ডা. শিলা আহসা‌নের সফলতার পেছ‌নের গল্প

মানবকন্ঠ: বারবার ব্যর্থ হচ্ছিলেন ডা. শিলা আহসান। কিন্তু তিনি এক বিন্দু মনোবল হারাননি। কারণ হাল ছেড়ে দেয়ার পাত্রী তিনি নন। তিনি আইইএলটিএস এ ভালো স্কোর পেয়ে, দরখাস্ত করতে থাকেন বিদেশের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে। তিনি বলেন, ‌‘অসংখ্য ইউনিভার্সিটি থেকে হতাশ হয়েছি। তবু মনোবল হারায়নি। গুগলে ক্যান্সার এপিডেমিওলজি লিখে অসংখ্যবার বিভিন্ন দেশে চেষ্টা করেছি। পছন্দের বিষয়, পরিবেশ, পরিস্থিতি, আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট সবকিছু মিলিয়ে সারা পৃথিবীর হাজার হাজার ইউনিভার্সিটির ভেতর থেকে পছন্দের বিষয়ে পড়ার সুযোগ পাওয়াটা ভীষণ প্রতিযোগিতাময়।’

তিনি সবার উদ্দেশ্যে বলেন, দেশের বাইরে ভালো ইউনিভার্সিটিতে ভালো বিষয়ে পড়তে হলে আইইএলটিএস স্যাট, টোফেল, জিআরই এই পরীক্ষাগুলোতে ভালো স্কোর পেতে হবে। কারণ সারা পৃথিবী থেকে হাজার হাজার ছেলে মেয়ে দরখাস্ত করে। আর দরখাস্ত করলেই হবেনা, লেগেই থাকতে হবে। এক সেমিস্টারে ব্যর্থ হলে পরের সেমিস্টারে চেষ্টা করতে হবে। আমি সরকারি চাকরির পাশাপাশি নিয়মিত পড়ালেখা করেছি, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বিভিন্ন কাগজপত্র যোগাড় করেছি।
প্রথম দিকে বাসার অনেকেই রাজি ছিলনা। কারণ, একজন মেয়ে মানুষ হয়ে দেশের বাইরে একা পড়তে যেতে চেয়েছিলাম। আজ আমার কষ্ট সার্থক যে, আমার স্বামীও আমার সঙ্গে যেতে পারবেন। ফিনল্যান্ডের সরকার স্কলারশিপ হিসাবে আমাকে প্রতি মাসে বারোশো ইউরো দিবেন। আমার পরিবারকে রাজি করানোর জন্য আমার স্বামী ও বান্ধবী উকিল মিলিকে কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করছি।

