মারুফের তুলনাহীন মানবসেবা

রংপুর থে‌কে আলতাফ হোসেন ও রহিদুল মিয়া |
অসুস্থ, অপ্রকৃতিস্থদের সেবা করাই তাঁর নেশা। রাস্তাঘাট, রেলস্টেশন ও বাসস্ট্যান্ডে অসুস্থ-অসহায় কাউকে পড়ে থাকতে দেখলে তুলে নিয়ে আসেন। করেন সেবাযত্ন। চিকিৎসার দরকার হলে নিয়ে যান হাসপাতালে। যত দিন সুস্থ না হন, তত দিন পাশে থাকেন। আপনজনদের সন্ধান পেলে তাঁদের হাতে তুলে দেন। আর না পেলে নিজের কাছে আগলে রাখেন। পরোপকারী এই ব্যক্তি হলেন মারুফ। পুরো নাম মারুফ কেইন। বয়স তাঁর চল্লিশের কোঠায়। এ পর্যন্ত ১৯ জন নারীসহ ২৬ জন অজ্ঞাত অসহায় অসুস্থ মানুষকে তুলে এনে সেবাযত্ন ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন। যাঁরা ঠিকানা বলতে পারেন না, তাঁদের স্থান মেলে মারুফের উদ্যোগে গড়া গ্লোরি চ্যারিটেবল অর্গানাইজেশনে। ঠিকানাহীন এমন অসহায় ছয়জন নারীর সেবা-শুশ্রূষা দেওয়া হচ্ছে ওই প্রতিষ্ঠানে।

রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে হাসিনানগর গ্রাম। ওই গ্রামে মারুফের চেষ্টায় ও সাধারণ মানুষের সহায়তায় গড়া গ্লোরি চ্যারিটেবল ফাউন্ডেশনের কার্যালয়। সম্প্রতি সরেজমিনে
দেখা যায়, ৭ শতক জমির মাঝখানে গড়ে তোলা ওই সংগঠনের টিনশেডের আধা পাকা দুটি ঘর। মেঝে কাঁচা। চারদিকে ফুলের বাগান। ঘরের ভেতরে ছয়জন নারী। কেউ হাসছেন, কারও মুখ গম্ভীর। আনুমানিক ৭০ বছর বয়সের এক বৃদ্ধাকে যত্নে খাবার খাওয়াচ্ছেন মারুফ। মারুফের কাছেও ওই বৃদ্ধার পরিচয় অজানা। বৃদ্ধা কথা বলতে পারেন না। দিনাজপুরের পার্বতীপুর শহরের নতুনবাজারে অচেতন অবস্থায় পড়ে ছিলেন। মাথায় ছিল দগদগে ঘা। সারা শরীরে দুর্গন্ধ। প্রায় ১১ মাস আগে সেখান থেকে ওই বৃদ্ধাকে গ্লোরি চ্যারিটেবল অর্গানাইজেশনের কার্যালয়ে নিয়ে আসেন মারুফ। এরপর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করান।

কথা হলো মারুফের সঙ্গে। ১৯৭৮ সালে কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলার রামদাশ ধনীরামপাড়া গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন মারুফ। বাবার নাম আমিনুল ইসলাম, মা ফাতেমা বেগম। আট ভাইবোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। ১৯৯৮ সালে বিএ পাস করেন। ২০০০ সালে পাশের বিজয়রাম গ্রামের মরিয়ম বেগমকে বিয়ে করেন। ১০ বছর বয়সের একমাত্র ছেলেসন্তান রয়েছে তাঁদের।
মারুফ বলেন, বিয়ের পর তিনি কিছুদিন ব্যবসা করেন। পরে ২০০৭ সালে দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার বেসরকারি চিকিৎসা সংস্থা মিশনারি ল্যাম্ব হাসপাতালে চাকরি নেন। চাকরির কাজে তাঁকে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ছুটতে হতো। অবহেলায় পড়ে থাকা অসুস্থ, অপ্রকৃতিস্থ মানুষ দেখলে তাঁদের জন্য কিছু একটা করার তাগিদ অনুভব করতেন তিনি।

