কোষ্ঠকা‌ঠি‌ন্য: সমস্যা ও সমাধান

স্বাস্থ্য বিষয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৮১৭তম পর্বে কোষ্ঠকা‌ঠিন্য সম্পর্কে কথা বলেছেন ডা. বিলকিস ফাতেমা। বর্তমানে তিনি ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কলোরেক্টাল সার্জারি বিভাগের পরামর্শক হিসেবে কর্মরত।

কোষ্ঠকাঠিন্যের চিকিৎসা না হলে হতে পারে ক্যানসারঃ=
সঠিক সময়ে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমাধানে চিকিৎসা করা উচিত। না হলে বিভিন্ন জটিল সমস্যা হতে পারে।
প্রশ্ন : কোষ্ঠকাঠিন্য যেন না হয়, সে জন্য কী করণীয়?
উত্তর : সাধারণত রোগীকে বলি, দিনে ৪০ থেকে ৪৫ মিনিট হাঁটবেন। মাঝারি গতিতে। ধীরে ধীরেও না; আবার খুব দৌড়াতে হবে, সেটিও নয়। পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করবেন আর শাকসবজি খাবেন। আরেকটি জিনিস হলো লাল মাংস। গরুর মাংস, খাসির মাংস—এগুলো একটু এড়িয়ে যেতে বলি। কারণ, এগুলো আসলে কোষ্ঠকাঠিন্য করে।
প্রশ্ন : এটি কি সবার ক্ষেত্রেই, নাকি কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা যাদের রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে?
উত্তর : সবার কমবেশি করে। তবে যার কোষ্ঠকাঠিন্য রয়েছে, তার বেশি করে।
প্রশ্ন : সঠিক সময়ে চিকিৎসা করা না হলে কী জটিলতা হতে পারে?
উত্তর : দীর্ঘদিন কোষ্ঠকাঠিন্য না থাকলে ফিশার হয়, পাইলস হয়। পায়খানার একটি অংশ আরেকটি অংশের মধ্যে ঢুকে যায়। এমনকি দীর্ঘ সময় যদি কোষ্ঠকাঠিন্য থাকে, তাহলে মলদ্বার বা বৃহদ্রান্তে ক্যানসারও হতে পারে।
প্রশ্ন : অনেক সময় রোগীরা অপচিকিৎসকের কাছে চলে যান। কী পরামর্শ থাকবে রোগীর জন্য?
উত্তর : পরামর্শ থাকবে যে পায়খানার রাস্তার সমস্যা হলে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, তবে অবহেলাও করা যাবে না। একজন চিকিৎসককে দেখান। অন্তত একজন চিকিৎসককে দেখান। বিভাগীয় পর্যায়েও এখন সার্জারি চিকিৎসক রয়েছে। সার্জারি চিকিৎসককে দেখালে ভালো হয়। আর যদি সম্ভব হয়, কোলোরেক্টাল সার্জনের কাছে অবশ্যই যাবেন।
আর সবার কাছে আবেদন থাকবে, পায়খানার রাস্তায় সমস্যার ক্ষেত্রে চিকিৎসক না দেখিয়ে কোনো ওষুধ ব্যবহার করবেন না। চিকিৎসক দেখে চিকিৎসা দেবে। এরপর সেটি ব্যবহার করবেন।

সঠিক খাদ্যাভ্যাসের পরও কোষ্ঠকাঠিন্য হচ্ছেঃ=

কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা সমাধানে আঁশযুক্ত খাবার খাওয়া প্রয়োজন; মাংস বেশি খাওয়া এড়িয়ে গিয়ে শাকসবজি খাওয়ার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। তবে অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ঠিকমতো এসব খাবার খাওয়ার পরও কোষ্ঠকাঠিন্য হচ্ছে। আপনারও কি এ ধরনের সমস্যা হয়? তাহলে আসুন জানি, কী কারণে এ রকম সমস্যা হতে পারে।

