নিদ্রাহীনতা অনেকের মধ্যেই দেখা যায়। ঘুমের সমস্যা বা নিদ্রাহীনতার অনেক কারণ রয়েছে। ঘুমের সমস্যা হলে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, রাগ বাড়ে, কাজে উদ্যম হারিয়ে ফেলার সমস্যা হয়। এ বিষয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন ‘স্বাস্থ্য প্রতিদিন’ অনুষ্ঠানের অতিথি ডাক্তারদের দেয়া বিশেষ প্রেসক্রিপশন আপনাদের সামনে তুলে ধরা হলোঃ
নিদ্রাহীনতা কী, কাদের হয়?
‘স্বাস্থ্য প্রতিদিন’ অনুষ্ঠানের ২৫৩৩তম পর্বে কথা বলেছেন ডা. মো. শামসুল আহসান। বর্তমানে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।
প্রশ্ন : নিদ্রাহীনতা বলতে আসলে কী বোঝায়?
উত্তর : আমরা সারা দিন কাজ করি, কাজ করে ক্লান্ত হয়ে যাই এবং দিন শেষে আমরা ঘুমিয়ে পড়ি। এই ঘুমিয়ে পড়া স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার একটি অংশ। আবার পরের দিন আমরা কাজ করি। পরের দিন কাজ করার জন্য বা শক্তি সঞ্চয় করার জন্য উদ্যম আমরা পাই, ঘুমের মাধ্যমে। মস্তিষ্ক তো নিয়মিত কাজ করতে থাকে, নিদ্রার সময় সে বিশ্রাম পেয়ে থাকে। কোনো কোনো ব্যক্তির এমন হয়, সারা দিন পরিশ্রম করেন, তবে দিন শেষে ঘুমাতে পারেন না। তখন তাঁদের মধ্যে এক ধরনের বিপর্যয় তৈরি হয়। নিদ্রাহীনতার জন্য অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। রাগ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা কমে যায়।
ঘুমের সমস্যা কয়েক ধরনের হয়ে থাকে। একটি হতে পারে ইনসমনিয়া, আরেকটি হতে পারে হাইপারসমনিয়া বা অতিরিক্ত ঘুম ঘুম ভাব। দিনের বেলা খুব ঘুম ঘুম ভাব থাকে।
আরেকটি সমস্যা আপনি দেখবেন, বাংলাদেশের কোনো একটি ব্যক্তি, সে যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপে গেল, যাদের সঙ্গে আমাদের সময়ের একটি অন্যতম তারতম্য আছে। ওই সব দেশে বেড়াতে গেলেন বা কোনো কাজেও যদি যান, তখন দেখা গেল, আমাদের দেশে যে একটি দিন-রাতের নিয়ম, এটার পরিবর্তনের জন্য তাদের ঘুমে সমস্যা হয়।
আর আরেকটি হয় যে বিভিন্ন শারীরিক রোগের কারণে, নিদ্রাহীনতা হতে পারে।
প্রশ্ন : ইনসমনিয়া কীভাবে হচ্ছে?
উত্তর : আমরা যখন বিছানায় শুয়ে যাই, এর প্রায় মিনিট ২০ পড়ে আমরা ঘুমিয়ে পড়ি। এটা বোঝার জন্য ইলেকট্রোইনসেফেলোগ্রাম নামের একটি পরীক্ষা আমরা অনেক সময় করে থাকি। নিদ্রাজনিত বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগ হতে পারে। যেমন : প্যারাসমনিয়া বা ঘুমের মধ্যে হেঁটে বেড়ানো। খিঁচুনি রোগের জন্য অনেক সময় সমস্যা হয়। ঘুমিয়ে পড়ার ২০ মিনিটের মধ্যে মস্তিষ্কে এক ধরনের তরঙ্গ দেখা যায়। এটা আমরা সাধারণত ঘুমের সময় পেয়ে থাকি। কারো কারো ক্ষেত্রে দেখা যায় ২০ মিনিটে ঘুম আসে না। এর পরিবর্তে এক ঘণ্টা, দুই ঘণ্টা, তিন ঘণ্টা পর ঘুম আসে। কারো কারো দেখা যায় দিনের বেলা খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যায়। উনি চাইলেও আর ঘুমাতে পারেন না। কারো কারো হয় যে রাতের ঘুম না হয়ে দিনের বেলা উনি ঘুমাতে থাকেন।
এ ছাড়া যারা মাদকাসক্ত, তারা সারা রাত জেগে থাকে। এর পর দিনের বেলা তারা ঘুমায়। এখন নিদ্রাহীনতার যে প্রভাবগুলো হয়, যদি সারা রাত না ঘুম হয়, দিনের বেলা ওনার যে কাজটি সেটিতে উপস্থিত থাকতে পারছেন না। যদি উনি উপস্থিত থাকেন, ওনার যে কর্মদক্ষতা, সেটার পর্যাপ্ত ব্যবহার উনি করতে পারছেন না। অযাচিতভাবে অন্যদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে খিটখিটে মেজাজে জড়িয়ে যাচ্ছেন, রাগারাগি করছেন, অফিসের কাজকর্ম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর প্রভাব অনেক জায়গায় পড়ছে।
ঘুমের সমস্যার কারণ কী?
‘স্বাস্থ্য প্রতিদিন' অনুষ্ঠানের ২৫৩৩তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ডা. মো. শামসুল আহসান। বর্তমানে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।
প্রশ্ন : নিদ্রাহীনতার কারণ কী?
