সুইডেনের বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেলের ইচ্ছানুসারে নতুন কোনো কিছু উদ্ভাবন, বিশেষ গবেষণা এবং মানব জাতির কল্যাণে অসামান্য অবদান রাখার জন্য প্রতি বছর নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়। পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসা, সাহিত্য, শান্তি ও অর্থনীতিতে দেয়া হয় এ পুরস্কার।
১৮৯৫ সালের নভেম্বর মাসে আলফ্রেড নোবেল তার মোট উপার্জনের ৯৪% (৩ কোটি সুইডিশ ক্রোনার) দিয়ে তার উইলের মাধ্যমে নোবেল পুরষ্কার প্রবর্তন করেন। এই বিপুল অর্থ দিয়েই শুরু হয় পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, সাহিত্য ও শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রদান। ১৯৬৮ তে তালিকায় যুক্ত হয় অর্থনীতি।
পুরস্কার ঘোষণার আগেই মৃত্যু বরণ করেছিলেন আলফ্রেড নোবেল। আইনসভার অনুমোদন শেষে তার উইল অনুযায়ী নোবেল ফাউন্ডেশন গঠিত হয়। তাদের ওপর দায়িত্ব বর্তায় আলফ্রেড নোবেলের রেখে যাওয়া অর্থের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ন করা এবং নোবেল পুরষ্কারের সার্বিক ব্যবস্থাপনা করা। আর বিজয়ী নির্বাচনের দায়িত্ব সুইডিশ একাডেমি আর নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটিকে ভাগ করে দেয়া হয়।
শান্তিতে নোবেল জিতলেন পরমাণু অস্ত্রবিরোধী সংগঠন ‘আইসিএএন’
২০১৭ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার পেলেন পরমাণু অস্ত্রবিরোধী সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পেইন টু অ্যাবোলিশ নিউক্লিয়ার ওয়েপনস (আইসিএএন)। পরমাণুমুক্ত বিশ্ব গড়ার প্রচারাভিযানে ভূমিকা রাখার স্বীকৃতি স্বরূপ শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেল এই সংগঠনটি।
২০০৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে আত্মপ্রকাশ করে আইসিএএন। সংগঠনটি ১০১ টি দেশে পারমাণবিক অস্ত্র বিলোপে তৃণমূল পর্যায়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর প্রধান কার্যালয় সুইজারল্যান্ডের জেনেভায়। বর্তমানে সংগঠনটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিয়েট্রিস ফিহন।
বিজয়ী সংগঠন আইসিএএনকে ৯০ লাখ সুইডিস ক্রোনার মূল্যমানের পুরস্কার প্রধান করা হবে। বাংলাদেশি মুদ্রার এই পুরস্কারের মূল্য দাঁড়ায় ৯০ কোটি টাকা। প্রতি বছর কাকে অথবা কোন প্রতিষ্ঠানকে এই পুরস্কার দেয়া হবে তা সুইডিশ একাডেমি ঠিক করে এবং অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই নির্বাচিতের নাম ঘোষণা করে।
এদিকে এ নিয়ে ২৬তম বারের মতো কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান শান্তিতে নোবেল জিতল। চলতি বছর দ্বিতীয়বারের মতো রেকর্ড সংখ্যক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়েছিল। মোট ৩১৮ জন প্রতিযোগীর মধ্যে ছিল ২১৫ জন ব্যক্তি এবং ১০৩টি সংগঠনের নাম। এর আগে ২০১৬ সালে ৩৭৬ জন প্রতিযোগীকে শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়েছিল।
উল্লেখ্য, ১৯০১ সাল থেকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে। এবারেরটিসহ এ পর্যন্ত শান্তিতে ৯৭টি নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। নোবেল পুরস্কারের চারটি ক্যাটাগরির বিজয়ী সুইডিশ নোবেল কমিটি ঘোষণা করলেও শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের ঘোষণা নরওয়ে কমিটি দিয়ে থাকে।
সাহিত্যে নোবেল জিতলেন ব্রিটিশ লেখক কাজুও ইশিগুরো
২০১৭ সালে সাহিত্যে নোবেল জিতেছেন ব্রিটিশ লেখক কাজুও ইশিগুরো।
সুইডিশ কমিটির পক্ষ থেকে এই ব্রিটিশ লেখকের ব্যাপক প্রশংসা করে বলা হয় হয় ‘এই লেখক নিজের আদর্শ ঠিক রেখে, আবেগপ্রবণ শক্তি দিয়ে বিশ্বের সাথে আমাদের সংযোগ ঘটিয়েছেন।’
