স্তন ক্যানসার কেন হয়, লক্ষণগুলো কেমন? স্তন ক্যানসারের চিকিৎসা কীভাবে হয়?
স্তন ক্যানসার নিয়ে অনেকেই উদ্বিগ্ন থাকেন। তবে স্তন ক্যানসারের চিকিৎসা পূর্ণাঙ্গভাবে প্রাথমিক পর্যায়ে করতে পারলে ফলাফল অনেক ভালো আসে। এনটিভির নিয়মিত আয়োজন ‘স্বাস্থ্য প্রতিদিন’ অনুষ্ঠানের ২৫৪৩তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ডা. মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন। বর্তমানে তিনি জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটের ক্যানসার এপিডেমিওলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও বাংলাদেশ স্তন ক্যানসার সচেতনতা ফোরামের প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করছেন।
স্তন ক্যানসারের কারণ ও লক্ষণ
স্তন ক্যানসারের বিভিন্ন কারণ রয়েছে। কিছু নিয়ন্ত্রণযোগ্য, কিছু নিয়ন্ত্রণযোগ্য নয়। তবে লক্ষণ বুঝে দ্রুত চিকিৎসা করতে পারলে এর ফল ভালো আসে।
প্রশ্ন : স্তন ক্যানসারের কারণ কী?
উত্তর : অবশ্যই, এই জানার বিষয়টি আমি বলতে চাই। প্রথমে জানা দরকার স্তন ক্যানসার হওয়ার কারণগুলো। দুই রকম কারণ রয়েছে। কিছু আছে আমাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। আমরা চাইলেই আমাদের জীবনযাপনে কিছু পরিবর্তন আনতে পারি, এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। তবে দুঃখজনকভাবে স্তন ক্যানসারের এমন কিছু ঝুঁকির কারণ রয়েছে, যেগুলোর ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই।
নারী মা হয়, এটা একটা বড় প্রাপ্তি। আবার নারী হওয়ার কারণে স্তন ক্যানসারের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। পুরুষদেরও এই ক্যানসার হয়। তবে নারীদের মধ্যে হওয়ার আশঙ্কা শতকরা শতগুণ বেশি। এর পর বয়স; বয়স যত বাড়তে থাকবে, স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি তত বাড়তে থাকবে।
পশ্চিমা বিশ্বে পঞ্চাশের পর সবচেয়ে বেশি হয়। বাংলাদেশে অজানা কারণে ৪০ থেকে ৫০ বছরের নারীদের মধ্যে এই সমস্যা সাধারণত সবচেয়ে বেশি হয়। এর কারণটা আমাদের জানা দরকার। তাই বয়স যদি বাড়তে থাকে, আমাকে সচেতন হতে হবে। তিন নম্বর হলো, খুব অল্প বয়সে যাদের ঋতুস্রাব হয় এবং যাদের খুব দেরিতে পিরিয়ডটা বন্ধ হয়, তাদের মধ্যে একটু ঝুঁকিটা বেশি। আর কিছু জিনগত কারণ আছে। বিআরসি ওয়ান ও টু নামে দুটো জিন আছে, যেগুলোর অস্বাভাবিকতার কারণে এই স্তন ক্যানসার হয়। একটু জটিল বিষয়। তাও একটু বলে রাখলাম। এগুলোর ওপর আমাদের কোনো হাত নেই। মা, খালা, বড় বোন, নানি, অর্থাৎ মায়ের দিকের কোনো নিকটাত্মীয়ের যদি স্তন ক্যানসার হওয়ার ইতিহাস থাকে, তার মধ্যে হওয়ার একটি ঝুঁকি রয়েছে। যাদের এই ঝুঁকিটা বেশি, তাকে আগে থেকে সতর্ক হতে হবে।
আর কিছু কিছু আছে, আমরা চাইলে পরিবর্তন আনতে পারি। আমরা কিন্তু অল্প বয়সে বিয়ে কখনোই সমর্থন করি না। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন করতে চাই। কারণ, জরায়ুর ক্যানসারের জন্য দায়ী অল্প বয়সে বিয়ে হওয়া। আর খুব বেশি বয়সে বিয়ে হলে, ত্রিশের পরে যদি বিয়ে ও বাচ্চা হয়, তখন স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে। কাজেই আমাদের সময়ের কাজ সময়ে করতে হবে। যাদের কোনো কারণে সন্তান হয়নি বা বিয়ে হয়নি, তাদের মধ্যে এই ঝুঁকি একটু বেশি থাকে। তবে সবকিছু হয়তো ঠিকমতো হলো, তবে একটি ভুলের কারণে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকির মধ্যে আপনি পড়ে যাবেন। সেটা হলো, বাচ্চাকে যদি আপনি বুকের দুধ না খাওয়ান। এতে দুজনের ক্ষতি। বাচ্চার ক্ষতি, তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হবে না। আর আপনার স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়বে। এই কথাগুলো আমরা বলতে চাই। যারা প্রাণিজ আমিষ ও চর্বিজাতীয় খাবার বেশি খায়, আর যারা শারীরিক পরিশ্রম করেন না, এই দলের একটু বেশি মুটিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এতে ইসট্রোজেন ডিসেপটরের সংখ্যা বাড়ে। এর সঙ্গে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি আছে।