২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে পার্বতীপুর উপজেলার সরকারপাড়া গ্রামের রাস্তার কাছে অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় শিবানী নামে আনুমানিক ৫৫ বছরের এক নারীকে দেখতে পান মারুফ। ওই নারীর সারা শরীরে দুর্গন্ধ, পেটে ঘা এবং মাথার চুলে বিশালাকৃতির জট ছিল। মারুফ ওই নারীকে উদ্ধার করে পার্বতীপুরের হাতিডাঙ্গাপাড়ায় নিজের ভাড়া করা বাসায় নিয়ে আসেন। স্ত্রীর সহায়তায় তাঁর শরীর পরিষ্কার করেন। শিবানীকে সেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন।
কিন্তু ঠিকানা ও অভিভাবক খুঁজে না পাওয়ায় তিন মাস পর বাধ্য হয়ে শিবানীকে রংপুরের নজিরহাট নারী নিকেতন কেন্দ্রে রেখে আসেন। ফেরার পথে পার্বতীপুর রেলওয়ে স্টেশন চত্বরে তিনি আনুমানিক ৩৫ বছর বয়সের এক ব্যক্তিকে উলঙ্গ ও অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। তাঁর পা দুটিতে ছিল দগদগে ঘা। পথচারীরা নাকে-মুখে রুমাল চেপে পাশ দিয়ে যাওয়া-আসা করছেন।
এরপর ওই রোগীকে গামছা দিয়ে মুড়িয়ে পাঁজাকোলা করে অনেক অনুরোধ করে একটি অটোরিকশাচালককে রাজি করিয়ে সোজা চলে যান রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। চিকিৎসক শর্ত জুড়ে দেন, ক্ষতস্থান পরিষ্কার করতে হবে মারুফকেই। মারুফ চিকিৎসকের পরামর্শমতো হাতে গ্লাভস পরে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করেন। ওই হাসপাতালেই মারুফ একাধারে ১০ দিন থেকে তাঁকে কিছুটা সুস্থ করে তোলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লোকটিকে বাঁচানো যায়নি।
ওই ঘটনা দুটি মারুফের মনে ব্যাপক নাড়া দেয়। সিদ্ধান্ত নেন, পথে-ঘাটে পড়ে থাকা অসুস্থ ও অপ্রকৃতিস্থ মানুষকে সুস্থ ও স্বাভাবিক করে তোলাই হবে তাঁর মূল কাজ। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ওই বছরের মে মাসে রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের হাসিনানগর নামাপাড়া গ্রামে বসতবাড়ি করার জন্য কেনা জমিতে আধা পাকা দুটি ঘর তৈরি করেন। পথে-ঘাটে পড়ে থাকা অসুস্থ মানুষকে উদ্ধার করে সেখানে এনে রাখেন। নাম দেন গ্লোরি চ্যারিটেবল অর্গানাইজেশন।

