মাত্র ৪শ’ টাকায় খামার শুরু করে বছরে আয় ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা

টার্কি পালনে নতুন সম্ভাবনা

‘মাত্র ৪০০ টাকায় ১ দিন বয়সী এক জোড়া টার্কি দিয়ে নিজের খামার শুরু করি। বর্তমানে আমার খামারের পুঁজি ১০ লাখ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। টার্কি মুরগি পালনে এখন আমার বার্ষিক আয় ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা। পুরো পরিবার চলছে টার্কি খামারের ওপর ভিত্তি করেই।’ কথাগুলো বলছিলেন নরসিংদীর পলাশ উপজেলার পাইকসা গ্রামের বাসিন্দা মোঃ বাসেদ। আর টার্কি পালনে নিজের সাফল্যে এলাকায় তিনি পরিচিতি পেয়েছেন টার্কি বাসেদ নামে। একই রকম সফলতার মুখ দেখেছেন সাভারের শেরপুর এলাকার কর্ণপাড়া গ্রামের বাসিন্দা রাশেদুল হাসান মামুন। মাত্র ২ বছর আগে ২ লাখ টাকা দিয়ে টার্কি খামার গড়ে তুললেও বর্তমানে তার পুঁজি দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ।
জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘এর আগে পোশাক শিল্পে জড়িত ছিলাম। ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে করতে প্রোডাকশন ম্যানেজার হয়েছিলাম। তবে একই সময়ে টার্কি মুরগি পালনে এগিয়ে আসি। দেখলাম টার্কি পালনেই আমার লাভ হচ্ছে। তখন খামার গড়ে তুলি। খামারের কাজে এখন প্রতিমাসে ৩ লাখ টাকা ব্যবহার হচ্ছে। এতে প্রতিমাসে আয় হচ্ছে প্রায় ৭০ হাজার টাকা। মূলত এ আয়ের ওপর নির্ভর করেই চলছে আমার পরিবার।’

শুধু বাসেদ ও মামুনই নন, টার্কি মুরগি পালনে দেশে সফলতার মুখ দেখেছেন এমন অনেকেই। আর এ খাতটিতে বর্তমানে যুক্ত আছেন ছোট-বড় প্রায় আড়াই হাজার খামারি। ২০০ থেকে ৩০০ টার্কি পালন হচ্ছে এমন খামারের সংখ্যা প্রায় ১০০। একই সঙ্গে দেশে গড়ে উঠেছে টার্কির বাণিজ্যিক খামারও। সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, দেশে প্রতিনিয়তই বাড়ছে টার্কি খামারির সংখ্যা। তাদের মতে, দেশের ইতিবাচক আবহাওয়া ও টার্কি মুরগি পালনে খরচ কম হওয়ায় খাতটি হয়ে উঠতে পারে সম্ভাবনাময়। এমনকি পোল্ট্রি শিল্পে সূচনা হতে পারে নতুন এক দিগন্তের।

জানতে চাইলে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক ডাঃ মোঃ আইনুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, ‘মাংসের যোগানের ক্ষেত্রে টার্কি পালন দেশের জন্য খুবই ইতিবাচক। কারণ অল্প সময়ে এক একটি টার্কির ওজন হয় ৫ থেকে ৬ কেজি। আবার টার্কি পালনে খামারিদের আয়ও বেশি। এটি অবশ্যই একটি সম্ভাবনার দিক।’ তিনি বলেন, ‘তবে নতুন কিছু আসলে এর একটি চ্যালেঞ্জ থাকে। আমাদের সেই চ্যালেঞ্জ নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। টার্কি পালনের মাধ্যমে যাতে নতুন কোন রোগ-বালাই না ছড়ায়; সেটি নিয়েও কাজ চলছে পরীক্ষামূলকভাবে নরসিংদীতে টার্কি পালন সোসাইটি গড়ে তোলা হয়েছে। খামারিদের নানা ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।’

দেশে টার্কি নিয়ে গবেষণা করেছেন এমন একজন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পোল্ট্রি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সুবাস চন্দ্র দাস। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘দেশে পালনকৃত টার্কিগুলো হেরিটেড প্রজাতির। এদের রোগ-বালাই একেবারেই কম। থাকতে পারে প্রতিকূল পরিবেশেও। আবার টার্কি পালনে খরচ পোল্ট্রির তুলনায় অনেক কম। টার্কি মূলত তৃণভোজী প্রকৃতির। এরা শাক-সবজি ও ঘাস খায়। অর্থাৎ পোল্ট্রিতে বেশি খরচের খাবার প্রয়োজন পড়লেও টার্কি পালনে তা লাগছে না। একই সঙ্গে টার্কি পালনের মাধ্যমে আয়ও বেশি। ফলে দেশের পোল্ট্রি খাতে নতুন একটি সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘টার্কির মাংস সম্পর্কে দেশের ভোক্তাদের মধ্যে এখনও সচেতনতা তৈরি হয়নি। অথচ বহির্বিশে^ মাংস সরবরাহের ক্ষেত্রে বড় অংশটিই আসে টার্কি থেকে। এ ছাড়া টার্কির মাংসে চর্বি খুবই কম। টার্কির মাংসের জনপ্রিয়তা বাড়লে দেশে আরও বড় আকারে টার্কি শিল্পের প্রসার ঘটতে পারে।’

