মিরপুর টেস্টের অনবদ্য জয়ে যেমন দ্যুতি ছড়াচ্ছেন মেহেদী হাসান মিরাজ। দুই ইনিংসেই ৬ উইকেট করে নিয়ে তরুণ এই অফ স্পিনার ম্যান অব দ্য ম্যাচ তো বটেই, চট্টগ্রাম টেস্টের ৭ উইকেটসহ মোট ১৯ উইকেট নিয়ে ম্যান অব দ্য সিরিজও। আবার এই জয়ে সাকিব আল হাসানের এক ওভারে তিন উইকেট পাওয়া ছিল অনেক বড় প্রাপ্তির।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট জয়টা যে মুশফিকুর রহিমের নেতৃত্বে এল, তা বড় ভালো হয়েছে। ১১ বছর আগের সেই দুঃখ, সেই লজ্জা, সেই অপমানের তিনিই তো একমাত্র সাক্ষী বাংলাদেশের এই দলে। জয়ের পর মাঠে উন্মাতাল দৌড়াতে থাকা মুশফিকের কি ক্ষণিকের জন্য হলেও মনে উঁকি দিয়ে গেছে সেই স্মৃতি?
মনে পড়েছে ২০০৫ সালের ইংল্যান্ডে বাংলাদেশের প্রথম সফর? স্কোয়াডে ঢুকেছিলেন অতিরিক্ত উইকেটকিপার হিসেবে। প্রস্তুতি ম্যাচে সেঞ্চুরি-টেঞ্চুরি করে এমনভাবেই নিজের দাবি জানালেন যে স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যান হিসেবেই মুশফিকের টেস্ট অভিষেক হয়ে গেল লর্ডসে।
সেই টেস্ট তিন দিনেই শেষ। পরদিন ইংল্যান্ডের কোন পত্রিকায় যেন লেখা হলো, ‘ভবিষ্যতে এই বিতিকিচ্ছিরি বাংলাদেশ দল যেন লর্ডসের ১০০ মাইলের মধ্যে পা রাখতে না পারে।’ লর্ডসের পর চেস্টার লি স্ট্রিট। হোটেলের সিঁড়িতে পা মচকে মুশফিকের যাতে খেলা হয়নি। দ্বিতীয় টেস্টে বাংলাদেশের অবস্থা আরও খারাপ। ব্রিটিশ মিডিয়াও প্রথম দিন শেষেই খাপ খোলা তলোয়ার নিয়ে মাঠে নেমে পড়ল। এর আগে কবে দুই দিনে টেস্ট ম্যাচ শেষ হয়েছে, ছক-টক দিয়ে আগাম ছাপা হয়ে গেল সেই বৃত্তান্তও। এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে, তীব্র ব্যঙ্গ করে এক পত্রিকা লিখেছিল, বাংলাদেশের সঙ্গে খেলার সময় গলফের মতো হ্যান্ডিক্যাপ চালু করা উচিত। বাংলাদেশকে প্রথমেই ১০০ রান দিয়ে দেওয়া হোক, যাতে ম্যাচটা একটু দীর্ঘ হয়।
আরও কত রকম টিপ্পনী! ম্যাচের তৃতীয় দিন বিশ্ব হেভিওয়েট বক্সিংয়ের শিরোপা লড়াই ছিল। অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ নাকি সেটি দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছেন। ম্যাচটা তাই তিনি দুই দিনেই শেষ করে দেবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছেন। ইংল্যান্ড অধিনায়ক মাইকেল ভনেরও তাড়া আছে। প্রিয় ফুটবল ক্লাবের ম্যাচ দেখবেন বলে টিকিট কেটে রেখেছেন। টিকিটটা নষ্ট করতে চান না।
দুই দিনে হারার সেই লাঞ্ছনা শেষ পর্যন্ত এড়াতে পেরেছিল বাংলাদেশ। অবশ্য অল্পের জন্যই। ম্যাচ গড়িয়েছিল তৃতীয় দিনে, তবে খেলা হয়েছিল মাত্র ২৬ বল। ইসিবির নীতি অনুযায়ী, টেস্টের পাঁচ দিনের টিকিট কাটা দর্শককে পুরো টাকাই ফেরত দিতে হয়েছিল। লর্ডসেও দিতে হয়েছিল ৫০ শতাংশ। সেটি ধরেও সমালোচনার সপাং সপাং চাবুক—ইসিবির কি আর্থিক বিপর্যয়ই ডেকে এনেছে বাংলাদেশ!