২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মারুফ বদরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নে রাস্তার পাশে অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় এক যুবককে পড়ে থাকতে দেখেন। ওই যুবকের সারা শরীরে মল ও কাদা লেগে ছিল। তাঁকে সেখান থেকে তুলে এনে দুই মাস ধরে বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসা করান। একসময় ওই যুবক ভাঙা ভাঙা কথায় নিজের নাম আরব আলী ও বাবার নাম হাসেম মোল্লা বলে জানান। বলেন, তাঁর বাড়ি মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার রাধানগর গ্রামে। মারুফ বিষয়টি রংপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শহিদুল ইসলামকে জানালে তিনি অভিভাবকদের ডেকে এনে আরব আলীকে তাঁদের হাতে তুলে দেন।
এভাবে মারুফ গত তিন বছরে ২৬ জন অসুস্থ ও অপ্রকৃতিস্থ মানুষকে চিকিৎসা ও সেবাযত্ন দিয়ে সুস্থ করে পরিবারের সদস্যদের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন। তাঁর এসব কর্মকাণ্ডে অনপ্রাণিত হয়ে এলাকার মানুষ, বন্ধুবান্ধবও এগিয়ে এসেছেন। সংস্থাটি পরিচালনার জন্য বিভিন্ন পেশার ৩১ সদস্যের একটি কমিটি রয়েছে।
ওই কমিটির সভাপতি নিমাই চন্দ্র দাস বলেন, অর্গানাইজেশনের কার্যালয়ে বিদ্যুৎ নেই। ঘর দুটি আধা পাকা টিনের চালার। ছাদ নেই। একটি ঘরে ফাউন্ডেশনের কার্যালয়, অন্য ঘরে থাকেন ঠিকানাহীন অসুস্থ কয়েক নারী। ঘরের সংকটের কারণে অসুস্থ পুরুষ মানুষকে এখানে এনে রাখা সম্ভব হয় না। গ্রামের ৬৯টি পরিবার প্রতি মাসে এক কেজি করে মুষ্টি চাল ফাউন্ডেশনের তহবিলে দিচ্ছে। কমিটির সদস্যরাও সাধ্য অনুযায়ী আর্থিক সহায়তা করছেন। মারুফ প্রতিষ্ঠানটির নামে ঘরসহ ৩ শতক জমি লিখে দিয়েছেন। বর্তমানে গ্লোরি চ্যারিটেবল অর্গানাইজেশনে ছয়জন অপ্রকৃতিস্থ ঠিকানাহীন নারী রয়েছেন।

স্থানীয় রামনাথপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘মারুফ অসহায় মানুষের জন্য যা করছেন, আমরা জনপ্রতিনিধি হয়েও হয়তো তা করতে পারছি না। তিনি আমাদের এলাকার গর্ব।’
মারুফের কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে অসুস্থদের সেবায় এগিয়ে এসেছেন রুখিয়া রাউৎ (২০) ও ভারতী রানী (৪৫) নামের এলাকার দুই গরিব নারী। এর মধ্যে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর রুখিয়া রাউৎ রংপুর কারমাইকেল কলেজে পড়াশোনা করছেন। আর ভারতী রানীর সংসার চলে অতিকষ্টে।
জানতে চাইলে রুখিয়া রাউৎ বলেন, ‘অসহায় মানুষের সেবাযত্ন করতে আমার খুব ভালো লাগে। ফাউন্ডেশনে থাকা অসহায় নারীদের ভারতী দিদিসহ আমি নিজ হাতে গোসল করাই। রান্না করে খাওয়াই। সপ্তাহে তিন দিন কলেজে যাই। দু-তিন দিন দিনমজুরির কাজ করি। এই টাকায় আমি নিজের পড়াশোনাসহ ফাউন্ডেশনে থাকা অসুস্থ অসহায়দের পেছনে ব্যয় করি।’

উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলে রাব্বী বলেন, ‘গ্লোরি চ্যারিটেবল অর্গানাইজেশন অসুস্থ অসহায় মানুষের জন্য যা করছে, তা আমরাও করতে পারছি না। মারুফ ও দুই নারী স্বেচ্ছায় যা করছেন, তা অতুলনীয়। আমি আমার পক্ষ থেকে ওই ফাউন্ডেশনকে সব ধরনের সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করব।’

উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির বলেন, মারুফের গড়া গ্লোরি চ্যারিটেবল ফাউন্ডেশনের কাজ একেবারেই ব্যতিক্রমধর্মী। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সংগঠনটিকে সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিবন্ধনভুক্ত করার জন্য গত বছরের জুলাইয়ে জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে।

‘এটা আমার নেশা। কেউ মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এলে তাঁর মুখটা দেখে বুকটা ভরে যায়। তাই কাজটাকে কখনো কষ্ট মনে করি না।’ বললেন মারুফ কেইন। তিনি আরও বলেন, ‘স্ত্রী ও মা আমাকে বেশি উৎসাহ দিচ্ছেন। এলাকার মানুষ সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।’

সূত্র: দৈ‌নিক প্রথম আ‌লো; ১১ মার্চ, ২০১৭।

No comments:

Post a Comment