তিনি সবাইকে পরামর্শ দেন ‘গুগলে ইউনিভার্সিটি অফ টেমপেরি লিখে সার্চ দিতে। তাহলে ইউনিভার্সিটির যাবতীয় তথ্য পাওয়া যাবে। নভেম্বরের আবারো সার্কুলার হবে। যারা পড়তে যেতে চান, তারা যোগাযোগ করবেন।’
প্রিয় পাঠক, আজ আমরা শুনবো মেধাবী চিকিৎসক শিলা আহসানের সাফল্যের কাহিনী।
চোখ ভরা স্বপ্ন আর বুক ভরা আশা ছিল মেয়েটির। শৈশব থেকেই স্বপ্ন দেখতেন আকাশ ছোঁয়ার। সরকারি চাকরিজীবী পিতা মৃত আব্দুস সাত্তারের আদর্শে লালিত তৃতীয় সন্তান শিলা। শিশু বয়স থেকেই লেখাপড়া, গান, নাচ, কবিতা, আবৃত্তি, উপস্থাপনাতে ছিলেন ভীষণ পারদর্শী।
তার মা চেয়েছিলেন তিনি যেন সব দিক দিকে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। আর তাই ছোট বেলা থেকে সেভাবেই গড়ে তুলেছিলেন তিনি।
সিরাজগঞ্জের নিরিবিলি সবুজের মাঝে তিনি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন আকাশ ছোঁয়ার। সিরাজগঞ্জের সালেহা ইসহাক সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং রাশিদাদ জোহা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন তিনি।
বাবা মারা যাবার পর পরিস্থিতি কিছুটা এলোমেলো হয়ে যায়। নাম লেখাতে ব্যর্থ হন সরকারি মেডিকেল কলেজে। পিতা মাতা ও পরিবারের সবার প্রচণ্ড ইচ্ছে ছিল তিনি চিকিৎসক হবেন। চিকিৎসা ক্ষেত্রে রাখবেন বিশেষ অবদান। সবার স্বপ্নকে সত্যি করার জন্যই তিনি ভর্তি হন নগরীর রায়ের বাজারস্থ শিকদার মহিলা মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালে।
শৈশব থেকেই স্বপ্ন দেখতেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়বেন। স্বনামধন্য চিকিৎসক হবেন। কিন্তু, সরকারি মেডিকেল কলেজে সুযোগ না পাওয়ার জন্য তার মনের প্রতিজ্ঞা আরো দৃঢ় হয়ে ওঠে।
তিনি মনস্থির করেন, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে লেখাপড়া করলেও সরকারি মেডিকেল কলেজের ছেলে মেয়েদের মতো যোগ্য হবেন।
মেডিকেল জীবনের তিনটি বোর্ডের পরীক্ষায় তিনি কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। মেডিকেল কলেজের ছাত্রী থাকাকালীন থেকেই প্রশংসিত হতে থাকেন সব শিক্ষকদের কাছে। উচ্ছল প্রাণবন্ত ব্যবহার, ক্লাসের শিক্ষার্থীদের প্রতি সহমর্মিতার জন্য তিনি হয়ে উঠলেন সবার প্রিয়। ২০১১ সালে এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করেন। নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পন্ন করেন ইন্টার্নির দীর্ঘ এক বছর। ইন্টার্ন শেষে যোগদান করলেন তার নিজ মেডিকেল কলেজের এনাটমি বিভাগের প্রভাষক হিসাবে।
এরপর মেডিকেল কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, নগরীর ল্যাব এইড হসপিটাল এবং মডার্ন মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালে। স্বপ্ন দেখতেন সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক হবেন তিনি।
কিন্তু, সময়ের ডানায় ভর করে সেই স্বপ্ন পরিবর্তিত হয়। তিনি ২০১৪ সালে বি.সি.এস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। প্রথম পোস্টিং ছিল সিরাজগঞ্জে।
সিরাজগঞ্জের কামারখন্ড উপজেলায় কর্মরত থাকাকালীন তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দৃষ্টিতে আসেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ স্যারের তত্ত্বাবধানে ট্যালেন্ট হান্ট প্রোগ্রাম (স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে) আয়োজিত হয়। এই কর্মসূচির আওতায় যাদের নেতৃত্বের ক্ষমতা রয়েছে, তাদের থেকে পুরো বাংলাদেশে দশ জন বিসিএস ক্যাডারকে নির্বাচন করা হয়। যারা নেতৃত্ব ও প্রযুক্তিতে বিশেষ দক্ষ। সারাদেশ থেকে দশ জন বিসিএস ক্যাডার নিয়ে কো-অর্ডিনেশান পলিসি প্ল্যানিং তৈরি করা হয়। সেই মেধাবী দশজনদের মাঝের একজন হলেন চিকিৎসক শিলা।
আমেরিকা ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ উদ্যোগে তিন মাস এর এক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। ইউএসএসিডিসি (USA Center for Disease Control) এর অধীনে তিন মাসের কর্মশালাতে অংশগ্রহণ করেন অসংখ্য চিকিৎসক।
এই কর্মশালাতে শিলা উপলব্ধি করেন, তিনি জনশক্তি বিষয়ক কাজে সংযুক্ত থাকলে, মানুষের উপকার করতে পারবেন বেশি। এই কর্মশালাতে আমেরিকা ও বাংলাদেশের উচ্চ পদস্থ জনশক্তির সংযোগ ঘটে।
এতে তিনি সবার নজর কাড়েন। নেতৃত্ব, ইংরেজিতে উপস্থাপনা, বন্ধু সুলভ আচরণের জন্য তিনি দেশ বিদেশের জনশক্তিদের কাছে সমাদৃত হন। এই কর্মসূচি বিশ্বের আরো ২২টা দেশে অনুষ্ঠিত হয়। এই কর্মসূচির পর থেকে তিনি জনস্বাস্থ্য বিষয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন।
অ্যানথ্রাক্স এর উপরেও কাজ করেন তিনি।
সরকারি চাকরিতে যুক্ত হবার পর থেকেই উপলব্ধি করেন, বিদেশ থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করলে, তিনি আরো দক্ষ হবেন। দেশকে সেবা দিতে পারবেন আরো বেশি। চাকরির পাশাপাশি আইইএলটিএস করেন এবং ভালো স্কোর পেয়ে ফিনল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অফ ট্যামপেরিতে ডক্টরেট প্রোগ্রামে এপিডেমিওলজিতে পড়ার সুযোগ পান। ফিনল্যান্ডের এই ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ পাবার জন্য ডা. শিলার সঙ্গে তার স্বামীও ফিনল্যান্ডে থাকবার অনুমতি পেয়েছেন।
একই সঙ্গে তিনি ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশানের এক মাস ব্যাপী ক্যান্সার গবেষণার জন্য কর্মশালার উপরে ফ্রান্স এর বৃত্তি পান। আগামী জুন থেকে জুলাই পর্যন্ত এই কর্মশালা। ক্যান্সার নিরাময়, প্রতিকার, দ্রুত নির্ণয় এর বিষয়ে এক মাস ব্যাপী কর্মশালা এবং সম্প্রতি ইন্ডিয়ার মহালি থেকে এক মাসের (পাঞ্জাব) প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেন। তার প্রশিক্ষণের বিষয় ছিল, ‘স্পেশালাইজ ট্রেইনিং প্রোগ্রাম ইন হেলথ কেয়ার টেকনোলোজি ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ক্লিনিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং।’
বর্তমানে তিনি স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তা। তার এই সফলতার জন্য তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ত্রী ও প্রসূতি বিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আশরাফুন নেশা পিয়া এবং অধ্যাপক ফাতেমা আশরাফ ম্যাডামের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন।
তার সহকর্মী ডা. রুবাইয়াত, ডা. আরাফাত, অস্ট্রেলিয়ার নিউ ক্যাসেল ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ডা. মিলটনের কাছে ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ। ডা. দিলীপ কুমার এর দিক নির্দেশনা তার সফলতার জন্য বিশেষ অবদান রেখেছে।
তিনি তার স্বামী রাগিব আহসানের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে বলেন, ‘ নিজের এই সফলতার জন্য পরিবারের পাশাপাশি, স্বামীর অবদান অপরিহার্য্য।
তিনি বলেন, ‘আমাদের সমাজে নারীরা যদি পরিবার ও শ্বশুর বাড়ির সহযোগিতা সঠিকভাবে পায় তাহলে তারা আরো বেশি পরিমাণে সফল হবে।’
উন্নত বিশ্বে দেশের পতাকা ওড়ানোর স্বপ্ন দেখেন তিনি। জয় হোক ডা. শিলার। সাফল্যের মশাল হাতে তিনি এগিয়ে যান।

No comments:

Post a Comment