আটটি বই লিখেছেন তিনি, আর এ আটটি বই মোট চল্লিশটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
কাজুও ইশিগুরোর উপন্যাসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো 'দ্য রিমেইন্স অব দ্য ডে' এবং 'নেভার লেট মি গো'।
এ দুটি উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্রও তৈরি করা হয়েছে।
সাহিত্যে নোবেল জয়ের পর কাজুও ইশিগুরো তাঁর প্রতিক্রিয়ায় জানান ‘আমি অবাক হয়েছি, হতবিহ্বল হয়ে পড়েছি’।
বিজয়ী কাজুও ইশিগুরোকে ৯০ লাখ সুইডিস ক্রোনার মূল্যমানের পুরস্কার প্রধান করা হবে। বাংলাদেশি মুদ্রার এই পুরস্কারের মূল্য দাঁড়ায় ৯০ কোটি টাকা। প্রতি বছর কাকে এই পুরস্কার দেয়া হবে তা সুইডিশ একাডেমি ঠিক করে এবং অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই নির্বাচিতের নাম ঘোষণা করে।
সাহিত্যে নোবেল প্রদানের বিষয়ে আলফ্রেড নোবেলের কিছু নির্দিষ্ট বিষয় উল্লেখ ছিল। সে বিষয় অনুযায়ী এখনও সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। নোবেলের উইল অনুসারে জানা যায়, তিনি বলে গেছেন, ‘তাদেরকেই সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হবে যারা একটি আদর্শগত প্রবণতার মাধ্যমে কোন অনন্য সাধারণ কাজ প্রদর্শন করতে পারবেন।’
গত বছর (২০১৬) সাহিত্যে নোবেল পান বিখ্যাত গীতিকার ও গায়ক বব ডিলান। বব ডিলানকে নোবেল দেওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়, তিনি মার্কিন গানের ঐতিহ্যের সাথে নতুন কাব্যিক মাত্রা যোগ করেছেন।
রসায়নে নোবেল পেলেন ৩ মার্কিন বিজ্ঞানী
২০১৭ সালে রসায়নে নোবেল জিতেছেন ৩ মার্কিন বিজ্ঞানী
চিকিৎসা, পদার্থবিদ্যার পর এ বছর রসায়নেও নোবেল পেলেন তিন মার্কিন বিজ্ঞানী। তারা হলেন জ্যাকস ডুবোচেট, জোয়াশিম ফ্রাঙ্ক এবং রিচার্ড হেন্ডারসন।
সুইডেনের স্টকহোমে দ্য রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেস এ ঘোষণা দিয়েছে।
বিজয়ী তিন বিজ্ঞানী ৯০ লাখ সুইডিস ক্রোনার মূল্যমানের পুরস্কারটি ভাগাভাগি করে নেবেন। বাংলাদেশি মুদ্রার এই পুরস্কারের মূল্য দাঁড়ায় ৯০ কোটি টাকা। ১৯০১ সাল থেকে রসায়নে নোবেল পাওয়ার সম্মান অর্জনকারী ১৭৫ জনের তালিকায় যুক্ত হলেন এ তিন গবেষক।
নোবেল কমিটি জানায়, ক্রিয়ো ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কপির বিকাশে অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ তাদেরকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। জিকা ভাইরাসসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা কাজে ক্রিয়ো ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কপির ভূমিকা অপরিসীম।
বিশ্বের ‘সবচেয়ে ক্ষুদ্র যন্ত্র’ তৈরির জন্য গত বছর তিন জন বিজ্ঞানীকে রসায়নে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। তারা হলেন, জ্যঁ-পিয়েরে সাউভেজ, স্যার জে ফ্রেজার স্টোডার্ট এবং বার্নার্ড এল ফেরিঙ্গা।
পদার্থে নোবেল পেলেন তিন মার্কিন বিজ্ঞানী
২০১৭ সালে পদার্থে নোবেল জিতেছেন ৩ মার্কিন বিজ্ঞানী
বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্ত করে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরষ্কার ২০১৭ পেলেন তিন মার্কিন বিজ্ঞানী। এ তিন বিজ্ঞানী হলেন রেইনার ওয়েইস, ব্যারি ব্যারিশ ও কিপ থ্রোন।
রয়েল সুইডিশ একাডেমি স্টকহোমে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করেন। পুরস্কার ঘোষণাকালে বলা হয়- এই তিন বিজ্ঞানীর আবিষ্কার মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্ত করা ছিল ইতিহাসে মাইলফলক।
মহাকর্ষীয় তরঙ্গের এই ধারণা সর্বপ্রথম দেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। পুরস্কারের অর্ধেক সম্মানি পাবেন রেইনার উইস। বাকি অর্ধেক পাবেন ব্যারি বারিস ও কিপ থ্রোন।
