৩ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে ব্যবসা শুরু
ইফতেখার আহমেদ টিপু। একজন আত্মপ্রত্যয়ী, দৃঢ়চেতা, প্রাজ্ঞ, প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতি। সততা, মেধা, নিষ্ঠা, অধ্যবসায় এবং দূরদৃষ্টির কারণে
ইফাদ গ্রুপ আজ উন্নতির শিখরে। কর্মচঞ্চল বিজনেসম্যান। সততা ও নিষ্ঠার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, যদি এমন কোনো বড় ব্যবসায়ীর নাম বলা হয় তাদের মধ্যে তিনি একজন। ইন্ডাস্ট্রিয়াল এবং ব্যাংকিং সেক্টরেও তার সুনাম ও গ্রহণযোগ্যতা সর্বজনবিদিত। আজ থেকে ৩০ বছর আগে যাত্রা শুরু করেছিলেন একটি ছোট ট্রেডিং কোম্পানি দিয়ে। পুঁজি ছিল মাত্র ৩ লাখ টাকা। এখন গ্রুপের কোম্পানির সংখ্যা ৯টি।
কাজ করছেন ৭ হাজার কর্মী। বিদেশে পণ্য রপ্তানি করে আয় করছেন বৈদেশিক মুদ্রা। ইফাদ গ্রুপের সাফল্যের সিঁড়ি নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন আব্দুল্লাহ কাফি
স্বাধীনতার পর কিছু একটা করার ইচ্ছায় ১৯৭২ সালে ৫ জন মিলে ব্যবসা শরু করেছিলেন বর্তমানে ইফাদ গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রাণপুরুষ ইফতেখার আহমেদ টিপু। কিন্তু বেশি দূর এগোতে পারেননি। ব্যবসার মুনাফার টাকা ঠিকমতো পাচ্ছিলেন না বলে তিনি ওখান থেকে সরে আসেন। এর পর এদিক-সেদিক অনেক কিছু করেছেন। কোনোটিই তার ভালো লাগেনি। নিজের চিন্তা ছিল ব্যবসা করবেন। মানুষের কর্মসংস্থান হবে। দেশের জন্য অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবেন। সেই লক্ষ্য থেকে ১৯৮৫ সালে নিজেই শুরু করেন আবার ব্যবসা। এবার ব্যবসা শুরু করেন ধার করা পুঁজিতে। শুরুতে ছোট ভাই, ভগ্নিপতি ও বন্ধুর কাছ থেকে ধার করে মাত্র ৩ লাখ টাকা নিয়ে কাজ শুরু করেন। ইফাদ এন্টারপ্রাইজ নামে শুরুতে মাত্র ১২ জন জনবল নিয়ে ইলেক্ট্রনিক সরঞ্জাম আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে সরবরাহ করতেন। অন্যরা যা কাজ করত নিজে করতেন তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। সেই থেকে যে শুরু আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। দিনের পরিক্রমায় ইফাদ গ্রুপের কলেবর বাড়তে থাকে। বর্তমানে এর শিল্প ইউনিটের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯টিতে। আরও ২টি কোম্পানি স্থাপনের প্রস্তুতি চলছে। ১২ জন থেকে এখন কর্মীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজারে। এর বাইরে আরও রয়েছেন পরোক্ষ কর্মী।
প্রায় সব খাতেই ইফাদ গ্রুপ এখন তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ইফাদ অটোস, ইফাদ এগ্রো কমপ্লেক্স, ইফাদ মাল্টি প্রোডাক্টস, ইফাদ সলট অ্যান্ড কেমিক্যালস। ইফাদ আইটি ও ইফাদ মটরস নামে আরও দুটি কোম্পানি নিয়ে আসছে তারা। এছাড়াও ভারতের বিখ্যাত গাড়ি প্রস্তুতকারক কোম্পানি অশোক লিল্যান্ডের পরিবেশক হিসাবেও কাজ করছে তারা। অতুল ব্র্যান্ডের বাস-ট্রাক বাজারজাত করার কাজও শুরু করেছে। বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি আমদানি করে সেগুলো দিয়ে বাস-ট্রাকের বডি তৈরি করে বাজারজাত করছে। তাদের স্বপ্ন দেশে নিজস্ব প্রযুক্তিতে গাড়ি তৈরি করে সেগুলো বিক্রি করবে।
