাগ উচ্চ রক্তচাপের কারণ অজানা
উচ্চ রক্তচাপ প্রচলিত একটি সমস্যা। এটি হলে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ইত্যাদি হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
প্রশ্ন : রক্তটাপ আসলে কী?
উত্তর : রক্তচাপ হলো মানবদেহের স্বাভাবিক একটি ঘটনা। যখন রক্তনালি দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হয়, এটা যে চাপ তৈরি করে রক্তনালির দেয়ালের ওপরে, এটাকে আমরা মেপে বলি রক্তচাপ। এর একটি স্বাভাবিক মাত্রা রয়েছে, যেমন—১৪০/৯০। ওপরেরটা ১৪০ ও নিচে ৯০ থাকলে আমরা সাধারণত বলি তার রক্তচাপ স্বাভাবিক রয়েছে। রক্তচাপ মাপার ক্ষেত্রে এটা অবশ্যই মাথায় রাখা উচিত।
এ সময় অবশ্যই তাকে বিশ্রামরত অবস্থায় মাপতে হবে। আমি দৌড়ে এসে মেপে ফেললাম, একটি কাজ করে মেপে ফেললাম, তাহলে কিন্তু রক্তচাপ মাপার নিয়মটা সঠিক হলো না।
প্রশ্ন : উচ্চ রক্তচাপের কারণ কী?
উত্তর : ৮০ থেকে ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, এর কোনো কারণ নেই। তবে এটি ছাড়াও কিছু জেনেটিক্যাল নির্দেশিকা থাকে, যেমন—বংশগত। উত্তরাধিকার সূত্রে কারো মা-বাবার রয়েছে, নানা-নানির ছিল বা দাদা-দাদির ছিল, তাহলে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে চলে আসতে পারে।
আবার যাদের বয়স একটু বেশি, তাদের হতে পারে। সাধারণত দেখা যায়, রক্তচাপ শুরু হয় ৪৫ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সে। যারা অনেক স্থূল বা মোটা, তাদের ক্ষেত্রেও রক্তচাপ হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। এগুলো সবই কিন্তু ঝুঁকির কারণ। সুনির্দিষ্ট করে কোনো কারণ বলা যাচ্ছে না।
আবার যাঁরা বেশি ধূমপান করেন, তাঁদের রক্তনালির দেয়ালে কিছু প্লাক জমে। সেটা হয়ে প্রেশার অনেক বেড়ে যায়। অনেকের অনেক খাওয়া-দাওয়ার অভ্যাসগত সমস্যা থাকতে পারে। যেমন—অনেক বেশি চর্বিযুক্ত খাবার খাচ্ছেন, ফাস্টফুড খাচ্ছেন, এর কারণেও উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
বর্তমানে আমরা অনেকে ডেস্কে কাজ করছি, যখন বাসায় যাচ্ছি, গাড়িতে চলে যাচ্ছি। এই যে সব সময় আমাদের বসে বসে কাজ করার একটি প্রবণতা, এটাও কিন্তু আমাদের উচ্চ রক্তচাপের আশঙ্কা অনেক বাড়িয়ে দেয়। এগুলোর সব কয়টা কারণই প্রাথমিক উচ্চ রক্তচাপ বা এসেনশিয়াল হাইপার টেনশন। এগুলোকে ঝুঁকির কারণ হিসেবে বলা হয়।
অনেকের কিডনির সমস্যা থেকে উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে। যেমন—কিডনির কিছু রক্তনালি রয়েছে, রেনাল আর্টারি বলি, এখানে বন্ধ হয়ে গেলে রক্তচাপ হতে পারে। কিডনির নিজস্ব কিছু রোগ রয়েছে। যেমন : গ্লুমারোলোনিউ নেফ্রাইটিস। এসব রোগের জটিলতা থেকে উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে। কিছু অ্যান্ডোক্রাইনের রোগের কারণে সমস্যা হতে পারে।
থাইরয়েডের বিষয়টি সবাই জানেন। সেই থাইরয়েড হরমোনের যদি কোনো ভারসাম্যহীনতা হয়, সেখান থেকেও হতে পারে। এ রকম বেশ কিছু কারণও রয়েছে। কিছু ওষুধ থেকে হতে পারে। যেমন—আমরা প্রায়ই আর্থ্রাইটিসের জন্য ব্যথার ওষুধ খাই, কেউ কেউ হয়তো অ্যাজমা বা হাঁপানির জন্য দীর্ঘদিন ধরে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ খান, সেসবের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে উচ্চ রক্তচাপ আসতে পারে।
উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ জানেন?
সাধারণত উচ্চ রক্তচাপের কোনো লক্ষণ নেই। তবে একটু অস্বস্তি, ক্লান্তিবোধ ইত্যাদি থাকতে পারে।
প্রশ্ন : উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ কী?
