পুড়ে যাওয়ার প্রচলিত কারণগুলো জানেন?
ক্ষুদ্র থেকে জটিল, বিভিন্ন কারণে আগুনে পোড়ার ঘটনা ঘটে। এ বিষয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৮২৯তম পর্বে কথা বলেছেন অধ্যাপক ডা. মো. শহীদুল বারী। বর্তমানে তিনি শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের প্লাস্টিক ও বার্ন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত।
প্রশ্ন : সাধারণত কোন কারণে পুড়ে যাওয়ার সমস্যা বেশি হতে পারে?
উত্তর : সবচেয়ে প্রচলিত হলো ডমেস্টিক বার্ন (ঘরোয়াভাবে আগুনে পুড়ে যাওয়া)। রান্না করার সময় আগুনে পুড়ে যায়। হয়তো গ্যাসস্টোভ থেকে আগুন লাগতে পারে অথবা যারা কাঁচা চুলায় কাজ করে গ্রামে, তাদের সমস্যা হতে পারে। যারা শাড়ি পরে, তাদের শাড়ি বাতাসে উড়ে গিয়ে আগুনে পড়তে পারে। আর একটি হলো, গরম পানি বা গরম ডাল, গরম তরকারি—এগুলো থেকে পোড়া। এগুলোতে বাচ্চারা বেশি পোড়ে। বাচ্চারা হয়তো মায়ের পেছনে পেছনে রান্নাঘরে যায়, তখন এগুলো তার গায়ে পড়ে। আবার গরম পানি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নেওয়ার সময়ও এ রকম হয়। এর বাইরে যেটি হয় ইলেকট্রিক বার্ন (পোড়া)। সেটিও খুব প্রচলিত। ঘরে যে ইলেকট্রিক লাইনগুলো থাকে, এখানে কাজ করতে গেলে সমস্যা হতে পারে অথবা যাঁরা ইলেকট্রিক লাইনে কাজ করেন, পিডিবি, ডেসা, ডেসকো—তাঁদের লোকজনও কিন্তু প্রায়ই কাজ করতে গিয়ে পুড়ে যান। তিনি হয়তো ইলেকট্রিক সুইচ অফ (বন্ধ ) করে আসছেন। কাজ করছেন ওপরে। হঠাৎ করে কেউ অন (চালু) করে দিল। তখন কিন্তু একসঙ্গে কয়েকজনের ইলেকট্রিক বার্ন হয়।
আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে এসিড বার্নের বিষয় রয়েছে। যদিও আজকাল ঘটনাটা একটু কম। আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে এটি। সরকারের শাস্তি খুব কঠোর হওয়ায় কমে গেছে। তবে হচ্ছে।
আর একটি হলো ইন্ডাস্ট্রিয়াল বার্ন (কলকারখানায় পোড়া)। এটি হলো বয়লার। বয়লার থেকে যে বাষ্পটা লিক করে, সেটা থেকেও কিন্তু পোড়ার ঘটনা হয়। এটি কিন্তু খুব জটিল ধরনের পোড়া।
প্রশ্ন : সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়, এমন পুড়ে যাওয়ার বিষয়গুলো কী কী?
উত্তর : সবচেয়ে ক্ষতি হলো আগুনে পোড়া। এর পর ইলেকট্রিক বার্ন। এই পোড়াতে কিন্তু হাড় পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফোরফোরটি যে লাইনগুলো রয়েছে অথবা ১১ হাজার ভোল্টের যে লাইনগুলো রয়েছে, এর সংস্পর্শে যদি কেউ আসে, তাহলে একেবারে হাড় পর্যন্ত ফেলে দিতে হয়। এটা মারাত্মক। আগুনে পোড়াতে তো একটু সময় পাওয়া যায়। তবে হাইভোল্টেজ ইলেকট্রিক লাইনে কোনো সময় পাওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে ক্ষতির পরিমাণটা তাৎক্ষণিক বোঝা যায় না। পাঁচ থেকে সাত দিন পর বোঝা যায় ক্ষতির পরিমাণটা কতখানি হয়ে গেছে। তখন দেখা যায়, হাত কেটে ফেলতে হয় বা পা কেটে ফেলতে হয়।
আর এসিড বার্নটাও একই রকম। সাধারণত যদি শরীরের অন্য কোথাও লাগে, তাহলে ক্ষতি হয়, তবে ততটা মারাত্মক নয়। মুখে যদি মারে, তাহলে চোখটা নষ্ট হয়ে যায়। একজন মানুষ বাইরে বের হতে পারে না। সারা জীবনের জন্য সে সামাজিকভাবে একা হয়ে যায়।
পুড়ে গেলে প্রাথমিকভাবে কী করবেন?