টার্কি
টার্কি এক ধরনের বড় আকারের পাখি বিশেষ। দেখতে মুরগির বাচ্চার মতো হলেও আকারে অনেক বড়। টার্কি বিশ্বের সর্বত্র গৃহপালিত পাখিরূপে পালিত হয়। পুরুষ টার্কি উপযুক্ত বয়সে ময়ূরের মতো পেখম মেলে। জানান দেয় নিজের উপস্থিতি। মেয়ে টার্কি ডিম দেয় অন্ধকারে। বাচ্চা ফুটে ওঠার মাত্র ছয় মাস বয়স থেকেই এরা ডিম দিতে থাকে। আর ছয় মাস বয়সী মেয়ে টার্কির ওজন হয় পাঁচ থেকে ছয় কেজি। পুরুষগুলো হয়ে থাকে প্রায় ৮ কেজি। টার্কির মাংসের স্বাদ অনেকটা খাসির মতো। মাংসে অধিক পরিমাণ প্রোটিন থাকলেও চর্বির পরিমাণ একেবারেই কম। উন্নত বিশ্বে টার্কির মাংস দিয়ে রোস্ট ও কাবাব করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসীরা সনাতনী ধারায় থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’র ছুটির দিনে টার্কি ভোজন করে থাকে। ইউরোপীয় দেশগুলোতেও খাবার হিসেবে টার্কির জনপ্রিয়তা বেশ। সুস্বাদু এই মুরগির রোগ-বালাই না থাকায় দেশেও এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে।

বাংলাদেশে টার্কি পালন
বাংলাদেশে টার্কি মুরগি পালনের শুরুটা খুব বেশি দিন আগের নয়। ধারণা করা হয়, ২০১৪ সালে নওগাঁর জিল্লুর রহমান দেশে সর্বপ্রথম টার্কি পালন শুরু করেন। তবে নরসিংদীর বাসেদের খামারের যাত্রা ২০০৯ সালে। সংশ্লিষ্টরা যাত্রা শুরুর তথ্যটা নিশ্চিত করতে না পারলেও অনেকের ধারণা টার্কি পালনের শুরুটা ৭ থেকে ৮ বছর আগে। তবে এরই মধ্যে টার্কি স্থান দখল করে নিয়েছে গৃহবধূর ঘরেও। পালন হচ্ছে কোন কোন অঞ্চলের বাড়িতেও। ছোট-বড় ফার্ম ছাড়াও বাণিজ্যিক খামারও গড়ে উঠেছে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ টার্কি বার্ডস ডেভেলপমেন্ট এ্যাসোসিয়েশনের (প্রস্তাবিত) সভাপতি মোঃ শাহীন হাওলাদার জনকণ্ঠকে বলেন, দেশে বর্তমানে ছোট-বড় আড়াই হাজার খামার রয়েছে। বড় খামার আছে প্রায় ১০০। আর প্রতিনিয়তই বাড়ছে খামারির সংখ্যা।

টা‌র্কি খামারিদের কথা
দেশের একজন সফল টার্কি খামারি নরসিংদীর টার্কি বাসেদ। শুরুর কথা জানিয়ে জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘৪০০ টাকায় মাত্র ১ দিন বয়সী এক জোড়া টার্কি দিয়ে খামার শুরু করি। সব মিলিয়ে এখন খামারের ৩ শেডে ৫০০ টার্কি রয়েছে। ১৫০টি টার্কি ডিম দিচ্ছে এখন। ৪ থেকে ৫ মাস বয়সী ১৫০টি। বাকিগুলোর বয়স চার মাসের নিচে। বর্তমানে আমার খামারের বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ লাখ। আর বার্ষিক আয় ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা।’ তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে খামারের আয় দিয়েই আমার পরিবার চলছে। ৪০০ টাকা দিয়ে শুরু করে বর্তমানে আমার এই অবস্থান। উদ্বুদ্ধ হয়ে এলাকায় অনেকেই এখন টার্কির খামার গড়ে তুলছে।’

প্রতিবন্ধকতা জানতে চাইলে বাসেদ বলেন, ‘ঠান্ডা জায়গায় শেড তৈরি করা হলে টার্কি পালনে তেমন কোন সমস্যা হয় না। টার্কিতে রোগ-বালাই খুবই কম। তারপরও শীতকালে কিছু কিছু রোগ হয়। তখন ঘরে পর্দা টাঙ্গিয়ে রাখলে তেমন কোন সমস্যা হয়না।’ জানালেন, ইনকিউবেটর দিয়ে ডিম ফুটালে ৭০-৭৫ শতাংশ ডিমেই বাচ্চা আসে। তার তথ্যমতে, বর্তমানে ডিমের হালি বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকায়। আর টার্কির ডিম দেখতে অনেকটা হাঁসের ডিমের মতোই।

