প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললেই গড়ে প্রতি ১০টি সংবাদের আটটিই খারাপ পাই। তখন মনটাও খারাপ হয়ে যায়। আজকেও আমার এই ‘কনটেন্ট অ্যানালাইসিস’-এর ফলাফল অপরিবর্তিত রয়েছে। তবে আজকে ভালো একটি সংবাদে সব খারাপ সংবাদ কোণঠাসা হয়ে গেছে। মনটাও এক অন্যরকম ভালো লাগায় ভরে গেছে। ভালো কোনো ক্ষেত্রে নিজের দেশ পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় থাকলে কার না মন ভালো হয়?
খবরটি হলো বিশ্বের লাখো মায়ের জীবন রক্ষা করে চলেছে বাংলাদেশেরই এক নিভৃতচারী-প্রচারবিমুখ চিকিৎসকের উদ্ভাবন করা প্রযুক্তি। প্রযুক্তিটির নাম সায়েবাস মেথড। প্রসূতি মায়েদের জীবন রক্ষার সবচেয়ে কম খরচের মূল্যবান চিকিৎসা পদ্ধতি। ধনী দেশে এমন একটি উদ্ভাবন হলে হৈচৈ পড়ে যেত। চিকিৎসায় নোবেল পুরুস্কারও মিলে যেত। আমরা দরিদ্র বলেই হয়তো এই স্বীকৃতিটা পাইনি।
সারা বিশ্বে প্রতি দুই মিনিটে একজন করে প্রসূতি মায়ের মৃত্যু ঘটছে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে। একই কারণে এই মাতৃমৃত্যু ঘটছে আমাদের দেশেও। এসব মৃত্যুর ৩০ শতাংশের জন্য দায়ী প্রসবকালীন রক্তক্ষরণ। এর বড় অংশই ঘটে আবার আমাদের মতো গরিব দেশগুলোতে। মাতৃমৃত্যুর এই স্রোত ঠেকানো যাচ্ছিল না। কারণ এটা ঠেকানোর জন্য যে চিকিৎসা-ব্যয় হয়, গরিব দেশের মায়েদের পক্ষে সেটা মেটানো সম্ভব হতো না। ফলে তাঁরা অসহায়ভাবে মৃত্যুকেই যেন মেনে নিতেন।
এ অবস্থায় দুর্দান্ত এক উদ্ভাবন দিয়ে চমক সৃষ্টি করেছেন বাংলাদেশের প্রচারবিমুখ চিকিৎসক সায়েবা আক্তার। তাঁর নামেই হয়েছে চিকিৎসা পদ্ধটির নাম ‘সায়েবাস মেথড’ (সায়েবা পদ্ধতি)। সায়েবাস মেথড বিশ্বের লাখো মাকে বাঁচিয়েছে এবং বাঁচিয়ে চলেছে। ফলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের স্বীকৃতিও মিলেছে বিশ্বজুড়ে। ২০১১ সালে যুক্তরাজ্যের রয়েল কলেজ অব অবসটেট্রিশিয়ানস অ্যান্ড গাইনোকোলজিস্টসের পক্ষ থেকে তাঁকে এই উদ্ভাবনের জন্য সম্মানসূচক ডিগ্রি দেওয়া হয়েছে। এমনকি কেনিয়ার একজন স্বাস্থ্যকর্মী সায়েবা মেথড ব্যবহার করে ছয়জন মায়ের জীবন রক্ষা করে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে রীতিমতো হৈ চৈ ফেলে দিয়েছেন। অথচ সায়েবাস মেথডের উদ্ভাবক সায়েবাকে নিয়ে কোনো আলোচনাই নেই আমাদের দেশে। অনেকে হয়তো জানেনই না যে সায়েবাস মেথডের এই সায়েবা কে?
