খাদিজা যখন মাটিতে পড়ে গোঙাচ্ছিল তখন অন্যরা প্রাণপণে দৌড়াচ্ছিল। কেউ তাকে রক্ষায় এগিয়ে যাওয়ার সাহস পায়নি। কিন্তু একজনই ছিল সাহসী। ছুটে গেলো খাদিজার রক্তমাখা দেহের পাশে। গিয়েই বীভৎসতা দেখে চিৎকার শুরু করলো। চিৎকার করে বললো-‘আপনারা আসুন। মেয়েটি মারা যাচ্ছে। হাসপাতালে নিতে হবে।’ প্রথমে কেউ সাড়া দেয়নি। যখন হামলাকারীকে আটক করা হলো তখন এগিয়ে এলেন আরো দুই যুবক। তারাই খাদিজার রক্তমাখা দেহ নিয়ে হাসপাতালে আসেন। সাহসী ওই তরুণের নাম মোহাম্মদ ইমরান কবির। খাদিজাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েই দায়িত্ব শেষ হয়নি। রক্তমাখা জামা-কাপড় নিয়ে এক ব্যাগ রক্ত দেন খাদিজাকে। আর হাসপাতালে চিৎকার করেই বলছিলেন- ‘আপুকে বাঁচান। উনি মারা যাচ্ছেন।’ ইমরান কবির খাদিজাকে চিনেন না। বয়স বেশি নয়। ২০১৫ সালে এইচএসসি পাস করার পর ভালো সাবজেক্ট না পাওয়ায় কোথাও ভর্তি হননি। এবার ভালো সাবজেক্টের জন্য ফের ভর্তি পরীক্ষা দেবেন। ইমরান ঘটনার দিন এমসি কলেজে গিয়েছিল ঘুরতে। বিকাল ৫টার পর হঠাৎ চিৎকার শুনে দৌড়ে যান। গিয়ে দেখেন বদরুল খাদিজাকে কোপাচ্ছে আর দূর থেকে অনেকেই দাঁড়িয়ে দেখছে। খাদিজার সঙ্গে ছাত্রীরা দৌড়াচ্ছে আর চিৎকার করছে। প্রথমে একটু থমকে দাঁড়িয়েছিলেন ইমরান। পরক্ষণেই দৌড় দেন খাদিজার দিকে। এই ফাঁকে বদরুলও খাদিজাকে ছেড়ে দিয়ে পালানোর চেষ্টা করছিল। ইমরান দৌড়ে গিয়ে দেখেন রক্তাক্ত শরীর নিয়ে খাদিজা মাটিতে পড়ে গোঙাচ্ছে। ইমরান তখনই খাদিজার মাথা তার কোলে তুলে চিৎকার শুরু করেন। বলেন, আপনারা আসুন। মেয়েটি মারা যাচ্ছে। হাসপাতালে নিতে হবে।’ কিন্তু তার কথায় তখন কেউ কর্ণপাত করছিলেন না। কেউ এগিয়ে আসছিলেন না। তখন এমসি কলেজেরই এক ছাত্র মাহফুজ সহ অপর আরেকজন এগিয়ে এলেন। তারা তিনজনই ধরাধরি করে সিএনজি অটোরিকশাতে তুলে নিয়ে গেলেন হাসপাতালে। হাসপাতালে যাওয়ার পথে খাদিজার মাথা ছিল ইমরানের কোলেই।
ইমরান জানান, ‘খাদিজা আপুর মাথা ছিল ক্ষত-বিক্ষত। মাথার দিকে চাওয়ার ধৈর্য ছিল না। মাথা সহ শরীর থেকে অঝোরে রক্ত ঝরছিল। উনার রক্তে আমার টি-শার্ট-প্যান্ট ভিজে একাকার। কোনো ভাবেই রক্ত বন্ধ হচ্ছিল না।’ ইমরান জানান, ‘সিএনজিতে ওঠানোর পর খাদিজা আপুর চোখ উল্টে গিয়েছিল। আমরা মনে মনে আল্লাহর কাছে আপুর প্রাণ রক্ষার জন্য প্রার্থনা করছিলাম। উনার হাত মোচরাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল শরীরের সকল ‘রগ’ এক হয়ে যাচ্ছে। আমরা হাত-পা শক্ত করে ধরে রাখছিলাম। মনে হচ্ছিল উনি মারা যাচ্ছেন।’ ইমরান শুধু খাদিজাকে হাসপাতালে নিয়েই দায়িত্ব শেষ করেননি। ওষুধের জন্য দোকানে গেছেন। ডাক্তারদের কাছে কাছে থেকেছেন। এরপর পড়লো রক্তের প্রয়োজন। খাদিজার রক্তের গ্রুপ এ পজেটিভ। ইমরানেরও রক্তের গ্রুপ একই। ইমরান এক ব্যাগ রক্ত দিলেন খাদিজাকে। এ সময় ইমরানের চোখ দিয়ে জল ঝরছিল। ওই দিন রাত ১২টা পর্যন্ত ইমরান হাসপাতালে ছিলেন। এরপর খাদিজাকে ঢাকায় বিদায় দিয়ে বাসায় চলে যান। তবে, রাতে ইমরান বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে বক্তব্য দেন। বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি বার বার কান্নায় ভেঙে পড়েন। খাদিজার এই রক্তমাখা মাথার কথা ইমরান ভুলতে পারছেন না। নিজেও কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। শরীরের অসুস্থতার চেয়ে মানসিক অসুস্থতা বেশি।