মাত্র ৩ মাস ধরে টার্কি পালন শুরু করেছেন কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার কুরবানপুর গ্রামের বাসিন্দা মোঃ মীর কাশেম। এই অল্প সময়েই তিনি বুঝতে পেরেছেন টার্কি পালন বেশ লাভজনক। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, ৩ জোড়া টার্কি দিয়ে শুরু করলেও এখন আমার খামারে ২৭টি টার্কি আছে। বর্তমানে টার্কির বাচ্চা ১৫০০ টাকা জোড়ায় বিক্রি হচ্ছে। ১৩ হাজার টাকা দিয়ে শুরু করলেও বর্তমানে তার খামারে থাকা টার্কিগুলোর দাম প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি। কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলায় টার্কি খামার গড়ে তুলেছেন সাইফুল্লাহ মনসুর মুরাদও।
জনকণ্ঠকে তিনি জানান, অভিজ্ঞতা না থাকায় ৩০টি টার্কি দিয়ে শুরু করলেও বর্তমানে তার খামারে ১৬টি টার্কি রয়েছে। আর ২টি বাদে বাকিগুলো মারা গেছে। জানালেন, তার বন্ধু আল-আমিনও টার্কি খামারের সঙ্গে যুক্ত। মূলত বন্ধুর অনুপ্রেরণাতেই তিনি টার্কি পালনে এগিয়ে এসেছেন। এলাকায় টার্কির দাম প্রসঙ্গে তিনি জানান, বর্তমানে আমাদের এলাকায় টার্কির ডিম বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার টাকা হালিতে। ১ দিনের বাচ্চা ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায়। আর ডিম দেয়ার উপযোগী ১ জোড়া টার্কির দাম ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা। নিজে টার্কির মাংস খেয়েছেন জানিয়ে বললেন, এর স্বাদ খাসির মাংসের মতো। আর সাভারের টার্কি খামারি রাশেদুল হাসান মামুন বলেন, বর্তমানে টার্কির ডিমের হালি বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকায়। ৬ মাস বয়সী এক জোড়া টার্কির দাম সাড়ে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা।

সতর্কতা
টা‌র্কি পালনের সঙ্গে জড়িত একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খাতটিতে এগিয়ে আসতে চাইলে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে প্রথমে অবশ্যই টার্কি সম্পর্কে খুব ভাল করে জানতে হবে। আর টার্কি ক্রয়ের ক্ষেত্রে বেছে নিতে হবে বিশ^স্ত কোন খামার। কারণ অভিজ্ঞতা না থাকলে টার্কির বয়স কত হয়েছে, সত্যিকার অর্থেই কী এটি ডিম দেয়ার উপযুক্ত তা শনাক্ত করা সম্ভব হবেনা। এমনকি অনভিজ্ঞ ব্যক্তির দ্বারা নির্ধারণ করা সম্ভব হবে না টার্কিটি নারী না পুরুষ। ফলে প্রতারক চক্র কিংবা অনভিজ্ঞতার কারণে অনেককে পড়তে হয়েছে লোকসানে। এসব বিষয় অবলম্বন করে টার্কি পালনে সতর্কতার সঙ্গে এগিয়ে গেলে খুব সহজেই লাভবান হওয়া যাবে।

ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে খামারিদের উপস্থিতি
দেশের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠা টার্কি ফার্মের নাম দিয়ে অসংখ্য আইডি রয়েছে ফেসবুকে। এসব আইডিতে প্রচার চালানো হচ্ছে নিজের ফার্মের। সঙ্গে যুক্ত করে দেয়া হচ্ছে যোগাযোগের ঠিকানা। ফেসবুকে ‘আমরা টার্কি ফার্মারস’ নামে গ্রুপও রয়েছে। গ্রুপটিতে টার্কি পালনে খামারিদের নানা সমস্যা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। চাওয়া হচ্ছে পরামর্শ। আর অভিজ্ঞতালবদ্ধ খামারিরা পরামর্শ দিচ্ছেন। রয়েছে নিজের টার্কি বিক্রির বিজ্ঞাপনও। একইভাবে দেশে গড়ে ওঠা টার্কি ফার্মের বিভিন্ন ভিডিও ইউটিউবেও আপলোড করা হয়েছে। কোন কোন ফার্মের রয়েছে ওয়েবসাইটও।

সামগ্রিক প্রসঙ্গে টার্কি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. সুবাস চন্দ্র দাস জনকণ্ঠকে বলেন, খাতটিকে এগিয়ে নিতে সরকারকে আরও বেশি মনোযোগ দিতে হবে। টার্কি সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। বিশেষত টার্কির মাংস গ্রহণের ক্ষেত্রে। আর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বর্তমানে টার্কির দাম অনেক কমে এসেছে। এক দিনের প্রতি পিস বাচ্চা এখন ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর এক মাস বয়সী টার্কি এখন ৫০০ টাকা দিয়েও কেনা যায়। আর ডিম দেয়ার উপযুক্ত এক জোড়া টার্কির দাম পড়ছে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা। অতীতে অনেক দাম থাকলেও বর্তমানে দাম কমেছে। খামার বাড়লে আরও কমবে।

No comments:

Post a Comment