সাধারণত পুড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আগুনে পোড়া, এসিডে পোড়া, ইলেকট্রিক বার্ন ইত্যাদি বেশি ঘটে। পুড়ে গেলে প্রাথমিকভাবে পানি ঢালা খুব জরুরি। পুড়ে গেলে প্রাথমিকভাবে কী করবেন?
প্রশ্ন : পুড়ে যাওয়ার প্রাথমিক চিকিৎসা কী হবে?
উত্তর : একটিই কথা। প্রাথমিক চিকিৎসা হলো আগুনে পানি ঢালুন। কতক্ষণ ঢালবেন? ১৫ থেকে ২০ মিনিট। কী হবে? আগুন নিভে যাবে, জ্বলা কমে যাবে এবং শরীরের ভেতরে যে ক্ষতি হবে, তার পরিমাণটাও কমে যাবে। রোগীর আগেভাগে নিরাময় হবে। তারপর ভেজা কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে একটি নিকটস্থ হাসপাতালে বা চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
পুড়ে যাওয়া প্রতিরোধে করণীয়
সাধারণত অসতর্কতার কারণে পুড়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে। তাই পুড়ে যাওয়া প্রতিরোধে সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
প্রশ্ন : পুড়ে যাওয়া প্রতিরোধে করণীয় কী?
উত্তর : আমরা কিন্তু সব সময় একটি কথা বলি, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। যদি আমরা অগ্নিদগ্ধদের প্রতিরোধ করতে পারি, তাহলে তো আর চিকিৎসার প্রশ্ন আসছে না।
প্রতিরোধের বিষয়ে ঘরের থেকেই বলি। চুলার ওপরে তাকে যে জিনিসপত্র থাকে, সেগুলো যেন রান্না করা অবস্থায় আমরা না নামাই। দেখা যায়, চুলা জ্বলছে, এ অবস্থায় ওখানে একটা কিছু নামাতে যায়। তখনই দেখা যাচ্ছে, কাপড়ে আগুন লেগে যাচ্ছে। খুব প্রচলিত এটি।
আরেকটি হলো রান্না করছে মা; সন্তান হয়তো পেছনে পেছনে এসে কিছু টান দিল, এ সময় তার গায়ের মধ্যে এসে গরম হাঁড়ি পড়ল। অথবা কেউ একজন চা বা গরম পানি নিয়ে যাচ্ছিল, বাচ্চাটা হয়তো সামনে খেলছিল, তার গায়ে সেটি পড়ে গেল। এগুলো কিন্তু খুব সহজে প্রতিরোধ করা যায়। নিয়ম হচ্ছে গরম পানি নিলে একটি বালতিতে করে নেওয়া। এতে পানি সহজে ছলকে আসার আশঙ্কা কম থাকে। দ্বিতীয়ত, রান্না করা অবস্থায় ওপর থেকে কিছু না নামানো। তৃতীয়ত, বাচ্চা যেন রান্না ঘরে যেতে না পারে, সে জন্য একটি ব্যারিকেডের ব্যবস্থা যদি করা যায়, তাহলে ভালো।
আর গ্রামে কাঁচা চুলায় রান্নার ক্ষেত্রে নিয়ম হচ্ছে চুলার চারদিকে মাটির মতো দুই ফুট উঁচু দেয়ালের মতো করে দেওয়া। ছোট্ট একটি দরজার মতো থাকবে, সেই দরজাটা বাঁশের হোক বা কিছু দিয়ে, এটি যেন বন্ধ করে রাখা যায়। আর রান্নার পরে যে ছাইগুলো থাকে, সেগুলো অনেক সময় উড়ে গিয়ে ঘরে আগুন লাগে। এটা যেন তারা পানি দিয়ে নিভিয়ে ফেলে। এটা গেল একদিক।