প্রশ্ন : অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায়, নিয়মিত খাবার খাওয়ার পরও কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা হয়ে থাকে। এটি কি কোনো কারণে হয়?
উত্তর : অনেক কারণে হয়। এগুলোর মধ্যে কিছু রয়েছে ফাংশনাল। কিছু রয়েছে অ্যানাটমিক্যাল। ফাংশনাল হলে তার খাবার ট্রান্সফার (পরিবহন) অনেক দেরিতে হয়। এটা একটি বড় কারণ। আরেকটি কারণ নারীদের ক্ষেত্রে হয়, পায়খানা যখন মলাশয়ে আসে, তখন আটকে যায়। এর অনেক কারণ থাকতে পারে। শুধু এমনি পাইলসের কারণে হতে পারে। এর পর ক্যানসারের জন্যও হতে পারে। টিউমারের জন্যও হতে পারে। নারীদের জরায়ুমুখ ও মলাশয়—এ দুটোর মাঝখানে একটি পর্দা থাকে। বাচ্চা জন্মের সময় সেই পর্দা অনেকেরই ছিঁড়ে যায়, তখন সেখানে একটি ব্যাগের মতো তৈরি হয়। একে রেক্টোসিল বলে। যাদের রেক্টোসিল থাকে, পায়খানা এসে ওই জায়গায় জমে থাকে, বের হয় না। সেটি এভাবে প্রকাশ পায় যে তার পায়খানা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। রোগীরা এসে অভিযোগ করে যে আমার পায়খানা বের হয় না।
আবার দেখা যাচ্ছে যে মলাশয়ের ওপরের অংশ নিচের অংশের মধ্যে ঢুকে যায়। কিছু কারণ আরো রয়েছে। দেখা যাচ্ছে যে নারীদের বয়স হয়ে গেলে যেমন ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যায়, তখন প্যালভিসের লিগামেন্টগুলো ঢিলা হয়ে যায়। তখন যেটা হয় যে পুরো প্যালভিস, প্যারেনিয়াম, মলাশয়, জরায়ু, মূত্রাশয়, সবই আসলে একটু নিচে নেমে আসে। একে প্রেশার দিলে পায়খানাটা আটকে আসে।
প্রশ্ন : এই রোগীর চিকিৎসা কীভাবে হয়?
উত্তর : চিকিৎসার অনেক ধাপ রয়েছে। প্রথমে আমরা রোগীকে বোঝাই যে সমস্যাটা কী হয়েছে। প্রধান সমস্যা যেটা ফেটে যায়। বেশির ভাগ রোগী আমার কাছে ফিশার নিয়ে আসে। আর সাধারণ মানুষ পায়খানার রাস্তায় কিছু হলে একে পাইলস বলে চেনে। শুধু সেটি নয়। পায়খানার রাস্তার তো অনেক রকম সমস্যা হয়। তখন আমরা কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করি। হাত দিয়ে দেখি। মেশিন দিয়ে দেখি। দেখে আমরা মোটামুটি একটি ধারণা করে নিই যে কারণটা কী? তখন রোগীকেও সেইভাবে বলি। জীবনযাপনের কিছু পরিবর্তন করতে হয়। এ ক্ষেত্রে কিছু ব্যায়াম করতে হয়। নির্দিষ্ট কিছু ব্যায়াম শিখলে কিছুটা কমে যায়। কিছু মুখে ওষুধ দিই। পরে যদি এগুলো ঠিক না হয়, তখন অস্ত্রোপচারের দিকে যাই।
প্রশ্ন : অস্ত্রোপচারের পর কি কোনো পরামর্শ থাকে?
উত্তর : আসলে রেক্টোসিল বা পায়খানার রাস্তা একটি আরেকটির মধ্যে ঢুকে গেছে, এগুলো ঠিক করে দিতে পারি বা প্যারিনিয়াম নিচে নেমে গেছে, এগুলোকে ওপরে তুলে দিতে পারি। তবে যার ছোটবেলা থেকেই কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা রয়েছে বা কোষ্ঠকাঠিন্য রয়েছে এবং আরো কিছু সমস্যা রয়েছে (যেমন : পায়খানার রাস্তা খুলতে যাচ্ছে, খুলছে না), এই সমস্যাগুলো আসলে অস্ত্রোপচার করে ঠিক করা যায় না। কিছু চিকিৎসা রয়েছে, আমরা এখনো সেই শব্দের সঙ্গে পরিচিত নই, একে বায়োফিডব্যাক বলে। এগুলো করি। আর যাদের ছোটবেলা থেকে কোষ্ঠকাঠিন্য রয়েছে, সেটি আসলে ব্যবস্থাপনা করে সমাধান করতে হয়।

কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা কাদের বেশি হয়ঃ=

কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যায় ভোগেন না, এমন মানুষ পাওয়া কঠিন। কাদের কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা বেশি হয়? জে‌নে নিন:
প্রশ্ন : কোষ্ঠকাঠিন্য বলতে কী বোঝানো হয়?
উত্তর : আসলে কোষ্ঠকাঠিন্য নেই এ রকম মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কোষ্ঠকাঠিন্যকে বইয়ের ভাষায় বললে অনেক বিষয় রয়েছে। পায়খানা শক্ত হতে পারে, দিনের মধ্যে প্রতিবার পায়খানায় যাচ্ছে, তবে পায়খানা তার শেষ হচ্ছে না। মনে হচ্ছে আরেকটু হতো বা বারবার পায়খানায় যাচ্ছে। তবে পায়খানাটা পরিষ্কার হচ্ছে না। সবকিছুই কিন্তু কোষ্ঠকাঠিন্যের মধ্যে পড়ে।
প্রশ্ন : কোষ্ঠকাঠিন্য কাদের বেশি হয়?
উত্তর : জন্মগতভাবে অনেকের কোষ্ঠকাঠিন্য হয়। তবে নারীদের কোষ্ঠকাঠিন্য জন্মগতভাবে একটু বেশি হয়। আর জীবনযাপনের ধরন, খাদ্যাভ্যাস, সে কী ধরনের কাজকর্ম করে—এ ধরনের অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে কোষ্ঠকাঠিন্য হয়। যারা সেডেন্টারি জীবনযাপন করে, হাঁটে না বা কায়িক পরিশ্রম কম করে, মাংস যারা বেশি খায়, শাকসবজি যার কম খায়, পানি যারা কম খায়, তাদের কোষ্ঠকাঠিন্য হয়।