মে মাসের ইংল্যান্ড। কনকনে হাওয়া। বলে বড় বড় সুইং। বাংলাদেশ দলের বেশির ভাগ খেলোয়াড়ের যে অভিজ্ঞতার সঙ্গে সেটাই প্রথম পরিচয়। এসবের কোনো কিছুই বিন্দুমাত্র সহানুভূতি জাগাতে পারেনি ব্রিটিশ মিডিয়ায়। বাংলাদেশ যেন টেস্ট ক্রিকেটের অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান। যাকে নিয়ে পুরো টেস্ট পরিবারকে মুখ লুকাতে হয়। বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস নিয়ে প্রশ্ন তোলাটাকে তাই রুটিন কাজই বানিয়ে ফেলেছিল ব্রিটিশ মিডিয়া। পাঁচ বছর পর ইংল্যান্ডে দ্বিতীয় সফরেও যেটির ব্যতিক্রম হয়নি। লর্ডসে আরেকটি টেস্টের সময় তামিম ইকবাল টেলিভিশন খুলে দেখলেন, জিওফ বয়কট বাংলাদেশকে নিয়ে যা-তা বলছেন। বুকে আগুন নিয়ে ঘুমাতে গিয়েছিলেন। পরদিন বিধ্বংসী এক সেঞ্চুরিকেও যথেষ্ট না মেনে মুখেও দিয়েছিলেন সেটির জবাব।
তাতেও কি আর তা সেভাবে দেওয়া হয়েছিল! বাংলাদেশ তো ঠিকই হেরেছিল ম্যাচে। সান্ত্বনা বলতে দুই দিন না তিন দিন প্রশ্নটাই এবার ওঠেনি। খেলা হয়েছিল পাঁচ দিনই। ঢাকায় তিন দিনেই ইংল্যান্ডকে শেষ করে দেওয়ার পর মুশফিকদের জয়োৎসব দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, প্রতিশোধটা এর চেয়ে মধুর আর হতে পারত না! তিন দিনেই হারাটা না একসময় বাংলাদেশের টেস্টের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হয়ে ছিল!
তখন বাংলাদেশ যেভাবে হারত, ইংল্যান্ড হারল তার চেয়েও বাজেভাবে। এক সেশনে ১০ উইকেট তো বাংলাদেশও কখনো হারায়নি। যেটির সর্বশেষ উদাহরণ খুঁজতে পিছিয়ে যেতে হচ্ছে সেই ১৯৩৮ সালে। কাল রাতে তামিম ইকবাল আফসোস করছিলেন, একটু এদিক-ওদিক হলেই ফলটা ৫-০ হতে পারত। ওয়ানডে সিরিজে তিনটি ম্যাচই জেতা সম্ভব ছিল, সম্ভব ছিল চট্টগ্রামেও জেতা। যৌক্তিক আফসোসই। যদিও ক্রিকেটে এসব ‘যদি’ ‘কিন্তু’র কোনো জায়গা নেই। শেষ পর্যন্ত যা হয়েছে, সেটিই সত্যি। এবং যা হয়েছে, সেটিই কম কী!
ওয়ানডে সিরিজের কথা বাদই দিন। ওয়ানডেতে বাংলাদেশ অনেক দিনই বদলে যাওয়া এক দল। ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা হাতেনাতে যেটির প্রমাণ পেয়ে গেছে। এই সফরে তো বটেই, গত বিশ্বকাপেই তা পেয়েছে ইংল্যান্ডও। বিস্ময় যদি কিছু থাকে, তা হলো টেস্ট ক্রিকেটের বাংলাদেশ। চট্টগ্রাম টেস্টের দিকেও সারা বিশ্ব অবাক তাকিয়ে ছিল, ঢাকা টেস্ট তো সবার বিস্ফারিত চোখ তুলে দিয়েছে কপালে। ক্রিকেটের জনক ইংল্যান্ড, একসময়ের ঔপনিবেশিক প্রভুও—ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম জয় তাই সব দেশের কাছেই আলাদা মর্যাদা পেয়ে এসেছে। শ্রীলঙ্কার মতো অনেক দেশের জন্য হয়ে আছে বাঁক বদলের সন্ধিক্ষণও। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তা হবে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর পেতে একটু অপেক্ষা করাই ভালো। আশা করতে গেলেই যে মনে খচখচে কাঁটা হয়ে বেঁধে ঘরোয়া ক্রিকেটের রুগ্ণ কাঠামো, শুধুই ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি নিয়ে মেতে থাকা।
থাক, এখন এসব বলার সময় নয়। এখন সময় আনন্দের। সময় সাদা পোশাকে রঙিন উৎসবে মেতে ওঠার। আর তাই সাকিবের ব্যতিক্রমী ইঙ্গিত বা ক্রিকেট দুনিয়াকে স্বাগত জানানোর সাথে সাথে আমরাও দিই "স্যালুট"।
No comments:
Post a Comment