ইফাদ গ্রুপের চেয়ারম্যান ইফতেখার আহমেদ টিপু আক্ষেপ করে বলেন, স্বাধীনতার ৪৪ বছর হয়েছে, এই সময়েও আমরা একটি গাড়ি তৈরির কোম্পানি করতে পারিনি। এই খাতে আমাদের নিজস্ব কোনো ব্র্যান্ড নেই। আমাদের রাস্তায় হাজার হাজার গাড়ি চলছে, সবই বিদেশি ব্র্যান্ডের। এটা হতে পারে না। ইফাদ গ্রুপ অবশ্যই এখানে দেশি ব্র্যান্ডের গাড়ি নিয়ে আসবে। সেই লক্ষ্যেই আমরা কাজ করছি। এ খাতে প্রয়োজনে দেশি-বিদেশি সহায়তা নেওয়া হবে।
১৯৪৯ সালে নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন ইফতেখার আহমেদ। ৭ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি। বাবা জালাল আহমেদ সরকারি চাকরিজীবী হওয়ার কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তিনি থেকেছেন। বাবার চাকরিসূত্রে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন রংপুরে। ১৯৫৩ সালে আসেন ঢাকায়। এর পরে ঢাকাতেই বড় হওয়া।
ইফাদ গ্রুপের প্রতিষ্ঠা থেকে এখনো চেয়ারম্যান হিসেবেই রয়েছেন। তবে তিনি শ্রমিকের কাজ থেকে শুরু করে সব কাজই এখনো করেন।
দৃঢ়তার সঙ্গে তিনি বলেন, যে কোনো কাজে আন্তরিকতা ও ইচ্ছাশক্তি থাকলে এবং সে লক্ষ্যে শ্রম দিলে মাঝেমধ্যে ব্যর্থতা এলেও এক সময়ে গিয়ে সফলতা আসবেই। যেমনটি এসেছে ইফাদ গ্রুপের প্রতিষ্টা ও এর সফলতা থেকে।
শুরুতে ব্যবসায় সফল না হওয়ার প্রসঙ্গে তিনি জানান, ওই সময়েই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যৌথভাবে আর ব্যবসা করবেন না। যে কারণে সফল হয়েছেন। পরে অবশ্য শুরুর ব্যবসায়িক অংশীদারদের অনেকেই ইফাদ গ্রুপে চাকরির জন্য এসেছিলেন।
এখন শুধু নিজেই গ্রুপের কাজ করছেন না। ৩ ছেলে আর সহধর্মিণী কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের প্রত্যেককে কাজ ভাগ করে দেওয়া আছে। ফলে তারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে দক্ষ কর্মী ও ব্যবস্থাপক হয়ে উঠছেন।
সাভারের আশুলিয়ার জিরাবোতে ইফাদ গ্রুপ স্থাপন করেছে শিল্পপার্ক। ওখানে রয়েছে তাদের বিভিন্ন শিল্প ইউনিট। তাদের কারখানায় উৎপাদিত পণ্য দেশের বাজারে সরবরাহের পাশাপাশি ২৬টি দেশে রফতানি করা হচ্ছে। তারা দেশের ১৭টি ব্যাংক ও ১৫ লিজিং কোম্পানির সঙ্গে আর্থিক লেনদেন করছে। একই সঙ্গে ৫৯টি ব্যবসায়ী কোম্পানির সঙ্গে বিভিন্ন পণ্যের আদান-প্রদান করছে।
তিনি জানান, দেশের একজন সফল ব্যবসায়ী হয়ে ওঠার পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখেছে তার পরিশ্রম আর মেধা। বাকিটুকু সবার প্রচেষ্টা। বর্তমানে ব্যবসায়িক লেনদেন থেকে সরকারকে নিয়মিত রাজস্ব দেওয়ার পাশাপাশি দরিদ্র অসহায়-অসুস্থ মানুষের সাহায়তায় সামাজিক দায়বদ্ধতার কাজও করছেন। এর আওতায় পথশিশু, প্রতিবন্ধী শিশু, স্কুল, কলেজসহ বিভিন্ন সামাজিক কাজে গ্রুপের মুনাফার অর্থের একটি অংশ ব্যয় করছেন। রাজধানীর আজিজ সুপার মার্কেস্থ পথশিশু স্কুল, হাতিরঝিল পথশিশু স্কুল তাদের অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত। এছাড়াও নিজ কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নানাভাবে সহায়তা করেন।
গ্রুপের কার্যক্রমের মাধ্যমে অর্থনীতিতে বিশেষ অবদানের জন্য পুরস্কারও পেয়েছেন বেশ কয়েকটি। ব্যবসায়িক শত ব্যবস্তার মধ্যেও তিনি লেখালেখি চালিয়ে যাচ্ছেন। তার প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সময়ের প্রতিচ্ছবি, সময়ের কণ্ঠস্বর, সময়ের প্রতিধ্বনি, সময়ের দর্পণ প্রভৃতি। এবছর বইমেলায় এসেছে ‘সময়ের হালচাল’। তার মতো অন্যদের সফল হতে কী করতে হবে এমন প্রশ্নের জবাবে ইফতেখার আহমেদ বলেন, তার সফল হওয়ার পেছনের শক্তি হচ্ছে সততা, নিষ্ঠা, মনবল ও অন্যকে না ঠকানোর প্রতিজ্ঞা। এসব অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করলে যে কেউ যে কোনো কাজে সফল হতে পারবে।