শিশুদের কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা কেন হয়ঃ=

ভুল খাদ্যাভ্যাস, সঠিকভাবে টয়লেট ট্রেনিং না হওয়া ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে শিশুদের কোষ্ঠকাঠিন্য হয়। শিশুদের কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধে সচেতনতা জরুরি।
শিশুদের কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণ কী?
প্রশ্ন : শিশুদের মধ্যে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা বেশি দেখা যায়। কেন ?
উত্তর : শিশুদের মধ্যে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা বেশি হওয়ার একটি কারণ হিসেবে বলা যায়, বাচ্চারা হয়তো তরল খাবার কম খায়। আরেকটি সমস্যা হলো এখনকার বাচ্চাদের ডায়াপার পরানো হয়, টয়লেটে বসানোর অভ্যাস করানো হয় না। এ কারণেও কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে।
প্রশ্ন : টয়লেট ট্রেনিং কখন থেকে দেওয়া উচিত?
উত্তর : বাচ্চা যখন হাঁটতে শিখবে, তখন থেকে তাদের টয়লেট ট্রেনিং দিতে হবে। পায়খানা করার অভ্যাস করাতে হবে। এখন তো বাচ্চাদের জন্য আলাদা প্যান কেনা হয়। ভালো হয় যদি ফ্যামিলি প্যানেই বাচ্চাকে অভ্যাস করানো যায়। পায়খানার অনভ্যস্ততা থেকে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা হতে পারে।

কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা সমাধানে কী করবেনঃ=
খুব জটিল ধরনের সমস্যা না হলে সাধারণত জীবনযাপনের ধরন পরিবর্তন করে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা সমাধান করা যায়।
প্রশ্ন : কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা নিয়ে আপনাদের কাছে যাওয়ার পর কী ধরনের চিকিৎসা তাদের দেন?
উত্তর : আসলে কোষ্ঠকাঠিন্যে চিকিৎসক যতটুকু উপকার না করতে পারেন, তার চেয়ে নিজে নিজে সচেতন হলে এটি নিয়ন্ত্রণে রাখা বেশি সম্ভব হয়। এ ক্ষেত্রে ওষুধের চেয়ে বেশি দরকার খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাপনের ধরন পরিবর্তন। একজন মানুষ অন্তত আধা ঘণ্টা থেকে ৪০ মিনিট হাঁটবে, পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করবে। আসলে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান বলতে গ্লাসের পর গ্লাস পানি পান করা নয়, একটি নির্দিষ্ট বিরতি দিয়ে পানি পান করবে। আমরা বলি, আপনার প্রস্রাবের রং যদি সাদা হয়, তাহলে আপনি বুঝবেন, আপনার পানিশূন্যতা আসলে নেই।
প্রশ্ন : যখন রোগীরা আসে, কী কী ধরনের সমস্যা নিয়ে আসে?
উত্তর : রোগী তো আসলে কেবল মলত্যাগের সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে আসে না। যখন এটি থেকে অন্য কোনো সমস্যা তৈরি হয়ে যায়, তখন সেই সমস্যা নিয়ে আসে। এর সঙ্গে বলে যে তার আসলে কোষ্ঠকাঠিন্য রয়েছে, বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে। ১০০ জন নারীর থেকে ২৫ থেকে ৩০ জনের এমনিতেই কোষ্ঠকাঠিন্য থাকে। আমরা বলি, কোষ্ঠকাঠিন্য আসলে বাধাগ্রস্ত মলত্যাগ। দেখা গেছে, মলত্যাগ করতে গেছে, বসেছে, তবে প্রেশার দিয়েছে, হচ্ছে না। তখন পেটের মাংসপেশি শক্ত করে। শক্ত করে চাপ দেয়। জরায়ুমুখের কাছে চাপ দেয়। অনেকে হাত ভেতরে দিয়েও মল বের করে নিয়ে আসে—এ রকমও হয়।
প্রশ্ন : তখন আপনারা কীভাবে রোগীদের ব্যবস্থাপনা করেন?
উত্তর : যাদের এই সমস্যা রয়েছে, তাদের মধ্যে দেখা যায়, অনেকেরই কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা রয়েছে। এতে উনারা একে ভাগ করতে পারে না। যখনই এটি থেকে আরো জটিল হয়ে যায়, পায়খানাটা হচ্ছে না, ফেটে যায় পায়খানার রাস্তা, আঙুল দিয়ে বের করতে হয়, পায়খানা করতে গেলে ব্যথা হয়, পরে যন্ত্রণা হয়, জ্বালাপোড়া করে, তখন তারা আসলে চিকিৎসকের কাছে আসে। তখন রোগের অবস্থা বুঝে ব্যবস্থাপনা করা হয়।

No comments:

Post a Comment