থ্রোন ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। তিনি মহকর্ষীয় তরঙ্গ দেখতে কেমন ও সেটা কিভঅবে শনাক্ত করা যাবে সেই বিষয়ে একটি তত্ত্ব দিয়েছিলেন।
ব্যারি বারিশ একই ইনস্টিটিউটের পার্টিকেল পদার্থবিজ্ঞানী। এখন সেখানকার এমিরেটাস অধ্যাপক তিনি। ১৯৯৪ সালে লেজারইন্টারফেরোমিটার গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েব অভজারভেটরি বা লাইগোর পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেন তিনি। তবে সেসময় ঝুঁকির কারণে তার পরীক্ষা বাতিল করে দেওয়া হয়। ১৯৯৯ সালে নতুন করে গবেষণা শুরু করেন তিনি এবং তিন বছর পরে প্রথম পরিমাণ ঘোষণা করতে সক্ষম হন।
লাইগো নিয়ে তার সঙ্গে কাজ করেছেন স্কটিশ পদার্থবিজ্ঞানী রোনাল্ড ড্রেভার। তবে এই তরঙ্গ আবিষ্কারের ১৮ মাস পূর্বেই মারা যান তিনি। মৃত্যুর পর নোবেল পুরস্কার দেওয়ার কোনও নিয়ম নেই।
২০১৬ সালেই তাদের আবিষ্কারের ঘোষণা দিয়ে সারাবিশ্বে সাড়া ফেলে দেন বিজ্ঞানীরা। ২৫ ব্ছর ধরে গবেষণার ফল বেরিয়ে আসে। সূর্যের থেকে প্রায় ৩৫ গুণ ভারী দুটি কৃষ্ণ গহ্বরের সংঘর্ষ থেকে উৎপন্ন এই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ (গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ) শনাক্ত করা হয়েছে। পৃথিবী থেকে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে ওই দুটি ব্ল্যাক হোল একে অন্যের চারপাশে চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে এক পর্যায়ে একসঙ্গে মিশে যায়।
গত বছর (২০১৬) তত্ত্বের মধ্য দিয়ে পদার্থের টপোলজিক্যাল দশার দিশা দেখিয়ে পদার্থে নোবেল জিতেছিলেন তিন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী।
চিকিৎসায় নোবেল পেলেন তিন মার্কিন বিজ্ঞানী
২০১৭ সালে চিকিৎসায় নোবেল জিতেছেন ৩ মার্কিন বিজ্ঞানী
চিকিৎসাশাস্ত্রে অবদান রাখায় নোবেল পুরস্কার ২০১৭ পেয়েছেন মার্কিন তিন বিজ্ঞানী। তারা হলেন- জেফরি সি হল, মাইকেল রোশবাশ ও মাইকেল ডব্লিউ ইয়াং। সুইডেনের স্টকহোমে নোবেল পুরস্কার কমিটি যৌথভাবে এই তিন মার্কিন নোবেল জয়ীর নাম ঘোষণা করে।
পুরস্কার হিসেবে তারা ৮০ লাখ সুইডিশ ক্রোনার (১১ লাখ মার্কিন ডলার) পাবেন। আর এর অর্থ তিন চিকিৎসককে ভাগ করে দেয়া হবে। বায়োলজিকাল ক্লকস নিয়ন্ত্রণে মলিকিউলার মেকানিজম আবিষ্কারের স্বীকৃতি স্বরূপ তারা এই পুরস্কার পেয়েছেন।
সুইডেনের কালোনিসকা ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘তাদের আবিষ্কারের মাধ্যমে জানা যায় মানুষ, উদ্ভিদ ও প্রাণীরা কিভাবে জৈবিক ছন্দে অভ্যস্ত হয় এবং তার মাধ্যমে কিভাবে পৃথিবীর বিপ্লব ঘটেছে।’
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, আমরা জানি যে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীর অভ্যন্তরীণ একটি বায়োলজিক্যাল ক্লকস আছে। এই ক্লকস প্রাত্যহিক জীবনের নানা ছন্দের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সহায়তা করে।
কিন্তু এই ক্লকস আসলে কীভাবে কাজ করে। জেফরি সি হল, মাইকেল রোশবাশ এবং মাইকেল ডব্লিউ ইয়ং গবেষণার মাধ্যমে আমাদের বায়োলজিক্যাল ক্লকসের ভেতরে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছেন এবং এর অভ্যন্তরীণ কার্যকলাপ সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেন।
এর আগে ২০১৬ সালে চিকিৎসায় নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন জাপানি বিজ্ঞানী ইয়োশিনোরি ওসোমি।
১৯০১ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে ১০৮ বার। এর মধ্যে ১২ বার চিকিৎসার নোবেল পেয়েছেন নারীরা। এ ছাড়া মাত্র একজন করে বিজয়ী এই পুরস্কার জিতেছেন ৩৯ বার।
No comments:
Post a Comment