মোবাইল ফো‌ন : ব্যবহার ও সতর্কতা

মোবাইল ফোন কীভাবে ব্যবহার করতে হবে, মোবাইল টাওয়া‌রের ক্ষ‌তিকর প্রভাব, অ্যাপস- এর প‌রি‌মিত ব্যবহার, মোবাইল ফোনের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের কুফল, এসব বিষয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৮৩৫তম পর্বে কথা বলেছেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের নাক কান গলা ও হেড নেক সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. মনিলাল আইচ লিটু।

মোবাইল ফোন ব্যবহারের সঠিক নিয়ম

মোবাইল ফোন ব্যবহারে শরীরে বিভিন্ন সমস্যা হয়। তাই এটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।
প্রশ্ন : মোবাইল ফোন ব্যবহারের কারণে কোনো সমস্যা নিয়ে কি রোগীরা আপনাদের কাছে আসে?
উত্তর : আমরা খুব কম কেস পাই। বেশি কেস যায় সাইকিয়াট্রিস্টদের কাছে বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের কাছে। আমাদের কাছে কিছু কিছু কেস আসে যে কানে শুনছে না। কানের ওপরও একটি প্রভাব পড়ছে। হাঙ্গেরিয়ান একটি গবেষণা হয়েছিল। দেখা গেছে যে তিন ঘণ্টার বেশি যাঁরা মোবাইল কানে দিয়ে গান শোনেন, তাঁদের ক্ষেত্রে তিন বছর পর তার প্রভাব পড়া শুরু করে। শ্রবণশক্তি আস্তে আস্তে কমে যায়। এটি বেশি প্রভাব ফেলে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে।
প্রশ্ন : হেডফোন লাগিয়ে যে মোবাইল থেকে গান শুনছে, সেটি কতটুকু করা উচিত?
উত্তর : এর ভলিয়ম অবশ্যই ৬০ ডেসিবেলের কম হতে হবে। আর সেটা এক ঘণ্টার বেশি নয়।
আপনি যখন কথা বলেন, তখন ইলেকট্রোম্যাগনেটিভ রেডিয়েশন বের করে। সেই রেডিয়েশন শরীরে তাপ তৈরি করে। এতে আমাদের শরীরের ভেতর যে ডিএনএ, এটি ভেঙে যায়। একে ডব্লিউএইচও কারসিনোজেনিক হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। আপনি যদি ১৫ মিনিট কথা বলেন, তাহলে চার ডিগ্রি সেলসিয়াস মস্তিষ্কের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। যে পরিমাণ রেডিয়েশন এমিট করে, এটি নিয়ে যদি আপনি পানির মধ্যে ছেড়ে দেন, তাহলে পাত্রটি ব্লাস্ট হয়ে যায়। তাই বলা হয়েছে, মোবাইল ফোনে পাঁচ মিনিট কথা বলার পরে তিন মিনিট অবশ্যই বিশ্রাম নেবেন। বিরতির আদর্শ সময় হলো ১০ মিনিট। তবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পর ধরে মোবাইল ফোনে কথা বলা যাবে না। সেই ক্ষেত্রে ব্লুটুথ ব্যবহার করতে হবে, ল্যান্ডফোন ব্যবহার করতে হবে, হ্যান্ডস প্রি ব্যবহার করতে হবে, যেন সরাসরি রেডিয়েশন না আসে।
গবেষণায় দেখা গেছে, স্যালাইভারি গ্রন্থির যে টিউমার, এটি রেডিয়েশনের কারণে তৈরি হতে পারে। কোনো কোনো গবেষণায় মস্তিষ্কের টিউমারের কথা বলা হয়েছে। তবে একে নির্দিষ্ট করা হয়নি।

মোবাইলের টাওয়ার থেকেও ক্ষতি

মোবাইল থেকে শরীরে যেমন নানা ক্ষতি হয়, তেমনি মোবাইলের টাওয়ারের রেডিয়েশনের কারণেও ক্ষতি হয়।
প্রশ্ন : মোবাইল ফোনের টাওয়ার থেকে শরীর ও মনে কী ধরনের প্রভাব পড়ছে?
উত্তর : টাওয়ার রেডিয়েশন তো খুবই ভয়ংকর। এটি সম্পর্কে মানুষকে আগে ধারণা দেওয়া হয়নি। ওই এলাকায় যত মোবাইল একসঙ্গে কাজ করছে, সবগুলোর রেডিয়েশন কিন্তু ওই টাওয়ারের মাধ্যমে যাচ্ছে। এতে যেখানে টাওয়ার অবস্থিত, সেখানে প্রচুর রেডিয়েশন তৈরি হচ্ছে।
আপনি যদি গ্রামে যান, টাওয়ারের আশপাশে যদি দেখেন, দেখবেন সেখানে গাছগুলো মরে গেছে, পাতা মরে যাচ্ছে। ডাবগাছে ডাব হচ্ছে না। এর মানে হলো, তার যে ডিএনএ তৈরি হয়, সেটি তৈরি হচ্ছে না। মানুষের মধ্যেও সেই প্রভাব পড়ে। ঘরের ওপর টাওয়ার লাগানোটা একদম নিষেধ। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রুল হয়েছে। ফ্রান্স, জার্মানিতে লোকালয়ে টাওয়ার লাগানোর বিষয়টিকে তারা সম্পূর্ণ নিষেধ করেছে। আশার কথা হলো, বাংলাদেশেও একটি নীতিমালা আসবে।