উত্তর : এর কারণ বহুমাত্রিক। কারো যদি বিষণ্ণতা হয়, তাহলে এমন হতে পারে। এক ধরনের মনোরোগ আছে, যাকে বলা হয় বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার। ওখানে যদি ম্যানিক হন, তাহলে ওনারা ঘুমাতে চান না। ঘুম আসছে, তবে ঘুমাচ্ছেন না। ঘুমঘুম চোখে এদিক-সেদিক হেঁটে বেড়াচ্ছেন। আঘাত পাচ্ছেন। তার পরও উনি ঘুমাতে চাইছেন না। উনি ভাবছেন, ঘুমিয়ে মূল্যবান সময় নষ্ট করব না। কাজ করে বেড়াব। যাঁরা অতিরিক্ত উদ্বেগজনিত রোগে ভোগেন, তাহলে তাঁদের ঘুম আসতে দেরি হয়। বিষণ্ণতায় আরেকটি বিষয় হয়, উনি হয়তো বলছেন সারা রাত ঘুমিয়েছে, তবে ঘুমিয়ে কোনো তৃপ্তি পাচ্ছি না। আর যদি কিছু ওষুধ খান, আবার যদি ক্যাফেইন, কফি, চা, কোকজাতীয় খাবার যদি রাতের বেলা খান—তাহলে হয়তো রাতের বেলা নিদ্রাহীনতা হতে পারে। এ ছাড়া কিছু কিছু রোগ আছে, যেমন স্লিপ এপনিয়া। ঘুমের মধ্যে শ্বাসকষ্ট হয়। ওনারা জেগে থাকেন। অনেকটা বসে বসে হয়তো ঘুমানোর চেষ্টা করেন। এতে তারা খিটখিটে মেজাজে থাকেন।
ঘুমের সমস্যায় কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন?
‘স্বাস্থ্য প্রতিদিন’ অনুষ্ঠানের ২৫৩৩তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ডা. মো. শামসুল আহসান। বর্তমানে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।
প্রশ্ন : কত দিন ধরে নিদ্রাহীনতা হতে থাকলে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া প্রয়োজন?
উত্তর : যদি মাসের অধিক এই সমস্যা হয়, তাহলে আমরা চিকিৎসকের কাছে আসার কথা বলতে পারি। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস রয়েছে, স্লিপ হাইজিন। আমাদের দাঁতের পরিচর্যার ক্ষেত্রে যেমন ওরাল হাইজিন কথাটি রয়েছে, তেমন স্লিপ হাইজিন। আমাদের জীবনযাত্রা যদি আমরা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসতে পারি, তাহলে ওষুধ ছাড়াও ঠিক হয়ে যেতে পারে। যদি এমন হয় একজন ব্যক্তি সারা দিন কাজ করছেন, তবে পরে ১১টা বা সাড়ে ১১টার দিকে রাতের খাবার খাচ্ছেন, পর পর শুয়ে যাচ্ছেন। ওনার এই জীবনযাপনের ধরনের জন্য কিন্তু ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে। সে ক্ষেত্রে আমরা বলি রাতের খাবার ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে খেয়ে ফেলা ভালো। ঘুমানোর কমপক্ষে তিন ঘণ্টা আগে রাতের খাবারটা সেরে নেওয়া প্রয়োজন। রাতে কম খাওয়া। রাতের বেলা চা-কফি এগুলো না খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বদ অভ্যাস আছে, বিছানায় শুয়ে শুয়ে টিভি দেখা। ইন্টারনেটে কাজ করা। যদি আপনি বিছানায় শুয়ে অন্য যেকোনো কাজ করেন, তাহলে আপনার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে। এ জন্য আমরা বলি যে বিছানায় বসে টিভি না দেখা বা কোনো ডিভাইস না ব্যবহার করা, এগুলো। আরেকটি হলো রাতে হয়তো ঘুম হলো না, দিনের বেলা ঘুমাচ্ছেন। এটিও সমস্যার একটি কারণ। সুতরাং আপনি একটি নির্দিষ্ট সময় ঘুমাতে যাবেন, নির্দিষ্ট সময় উঠে যাবেন। ঘুম না হলেও অযাচিত বিছানায় শুয়ে থাকবেন না। দুপুরবেলা খাবার পর যে অল্প সময়ের জন্য আমরা শুয়ে থাকি, সেটি না করাই ভালো।
প্রশ্ন : জটিলতা কী হতে পারে এ ক্ষেত্রে?
উত্তর : যদি মনোরোগের কারণে সমস্যা হয়, যদি বিষণ্ণতার জন্য হয়, তাহলে ওই রোগগুলোর চিকিৎসা করলে সমস্যা মিটে যাবে। যদি এটা অন্য কোনো অসুখের জন্য হয়, মাদকাসক্তির জন্য হয়, এটি না গ্রহণ করলে সমস্যা ঠিক হবে। আর নিদ্রাহীনতার কারণ যদি হয় জীবনযাপনের অনিয়মিত ভাব, তাহলে সমস্যা নির্ণয় করে স্লিপ হাইজিনকে ঠিক করতে হবে। এ ছাড়া যে ওষুধ খেলে ঘুমের অসুবিধা হতে পারে, সেসব ওষুধ না খাওয়া।
এ ছাড়া দুই দেশের সময়ের তারতম্যের জন্য যদি কোনো সমস্যা হয়, সেটি সাধারণত কয়েক দিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়।
No comments:
Post a Comment