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অপারেশন টেবিলে ১৭ বছর আগে অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে এক প্রসূতি মায়ের অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণের চিত্র দেখেন কর্তব্যরত ডাক্তার সায়েবা। তখন নিতান্ত বাধ্য হয়ে পরিস্থিতির চাপে উপস্থিত বুদ্ধি হিসেবে এই কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি। এটিই যে একদিন বিশ্বজয়ী এক উদ্ভাবন হবে, ডাক্তার সায়েবা নিজেও তা ভাবতে পারেননি। তাঁর এই মেথড এখন অনুকরণ করা হচ্ছে দেশে দেশে। ইউনিসেফ, আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতাল, ওয়ার্ল্ড ভিশন, পাথফাইন্ডারসহ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা এটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
একটি ক্যাথেটার, একটি সাধারণ কনডম আর স্যালাইন পানি—এই তিনটি সাধারণ জিনিস ব্যবহার করেই সায়েবা আক্তার তাঁর এই জীবনরক্ষাকারী ‘কিট’ বানিয়েছেন। এটি এখন ৯৩ শতাংশ ক্ষেত্রে প্রসূতি মায়ের জীবন রক্ষা করতে সফল হচ্ছে। বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও আফ্রিকা মহাদেশ ও দক্ষিণ আমেরিকার এক ডজন দেশে সরকারি কর্মসূচির অংশ হয়ে উঠেছে এই পদ্ধতি। এটা তৈরি করতে সাকল্যে মাত্র ১০০ টাকা খরচ পড়ে।
কীভাবে কাজ করে সায়েবার এই প্রযুক্তি
আমাদের শরীরের চামড়ার কোথাও যদি কেটে যায় তবে তা কিছুক্ষণ চেপে ধরে থাকলে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়ে যায়। একইভাবে কনডম দিয়ে তৈরি ওই প্রযুক্তি ফুলিয়ে জরায়ুমুখে স্থাপন করা হলে প্রসবকালীন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ বন্ধ করা যায়। এটাই এই প্রযুক্তির কৌশল। এমনকি যে রোগীর কলের মতো রক্তপাত হয়, সেটাও ১০ মিনিটের মধ্যে এই পদ্ধতি প্রয়োগে বন্ধ করা সম্ভব।
এবং সারাহাহ
গত কিছুদিন ধরে সোশ্যাল মিডিয়ার সারাহাহ অ্যাপ নিয়ে তুমুল উৎসাহ-উদ্দীপনা চলছে দেশের ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যে। নিজের পরিচয় গোপন রেখে অন্যকে মেসেজ পাঠানো যায় এই অ্যাপস দিয়ে। সারাহাহ নিয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনায় আমার আপত্তি নেই। কিন্তু আমরা দূরদেশের সারাহাহ অ্যাপস সম্পর্কে যতটুকু জানি, নিজ দেশের অবিস্মরণীয় উদ্ভাবন সায়েবাস মেথড সম্পর্কে সেভাবে জানি না, চিনি না। আর এ কারণেই ১৭ বছর পরও এই মেথড আমাদের অচেনা-অজানা। অথচ এই মেথডটি সম্পর্কে গ্রামে-গঞ্জের মানুষদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা গেলে হাজার হাজার মায়ের জীবন রক্ষা করা যেত। এই না জানানো বা জনগণকে সচেতন করতে না পারার ব্যর্থতার দায় গণমাধ্যমেরও আছে।
আমাদের গণমাধ্যমগুলো সারাহাহর নতুন নতুন কী ফিচার এলো সে সম্পর্কে দিনের পর দিন খবর পরিবেশন করে। অথচ জীবন রক্ষাকারী নিজের দেশের সায়েবাস মেথড সম্পর্কে জানাতে পারে না। তারা জানাবে কী করে, তারা নিজেরাই তো চেনে না ডাক্তার সায়েবাকে।
লুৎফর রহমান হিমেল,
সাংবাদিক, কলামিস্ট। বার্তা সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।
No comments:
Post a Comment