‘অ্যাপসের ব্যবহার সীমিত করতে হবে’

মোবাইল ফোন অনেক আকর্ষণীয় হয় অ্যাপসের মাধ্যমে। ত‌বে এসব অ্যাপস ব্যবহারে বিভিন্ন ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে।
প্রশ্ন : মোবাইল ফোন আসলে এখন বেশি আকর্ষণীয় হয়েছে অ্যাপসের মাধ্যমে। সেটির কী কী ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে? সেগুলো কীভাবে ব্যবহার করা উচিত বলে আপনি মনে করেন?
উত্তর : মোবাইল ফোনে যেই অ্যাপসগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে সেগুলোর ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, বাচ্চাদের ক্ষেত্রে শেয়ার করে ব্যবহার করতে। ঠিক সে রকম আপনি যে পাসওয়ার্ড ব্যবহার করছেন, সেটি মা বা বাবার সঙ্গে শেয়ার থাকতে হবে। এতে আপনি জানতে পারছেন, আপনার বাচ্চা কতক্ষণ এটি ব্যবহার করছে বা কীভাবে এটি ব্যবহার করছে। আর এর ব্যবহার সীমিত করতে হবে, বিশেষ করে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে। তাকে যদি ইন্টারনেট ব্যবহার করতে দেন, তাহলে নির্দিষ্ট করে দিন কোন সময়টুকু সে ব্যবহার করতে পারবে।
এই সমস্যা যে কেবল আমাদের দেশে হচ্ছে সেটি নয়, সারা পৃথিবীতেই হচ্ছে।

মোবাইল ফোনের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে যেসব ক্ষতি

মোবাইল ফোনের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে নানা ক্ষতি হতে পারে।
প্রশ্ন : মোবাইল ফোনের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে শারীরিক ও মানসিক কী কী ক্ষতি হতে পারে?
উত্তর : আমরা যদি বয়স অনুযায়ী চিন্তা করি, ১২ বছরের কম যে শিশুরা, তাদের ক্ষেত্রে এক ধরনের প্রভাব রয়েছে। প্রাপ্তবয়স্কদের এক ধরনের প্রভাব রয়েছে। গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে আরেকটি প্রভাব রয়েছে।
প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে সড়ক দুর্ঘটনার একটি বড় কারণ মোবাইল ব্যবহার। ক্যানসারের ঝুঁকি রয়েছে। ঘুমের সমস্যা, বিষণ্ণতা, স্যালাইভারি গ্রন্থিতে টিউমার এগুলো হতে পারে। দেখা গেছে, মোবাইল ফোনের অতিরিক্ত আসক্তি কাজের সময় নষ্ট করে। যাঁরা বেশি মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন, তাঁদের বিষণ্ণ হওয়ার সংখ্যা অনেক বেশি। আর বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি হচ্ছে স্ক্রিন এডিকশন। স্ক্রিনের প্রতি সব সময় তাদের একটি আসক্তি থাকে। এর পর তাদের মূল কাজ যেটা, লেখাপড়া বলেন, সামাজিকীকরণ বলেন, খেলাধুলা—কোনো কিছুর প্রতি তার নজর থাকে না। স্ক্রিনে আসক্ত হয়ে যায়।
শারীরিক প্রভাব বাচ্চাদের ক্ষেত্রে আরো রয়েছে। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, চোখের জ্যোতি নষ্ট হয়ে যায়। কানে শোনে কম। অস্টিওপরোসিস বেশি হয়। বিষণ্ণতার সংখ্যা বেশি। সাইবার বুলিং হয় তাদের প্রতি। এক-তৃতীয়াংশ বাচ্চা সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়। বিভিন্ন গেমস, অ্যাপসের মাধ্যমে এটি হয়। ক্রিমিনাল গেমস কচি মনে বা সরল মনে প্রভাব ফেলে।
এ ছাড়া মোবাইল ফোন পকেটে রাখলে দেখা যায়, স্পার্ম বা ভ্রুণের কোয়ালিটি কমে যাচ্ছে। হার্টের সমস্যা দেখা যায়, যদি বুকে রাখা হয়।
মোবাইল ফোন ব্যবহারের সময় গাড়ি চালানোও কিন্তু নিষিদ্ধ। দেখা যাচ্ছে, গাড়ি চালানোর সময় যাঁরা মোবাইল ফোন ব্যবহার করছেন, তাঁদের ছয় ভাগ বেশি দুর্ঘটনা হচ্ছে।

No comments:

Post a Comment