উত্তর : মজার বিষয় হলো, অধিকাংশ ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের কোনো লক্ষণ নেই। হয়তো অন্য কোনো কারণে চিকিৎসকের কাছে এলো, রোগীর হয়তো কাশি হয়েছে বা একটু জ্বর হয়েছে, তখন চিকিৎসক রক্তচাপ মেপে দেখেন রোগীর প্রেশারটি হাই। তবে কিছু কিছু রোগীর ক্ষেত্রে দেখা যায় ঘাড়ে ব্যথা, মাথাব্যথা, মাথা ঘোরানো অথবা বুক ধড়ফড় হতে পারে অথবা অস্বস্তি হতে পারে। রোগী হয়তো কাজ করতে গেলে দুর্বল বোধ করছেন। ভালো লাগছে না, অস্থির লাগছে। এ রকম লক্ষণ নিয়েও আমাদের কাছে আসে। এমনকি অনেক সময় বুকে ব্যথা নিয়েও আসতে পারে।
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের উপায়
উচ্চ রক্তচাপ থেকে স্ট্রোক, হার্টের সমস্যা, এমনকি কিডনির সমস্যা হতে পারে। তাই উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি।
প্রশ্ন : অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ কমাতে পরামর্শ কী?
উত্তর : এখানে কিছু বিষয় রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো কিছু রোগী হয়তো ওষুধ খাচ্ছে না। কিছু রোগী রয়েছে হয়তো ওষুধ খেয়েছে, মাঝখানে ছেড়ে দিয়েছে। তখন ওই ওষুধ আর কাজ করে না। আবার কিছু রোগীর জীবনযাপনের ধরনের পরিবর্তন দরকার। আরো দেখা যায়, রোগীর কিছু সেকেন্ডারি বিষয় থাকে, যেমন : উনি হয়তো খাবারে বাড়তি লবণ খান। এটা হয়তো আমরা কেউ জানি না। উনাকে যদি বলা হয়, ‘কাঁচা লবণ খাবেন না’, উনি বলেন, ‘আমি ভেজে খেয়েছি।’ অভ্যাসটি আমাদের তৈরি করে দিতে হবে। বোঝাতে হবে আপনি কাঁচা বা ভাজা কোনো লবণই খাবেন না। এমনকি তরকারিতেও বেশি লবণ খাবেন না। আসলে কোনো লবণই তার জন্য অতখানি ভালো নয়। এই সোডিয়াম প্রেশার বাড়ার ক্ষেত্রে অন্যতম হিসেবে কাজ করে।
এর পরে আমরা কিছু বিষয় দেখি। যেমন তার কিডনি সমস্যা রয়েছে কি না, তার অ্যান্ড্রোক্রাইনের কোনো সমস্যা রয়েছে কি না, থাইরয়েডের সমস্যা রয়েছে কি না, রোগী সন্তানসম্ভবা কি না। এই জিনিসগুলোকে তখন আমরা বের করার চেষ্টা করি।
তখন আমরা বলি, ‘প্রতিদিন হাঁটবেন। অন্তত সপ্তাহে পাঁচ দিন তিনি ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট হাঁটবেন। এতে দেখা যায়, সিস্টোলিক ব্লাড প্রেশার ১৫ থেকে ২০ মিলিমিটার কমে আসে।’ বলি, ‘লবণ খাবেন না। পাশাপাশি যেই ওষুধ দেওয়া হচ্ছে সেটি নিয়মিত খাবেন। নির্দিষ্ট একটি সময় পর পর ফলোআপে আসবেন।’ এটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
অল্প বয়সে উচ্চ রক্তচাপ?
এখন অনেকেরই অল্প বয়সে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা দেখা দেয়।
এর কারণ কী?
প্রশ্ন : অল্প বয়সের ব্যক্তিদেরও এখন উচ্চ রক্তচাপ হচ্ছে। এটি কেন?
উত্তর : অনেকেরই অল্প বয়সে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা হচ্ছে। অনেকে হয়তো ফাস্ট ফুড খেয়ে অভ্যস্ত। সেডেন্টারি কাজ করে অভ্যস্ত। এখন সবাই ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে থাকতে অভ্যস্ত। আমরা আগে মাঠে দৌড়াতাম, খেলতাম। সেই বিষয়টি কিন্তু এখন নেই। কম্পিউটার বেজ ভিডিও গেম নিয়ে আমরা ব্যস্ত হয়ে থাকি। আবার কিছু অসচেতনতা রয়েছে আমাদের মধ্যে। খাওয়ার ক্ষেত্রে আমরা অনেক বেশি ফাস্ট ফুডের দিকে ঝুঁকে পড়েছি। ফাস্ট ফুড এখন একটি বিনোদনে পরিণত হয়েছে।
খাবার খাওয়ার অভ্যাসের ক্ষেত্রেও কিছু সমস্যা রয়েছে। আমরাতো চর্বিযুক্ত খাবার খাচ্ছি বেশি। বাবা ও মা দুজনেই যদি হাইপার টেনসিভ হন,বাচ্চার ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপ আগেভাগে হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ধারণা করা হয়, এসব কারণে এখন অল্প বয়সে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা হচ্ছে।
উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ খেতে ভীতি?
উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ দীর্ঘদিন খেতে হয় বলে, এটি নিয়ে অনেকের মধ্যে ভীতি দেখা যায়।
প্রশ্ন : উচ্চ রক্তচাপ কমাতে প্রথম পরামর্শ কী থাকে রোগীর প্রতি?
উত্তর : প্রথম যখন একজন রোগী এসে বলে, ‘খারাপ লাগছে’ বা আমরা যদি এটি পেয়ে যাই,আমরা সাধারণত প্রথম দেখাতেই ওষুধ দেওয়া অপছন্দ করি বা দিতে চাই না। কারণ, অনেক সময় দেখা যায় চিকিৎসকের কাছে এলেও রোগী একটু অস্থির থাকে বা দুশ্চিন্তা বোধ করে।
অনেক বেশি না হওয়া পর্যন্ত আমরা সাধারণত চেষ্টা করি রোগীর কোনো সমস্যা আছে কি না সেটি দেখার জন্য। যেমন : উদ্বেগ রয়েছে কি না বা রোগী আগে উচ্চ রক্তচাপে ভুগত কি না- এসব। অনেকে ওষুধ খেয়ে মাঝখানে আবার ওষুধ ছেড়ে দেয়- সেই রকম কোনো ইতিহাস আছে কি না- সেটি দেখি। এ রকম কোনো ইতিহাস না থাকলে আমরা সাধারণত রোগীকে এনজিওলাইটিক দিয়ে দেই অথবা পরে আমাদের কাছে ভিজিটের জন্য একটি তারিখ ঠিক করে দেই। তখন যদি আমরা দেখি তার প্রেশারটা বেশি, তখন আমরা তাকে ওষুধ শুরু করার জন্য একটি চিন্তা করি।
প্রশ্ন : আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখি রোগীদের মধ্যে ওষুধ খাওয়ার প্রবণতা কম থাকে। কারণ, তাদের ধারণা থাকে এটি সারা জীবন খেতে হয়। আসলেই তাই। এ কারণে তারা ওষুটা আর শুরু করতে চান না। এ ক্ষেত্রে আপনারা কী পরামর্শ দেন?
উত্তর : আমাদের কাছে সত্যিই এ রকম রোগী আসে, অনেক রোগী আসে। দেখা যায় অনেকে বলে, ‘ম্যাডাম উচ্চ রক্তচাপ ছিল, আমি মাঝে মাঝে ওষুধ খেয়ে ছেড়ে দেই। একবার খেলে আমাকে খেয়েই যেতে হবে।’ তখন দেখা যায় তাকে কিছু পরামর্শ বা কিছু কথা আমরা বলি। তাকে বলি, উচ্চ রক্তচাপের ওষুধটা না খেলে রক্তচাপ যদি অনেকদিন থাকে, তাহলে কী কী সমস্যা হতে পারে। সাধারণত অনেক ধরনের সমস্যা হয়। হার্ট অ্যাটাক হতে পারে, স্ট্রোক হয়ে প্যারালাইসিস হয়ে বিছানায় পড়ে থাকতে পারে, তার কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, হাতে বা পায়ে কোনো জায়গায় বা শিরায় ব্লক হতে পারে। সেই ক্ষেত্রে রোগী হয়তো পায়ের ব্যথা নিয়েও আসতে পারে।
এমনকি এটাও হয়, অনেকে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে আসছে, তারা হয়তো ওষুধ খেয়ে ছেড়ে দিয়েছে। যখন সে ওষুধ ছেড়ে দেয়, আমরা যখন আরেকবার সেই ওষুধ ধরতে চাই, তখন সেই ওষুধটি সাধারণত একই ডোজে কাজ করতে চায় না। তখন দেখা যায় ওষুধের ডোজ আরো বাড়িয়ে দিতে হয় বা অন্য কোনো ডাবল ডোজে চলে যেতে হয় বা অন্য কোনো ওষুধ যোগ করতে হয়। এগুলো বুঝিয়ে বললে কিন্তু রোগীরা শোনে। সুস্বাস্থ্যের জন্য ভীতি কাটিয়ে এই ওষুধগুলো নিয়মিত খাওয়া উচিত।
No comments:
Post a Comment