আজকে ইফাদ গ্রুপের অনেক বড় অবস্থাান হলেও শুরুতে ছিল খুবই ছোট। ১৯৮৫ সালে দরপত্রের মাধ্যমে ইলেকট্রিক পণ্য সরবরাহ করার মাধ্যমে ব্যবসা শুরু। তারপর নিজেরা পণ্য তৈরির দিকে হাত দেন। প্রথমে ভারতে গিয়ে দেখে আসেন বেবিট্যাক্সি নির্মাণ কৌশল। পরে বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি এনে এগুলো দেশে তৈরি করে বাজারজাত শুরু করেন ১৯৮৭ সালে। এর পরে হংকং থেকে এসির সরঞ্জামাদি এনে দেশে তৈরি করা শুরু করেন। ১৯৮৮ সালের শেষের দিকে ভারতের অশোক লেল্যান্ড কোম্পানির বাংলাদেশের এজেন্ট হয়ে বাস আমদানি শুরু করেন। প্রথমে অল্প করে আনতে থাকেন। পরে এগুলোর চাহিদা বাড়ায় ব্যাপকভাবে একতলা, দ্বিতলসহ বিভিন্ন ধরনের বাস আমদানি ও বিক্রি করেন। পাশাপাশি ট্রাক আমদানি ও বিক্রি করতে শুরু করেন। বাংলাদেশ সরকারের বিআরটিসির সঙ্গে যুক্ত হয়ে একতলা, দ্বিতল, এসি ও নন-এসি বাস সরবরাহ করেন। এসব গাড়ি সংস্কারের জন্য দেশে ২৮টি সার্ভিসিং সেন্টার রয়েছে।
২০০৩ সালে ভালুকায় প্রতিষ্ঠা করেন দেশের সবচেয়ে বড় মাছের হ্যাচারি ইফাদ এগ্রো কমপ্লেক্স। ২৫টি বড় পুকুর ও ৪০টি হাউজ রয়েছে এতে। ২০০৪ সালে আশুলিয়ার জিরাবো এলাকায় ইফাদ মাল্টি প্রোডাক্ট কোম্পানির কাজ হাতে নেন এবং ২০০৭ সালে এর উৎপাদন শুরু করেন। এতে বিভিন্ন ধরনের খাদ্যসামগ্রী উৎপাদন হচ্ছে।
বছরে ৪ হাজার বাস-ট্রাক অ্যাসম্বলিং করবে ইফাদ অটোস।
দেশে প্রথমবারের মতো বড় বড় যানবাহন অ্যাসম্বলিং করতে যাচ্ছে ইফাদ গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইফাদ অটোস। বছরে ৪ হাজার গাড়ি অ্যাসেম্বলিং করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে ধামরাইয়ে ৭০ বিঘা জমির ওপর ‘ইফাদ অটো ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল পার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। যার কাজ এখন পুরোদমে চলছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে পুরো মাত্রায় উৎপাদন শুরু করতে পারবে বলে আশা করছে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। এ পার্কে এখন ৬৫০ জন কর্মরত আছেন। এর মধ্যে ৯০ ভাগই বাংলাদেশি, বাকিরা ভারতীয়। আগামীতে আরও প্রায় দেড় হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বর্তমানে ইফাদ গ্রুপের বার্ষিক টার্নওভার ৮৪০ কোটি টাকা। নতুন বছরে আরও বেশি টার্নওভার করার পরিকল্পনা রয়েছে।
অটোমোবাইল শিল্পে নতুনত্ব আনতে কাজ করছে ইফাদ গ্রুপ। সংশ্লিষ্টরা জানান, গাড়ি অ্যাসেম্বলির ক্ষেত্রে ভারত থেকে শুধু ইঞ্জিন আনা হবে। বাকি এক্সেসরিজ (রেক্সিন, রং, লাইট, ফোম, শিটসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য) স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা হবে। ট্রাক এবং বাসের পুরো বডি অ্যাসেম্বলিং করা হবে। একই সঙ্গে ট্রলি, পিক-আপের বডি এবং চেসিস অটোমেশন পদ্ধতিতে তৈরি করা হবে। পাশাপাশি অতুল ব্র্যান্ডের অটোরিক্সা তৈরি ও বাজারজাত করবে কোম্পানিটি।
© DainikAmaderShomoy
No comments:
Post a Comment