আরেকটি দিক হলো, অনেক সময় ঘরে কিন্তু স্যুয়ারেজ লাইন দিয়ে গ্যাস লিক করে। এই কারণে গ্যাস জমে থাকে। যখনই কেউ বাথরুমে গিয়ে বা রান্নাঘরে গিয়ে সিগারেট ধরায়, বিদ্যুতের সুইচ টিপে, তখনই হঠাৎ করে ব্লাস্ট করে। এটা দুটোভাবে হতে পারে। রান্নাঘর থেকে হতে পারে। আর গ্যাসলাইন থেকে যে গ্যাস লিক করে, সেখানে হতে পারে। আরেকটি হলো বাথরুমে। যদি কেউ প্রতিদিন রাতের বেলা রান্নাঘরের জানালা ও বাথরুমের জানালা খোলা রাখে, তাহলে গ্যাস কখনোই ওখানে জমতে পারবে না। প্রতিদিন রাতের বেলা ঘুমানোর আগে কষ্ট করে রান্নাঘরের এবং বাথরুমের জানালাটা খোলা রাখতে হবে। তাহলে গ্যাস বেরিয়ে চলে যাবে।
সম্প্রতি আমরা কিছু কিছু ঘটনা দেখতে পাচ্ছি, মানুষের যে গ্যারেজ থাকে, সেখানে যদি সেপটিক ট্যাঙ্ক থাকে, সেখানে দেখা যায় অফিস করছে। পান্থপথে একটি ঘটনা ঘটেছে কিছুদিন আগে। আরেকটি ঘটনা ঘটেছে লালবাগে। দেখা গেছে, লালবাগে একটি ইলেকট্রনিকসের দোকান। তার নিচে একটি স্যুয়ারেজ ট্যাঙ্ক ছিল। সেই স্যুয়ারেজ ট্যাঙ্কি থেকে মানুষের মল জমে আস্তে আস্তে এসিড জমেছে। যেকোনোভাবে হোক, সেটি লিক করেছে। সেখানে কোনোভাবে হোক, কেউ সিগারেট ধরিয়েছে বা কোনো কিছু ধরিয়েছে, সেটি ব্লাস্ট হয়েছে। যাঁরা গ্যারেজ বা এসব জিনিস নির্মাণ করেন, তাঁদের অবশ্যই বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। যদি করতেও চান, তাহলে গ্যাস সিস্টেমটা এ রকম করে দিতে হবে যেন গ্যাস বেরিয়ে যায়। ওই পাইপ দিয়ে যেন গ্যাস বের হয়ে ওপরে চলে যেতে পারে, যেন ঘরের মধ্যে না ঢুকে।
পান্থপথে ঠিক একই রকম। তারা একটি অফিস করেছিল গ্যারেজে। সেখানে স্যুয়ারেজ। খুব ডেকোরেশন করে করেছিল। তবে যিনি মালিক, তিনিই পুড়ে মারা গেছ্নে।
লালবাগে ইলেকট্রনিকস দোকানের মালিক, তাঁর বন্ধু এবং তিনজন কর্মচারী মারা গেছেন। যদি ফায়ার অ্যালার্ম সিস্টেম রাখা যায়, অনেক অ্যালার্ম সিস্টেম তাহলে ভালো হয়। প্রথমে আগুন তো চারদিকে ছড়িয়ে যায় না। একটু সময় লাগে। গোডাউনগুলোতে যদি তারা অ্যালার্ম সিস্টেম রাখে, ভালো হয়। বিল্ডিংয়ের বাইরেও যদি অ্যালার্ম রাখে, তাহলে সেটি এত বিকট শব্দে বাজবে যে সবাই সতর্ক হয়ে যাবে। বাইরের মানুষগুলো ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। এটি হলো একটি দিক। আরেকটি হলো, স্প্রিং ক্লার সিস্টেম বলে। যেখানে পানির লাইনগুলো থাকে। যখন এই অ্যালার্ম বাজবে, তখন স্প্রিংক্লার বাজবে, ঠিক একই সঙ্গে স্প্রিংক্লার সিস্টেম দিয়ে পানি বের হবে এবং ছড়িয়ে যাবে ঘরের মধ্যে।
No comments:
Post a Comment