গতকাল মানবজমিন-এর সঙ্গে আলাপকালে ইমরান বলেন, ‘খাদিজা আপু জীবন ফিরে পেলে সবচেয়ে বেশি খুশি হবো। এই প্রার্থনা গোটা দেশবাসীর কাছে রাখছি।’ সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের ঢালারপাড় গ্রামের এই তরুণ নগরীর মেসে বসবাস করে পড়ালেখা করছেন। রাজনীতির সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা নেই তার। দেশের রাজনীতি তার পছন্দ না। দুই ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট ইমরান। বড় ভাই ব্যবসা করছেন। আর বোনটিও ভর্তি হবেন ভার্সিটিতে। কোম্পানীগঞ্জের ঢালারপাড় গ্রামের ঢালারপাড় উচ্চ বিদ্যালয়ের স্কুলশিক্ষক মো. নজরুল ইসলাম ও গৃহিণী তাসলিমা আক্তারের ছোট ছেলে ইমরান কবির। তার এই সাহসিকতা ও মহানুভবতা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বর্তমান সমাজে।
ইমরানের এই মানবিকতার প্রশংসা করছেন অনেকে। ফেসবুকে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার তৌফিক ইনাম টিপু যেমন লিখেছেন, ‘ধারালো চাপাতির একের পর এক আঘাত। রক্তাক্ত খাদিজা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন নিথর। কেউ এগিয়ে যাচ্ছে না। কেউ সাহায্যের হাত বাড়াচ্ছে না। দূর থেকে হইচই শুনে এগিয়ে এলেন একজন। তারপর ভূলুণ্ঠিত মানবতাকে তুলে নিলেন কোলে। রক্তাক্ত খাদিজাকে কোলে নিয়ে ছুটলেন হাসপাতালের দিকে। ওই একজন হচ্ছেন ইমরান। পুরো নাম ইমরান কবির। খাদিজা এখনো বেঁচে আছেন। বেঁচে থাকবেন কিনা, সেটা নিয়ে জোর সংশয়। তবে এখনো যে তিনি বেঁচে আছেন, তার পেছনে রয়েছে ওই ইমরান কবিরের এগিয়ে এসে রক্তাক্ত নিথর খাদিজাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ভূমিকা।
২০ বছরের টগবগে তরুণ ইমরান কবির সিলেট সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নিয়ে ব্যস্ত। সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের ঢালারপাড় গ্রামে এই যুবকের বাড়ি। সোমবার বিকালে এমসি কলেজে হাঁটতে গিয়েছিলেন তিনি। তারপর তো অসীম সাহসিকতায় মানবতার ডাকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। সবাই যখন দৌড়ে পালাচ্ছিল, পড়ে ছিল রক্তাক্ত-নিথর খাদিজা। কেউ নেই পাশে। দৌড়ে তার কাছে ছুটে যায় ইমরান। তার চিৎকারে এগিয়ে আসেন মানবতাবাদী আরো দুজন। খাদিজার শরীরের রক্তে ভেসে যায় ইমরানের কাপড়চোপড়। হাসপাতালে জরুরি বিভাগে দ্রুত ভর্তি করায় সে। ইমরানের রক্তের গ্রুপের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় তাৎক্ষণিকভাবেই রক্ত দেয় সে। এরপর খাদিজার স্বজনরা আসার আগে ওষুধের জন্য ফার্মেসিতে দৌড়াদৌড়ি করে ওষুধ এনে দেন। স্যালুট ইমরান। বেঁচে থাক ইমরান। বেঁচে থাক মানবতা। নরপশু বদরুলদের জন্য সীমাহীন ধিক্কার আর ঘৃণা ...।’
অস্বীকার করার জো নেই, এই এক ঘোর অন্ধকার সময়। চারদিকে মানবতার কান্না। এই কান্নার বিবরণ পাওয়া যায় ইমরানের দেয়া ফেসবুক স্ট্যাটাসেও। তিনি লিখেছেন, ‘নিজের পরিচয়টা দিতে লজ্জা হচ্ছে, অবলা জাতির মতো আর কত সহ্য করব...??? জাতির বিবেক কি কখনো জাগ্রত হবে না...??? ঐ দিনের পরিস্থিতির পর এখনো নিজেকে সামলাতে পারছি না...,ঘাতকের প্রতিটি চাপাতির কোপ কি শুধু নার্গিস আপুর মাথাই ভেদ করেছে...??? নাকি পুরো জাতিকে কলঙ্কিত করেছে...??? আমাদের মানবতা যখন হাঁটুর নিচে তখন জাতি কিইবা আশা করতে পারে...??? কিছুই বলার নেই...। চিৎকার করিয়া কাঁদিতে চাহিয়া... করিতে পারিনি চিৎকার...।’
গণমাধ্যমের কাছে ইমরান এও বলেছেন, তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী নন। অমানবিকতার এমন দিনে মানবতা যে পুরোপুরি মরেনি ইমরানের মতো তরুণেরাই তার প্রমাণ।
© মানবজমিন
No comments:
Post a Comment