তাহলে কী করতে হবে? প্রাণিজ আমিষ একটু কম খেতে হবে। একটু ফলমূল ও শাকসবজি খেতে হবে। হালকা ব্যায়াম করতে হবে। আরেকটি বিষয় আছে যে অনেকেরই জরায়ুর অস্ত্রোপচার হয়ে গেছে অথবা মেনোপজের পরে সমস্যা হচ্ছে, তখন আমরা হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি দিই। এটা আবার অনেক দিন একটানা থাকলে পরে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে। তো, এই ধরনের কিছু কারণ আছে। এগুলোর ক্ষেত্রে আমরা একটু পরিবর্তন আনতে পারি।
প্রথমে সচেতনতা। একই সঙ্গে কীভাবে রোগটি তাড়াতাড়ি নির্ণয় করা যায়, সে বিষয়ে সচেতনতা দরকার।
স্তন ক্যানসারের লক্ষণ বুঝতে হবে। চাকা বা পিণ্ড যদি থাকে, সেটা স্তনেও হতে পারে, আবার বগলেও হতে পারে, নিচের গ্রন্থি বা কণ্ঠের হাড়ের গ্রন্থিও কিন্তু ফুলে যেতে পারে।
পাশাপাশি চামড়ার মধ্যে যদি কোনো পরিবর্তন হয়, যেমন কুঁচকানো বা ছোট ছোট গর্তের মতো, নিপল যদি ভেতরে ঢুকে থাকে (অবশ্য অল্প বয়সের মেয়েদের কিন্তু এমনি এটা হয়, এটি সমস্যা নয়, যদি অন্য কোনো সমস্যা না থাকে), আর যদি রক্ত অথবা কষজাতীয় কিছু বের হয়, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। এটুকু যদি আমরা করতে পারি। মানুষের মধ্যে যদি এর সচেতনতা আনতে পারি, তাহলে অনেক লাভ। তাড়াতাড়ি ধরা পড়লে তার অস্ত্রোপচারটা অল্পতেই হবে। তার পরে রেডিও বা কেমোথেরাপি চিকিৎসায় তার কষ্ট কম হবে। ব্যয় কম হবে। এবং তার সুস্থ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। আমরা তো বলি, যদি প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়ে, সঠিক সময়ে যদি পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা হয়, তাহলে ভালো হয়।
প্রশ্ন : স্তন ক্যানসারের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা মানে কী?
উত্তর : অনেক চিকিৎসক মিলে এই চিকিৎসা করেন। টিউমারের আকার কত বড়, গ্রন্থি কত বড়, শরীরের অন্য কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে কি না—এগুলো সবকিছু দেখে চিকিৎসকরা একটি পরিকল্পনা করেন, এই রোগীর এই এই চিকিৎসা লাগবে। সমন্বয় লাগতে পারেন। রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপি, অস্ত্রোপচার লাগতে পারে। আবার হরমোনও খেতে হয় অনেককে। এখন আমরা অস্ত্রোপচার করে দিলাম, টিউমার নেই। এখন সে বাড়িতে চলে যেতে পারে।
প্রশ্ন : রোগীদের এ সময় কাউন্সেলিং দেওয়া কতটা জরুরি?
উত্তর : চিকিৎসকদের একটি প্রাথমিক দায়িত্ব হলো চিকিৎসার পাশাপাশি এটি দিতেই হবে। এগুলো নিয়ে সব পর্যায়ে সচেতনতা দরকার। আমরা এই জিনিসকে সামনে আনতে চাই। আর চিকিৎসার বিষয়ে আমরা বলি যে প্রাথমিক অবস্থায় যদি ধরা পড়ে অল্প চিকিৎসায়, সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। খরচ কম, শারীরিক কষ্ট কম।
লক্ষণ দেখা দেওয়ার আগেই যদি আমরা একটু সচেতন হই, স্ক্রিনিং করতে পারি। একটি ম্যামোগ্রাম, আমাদের দেশে এটি এতটা নেই। আমাদের দেশে আলট্রাসনোগ্রাম দিয়েও একটু পূরণ করা যায়, আরেকটি হলো ক্লিনিক্যাল ব্রেস্ট এক্সামিনেশন। ডাক্তারকে দিয়ে স্তন পরীক্ষা করা। তারও আগে নিজে নিজে স্তন পরীক্ষা। এটি প্রত্যেক নারী করবেন। ঋতুস্রাব শেষ হওয়ার সাত দিনের মধ্যে একটি দিন ঠিক করবেন, প্রতি মাসে ওই একই দিনে করবেন। এ বছর চতুর্থবারের মতো ১০ অক্টোবর স্তন ক্যানসার সচেতনতা দিবস পালিত হয়েছে। সারা অক্টোবর আমরা কাজ করেছি। আমরা মানুষের মধ্যে আগের থেকে অনেক বেশি সাড়া পাচ্ছি। সবাই যদি এই বিষয়টি ধারণ করতে পারি, খুব তাড়াতাড়ি স্তন ক্যানসারের বিষয়ে রোগীরা আরো সচেতন হবে।