কূটনৈতিক প্রতিবেদক, নয়াদিগন্ত: রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা কাউন্সিলের বিবৃতি আটকে দিয়েছে চীন। চীনের আপত্তির কারণে রাখাইনে সহিংসতার নিন্দা জানিয়ে নিরাপত্তা কাউন্সিল আলোচনার পর বিবৃতি দিতে পারেনি। বৃটেনের উদ্যোগে এই আলোচনার সূত্রপাত হয়।
শুধু এবারই নয়, গত বছর অক্টোবরে রাখাইনে রোহিঙ্গা নিধন অভিযান শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে নিরাপত্তা কাউন্সিলে আলোচনা হলেও বিবৃতি আটকে দিয়েছিল চীন। চীনের আপত্তির কারণেই রুদ্ধদার এ বৈঠকের পর আনুষ্ঠানিক কোনো বিবৃতি দেয়া সম্ভব হয়নি। পর্দার অন্তরালে কূটনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশই রাখাইন ইস্যুতে বৃটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে আলোচনা সূত্রপাতের উদ্যোগ নিয়েছিল।
গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চি ক্ষমতায় আসার আগে মিয়ানমার কয়েক দশক সামরিক জান্তার হাতে নিয়ন্ত্রিত ছিল। এ সময় বহির্বিশ্ব মিয়ানমারের ওপর অর্থনৈতিকসহ নানাবিধ অবরোধ আরোপ করলেও প্রতিবেশী রাষ্ট্র চীন তাদের সমর্থন দিয়ে গিয়েছিল। আন্তর্জাতিক চাপে নির্বাচনের মাধ্যমে সু চি ক্ষমতায় এলেও রাষ্ট্রের মূল কলকাঠি এখনো মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর হাতেই রয়েছে।
গত শুক্রবার থেকে নতুন করে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ শুরু করেছে মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনী। এবারও চলছে হত্যা, ধর্ষণ ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে আগুনের লেলিহান শিখা বাংলাদেশ সীমান্ত থেকেই চোখে পড়ে। নিপীড়নের হাত থেকে বাঁচতে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশ সীমান্তে জড়ো হয়েছে। তবে বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী তাদের বাধা দিচ্ছে। এর মধ্যেও সাড়ে ১৮ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)।
আইওএমের হিসাব মতে, গত অক্টোবরের পর থেকে রাখাইনে নতুন করে সহিংসতা শুরুর আগ পর্যন্ত ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিল।
সরকারের মতে, প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা বৈধ-অবৈধভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বাস করছে। তাদের ফিরিয়ে নিতে এবং রোহিঙ্গাদের জন্য রাখাইনে বসবাসের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে জাতিসঙ্ঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ।
আজ বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, নিরাপত্তা কাউন্সিল বুধবার মিয়ানমারের চলমান সহিংসতা নিয়ে আলোচনা করেছে। যেখানে সংঘাত ও সামরিক বাহিনীর দমন অভিযানে রাখাইন রাজ্য থেকে সাড়ে ১৮ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। ১৫ সদস্যের নিরাপত্তা কাউন্সিলের রুদ্ধদ্বার এ বৈঠকের পর কোনো বিবৃতি দেয়া হয়নি।
তবে জাতিসঙ্ঘে নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত ম্যাথিউ রাইক্রোফট বলেছেন, মিয়ানমারের রাখাইনে উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়েছেন পরিষদের সদস্যরা।
এ বৈঠক আহ্বান করেছিল ব্রিটেন।
কিন্তু রাখাইন সঙ্কটে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের জড়িত হওয়ার বিষয়ে ঘোর বিরোধিতা করেছে চীন। নিরাপত্তা পরিষদে এ আলোচনা হলেও পরবর্তীতে আর কোনো পরিকল্পনা রয়েছে কি না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে আগামী মাসে জাতিসঙ্ঘের বার্ষিক সাধারণ অধিবেশনে বিশ্ব নেতারা সমবেত হলে ইস্যুটি আলোচনায় আসবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত রাইক্রোফট বলেছেন, নিরাপত্তা পরিষদ এখনও শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অং সান সুচিকে সমর্থন করে। মিয়ানমার সরকার পরিচালনায় তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আমাদের মধ্যে অনেকেই তাকে সমর্থনকারী মিত্র। আমরা চাই তিনি সঠিক কথা বলুক। একটি সমঝোতার পথ বের করে আনুক। মিয়ানমারের সব মানুষের মঙ্গলের জন্য এই সমস্যা সমাধান করে উত্তেজনা প্রশমন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। জাতিসঙ্ঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান এরই মধ্যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে আরোপিত নাগরিকত্ব ও চলাচলের বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
এদিকে মিয়ানমারে জাতিগত সহিংসতার শিকার রোহিঙ্গাদের রক্ষার আহ্বান জানিয়েছেন ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) মহাসচিব ড. ইউসুফ আল ওতাইমিন। জাতিসঙ্ঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান ও মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় পরামর্শক অং সান সু চি’র কাছে লেখা পৃথক দুটি চিঠিতে তিনি এ আহ্বান জানান।
চিঠিতে ওআইসি মহাসচিব বলেছেন, রাখাইনে বেসামরিক মানুষের ওপর নির্বিচারে শক্তি প্রয়োগ করা হচ্ছে। এতে অঞ্চলজুড়ে এক অসহনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, যা অসংখ্য মানুষের ওপর প্রভাব ফেলেছে।
ওতাইমিন রাখাইনে সহিংসতা বন্ধ ও রোহিঙ্গাদের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য জাতিসঙ্ঘের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদ জরুরি ও কার্যকরভাবে ইস্যুটি সমাধান করতে পারবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
সু চিকে লেখা চিঠিতে মহাসচিব রাখাইন পরিস্থিতিতে ওআইসির উদ্বেগের কথা জানান। তিনি অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধ, উদ্বাস্তুদের তাদের ঘরে ফিরতে দেয়া এবং মানবিক সংস্থাগুলোর মাধ্যমে দুর্গতদের সহায়তার অনুমতি দেয়ার জন্য মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান।
রোহিঙ্গাদের প্রতি বৈষম্য, ন্যয়বিচার ও নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়া না হলে চলমান সংকট পুরো অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে বলে ওআইসি মহাসচিব আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
No comments:
Post a Comment