ধবধবে সাদা শাড়ি ও ওড়না পরে ৬৫ বছরের বাছিরন তার সমাপনী পরীক্ষার ফলাফল জানতে এসেছিলেন বিদ্যালয়ে। ফলাফলে দেখা গেল বিদ্যালয়ের সেরা তিনিই। হোগলবাড়ীয়া পূর্বপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৬ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে বাছিরন নেছা জিপিএ-৩ পেয়ে বিদ্যালয়ের সেরা হন। তার এই কৃতিত্বে সবাই মুগ্ধ। তাকে ঘিরে এলাকাবাসী ও স্কুল কর্তৃপক্ষের ব্যাপক উদ্দীপনা। মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার হোগলবাড়ীয়া গ্রামের মৃত রহিল উদ্দীনের স্ত্রী বাছিরন নেছা পিইসি পরীক্ষা দিয়ে দেশে আলোচিত হন।
গতকাল বেলা ১১টার আগেই বাছিরন ফলাফল নিতে বিদ্যালয়ে পৌঁছান। তার সঙ্গে ছিলেন ওই বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক ও এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। বাছিরন কী ফলাফল অর্জন করেন তা জানার জন্য কৌতূহলী মানুষ স্কুলের বারান্দায় ভিড় জমান।
বাছিরনের চোখেমুখে ছিল আত্মবিশ্বাসের ছটা। শেষ পর্যন্ত আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সহপাঠী সবাইকে পেছনে ফেলে বিদ্যালয় সেরা ফল তার নামেই। এই খুশিতে যেন আত্মহারা বৃদ্ধা বাছিরন নেছা। বিদ্যালয়ে উপস্থিত সকলের মাঝে মিষ্টি বিতরণ করা হয়। ‘ভি’ চিহ্ন প্রদর্শন করে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আনন্দ প্রকাশ করেন তিনি।
প্রতিক্রিয়ায় বাছিরন নেছা বলেন, ‘পাস করার মধ্যে যে এত মজা তা আগে বুঝিনি।’ এ ফলাফলে তিনি শিক্ষক, সহপাঠী ও পরিবারের সদস্যদের ধন্যবাদ জানান। যতদিন বেঁচে থাকবেন, ততদিন লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার আশা ব্যক্ত করেন বাছিরন।
বাছিরন নেছার বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আনার কলি জানান, দীর্ঘ ৫ বছর ধরে বাছিরনকে লেখাপড়া করাচ্ছি। তিনি যে এত ভাল ফলাফল করবেন তা জানা ছিল না। এই ফলাফলে গর্বিত তিনি। ফলাফল ঘোষণার সময় ওই বিদ্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন সংরক্ষিত মহিলা এমপি সেলিনা আখতার বানু। তিনি বলেন, ইচ্ছে শক্তির কাছে বয়স যে কোনো বাধা নয় তা আবারো প্রমাণ করলেন বাছিরন। তার এলাকার একজন বয়োবৃদ্ধ লেখাপড়া ও ভালো ফলাফল করায় তিনিও গর্বিত। বাছিরন দেশের মধ্যে এক অনন্য দৃষ্টান্ত বলেও মনে করেন সেলিনা আখতার বানু। এমপি আগামী ছয় মাসের মধ্যে বাছিরনের প্রাথমিক বিদ্যালয়টি পাকাকরণের সার্বিক ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাসও দেন।
এদিকে বাছিরনকে শুভেচ্ছা জানাতে তার বাড়িতে ছুটে যান গাংনী উপজেলা নির্বাহী অফিসার আরিফ-উজ-জামান ও মটমুড়া ইউপি চেয়ারম্যান সোহেল আহম্মেদ। পিইসি পরীক্ষা পরিদর্শন করে বাছিরনের লেখাপাড়ার সমস্ত ব্যয় বহনের ঘোষণা দিয়েছিলেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার।
জানা গেছে, মেহেরপুর জেলা শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে গাংনী উপজেলার হোগলবাড়িয়া গ্রামের মাঠপাড়ায় বাছিরনের বাড়ি। বাসিরন গ্রামের রহিল উদ্দিনের স্ত্রী। ৩৫ বছর আগে স্বামী মারা যান। বাছিরনের সংসারে এক ছেলে ও দুই মেয়ে। ছেলে মহির উদ্দিনের সঙ্গে থাকেন তিনি। নাতি-নাতনিরা কলেজে ও বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে। ২০১১ সালে বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে হোগলবাড়িয়া পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন প্রথম শ্রেণিতে। ২০১৬ প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নেন তিনি। বাছিরন জানান, অর্থসংকটের কারণে তার পড়াশোনা হয়নি। চেষ্টা করেছিলেন ছেলে মেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে। এর মধ্যেই মারা যান তার স্বামী। ফলে সন্তানদের লেখাপড়া করাতে পারেননি। পরে যখন নাতি-নাতনিরা লেখাপড়া শুরু করলো তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন নিজে লেখাপড়া করার।
গতকাল বাছিরন তার বয়োবৃদ্ধ ভাই আকবর আলী ও ছেলে মহিরুদ্দিনকে সঙ্গে করে বিদ্যালয়ে এসেছিলেন পরীক্ষার ফলাফল জানতে। প্রধান শিক্ষক হেলাল উদ্দিন বলেন, বাছিরন নেছা ২০১০ সালে স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য কয়েকবার এসেছিলেন। বয়স্ক মানুষ ভেবে সে বছর তাকে ভর্তি করানো হয়নি। পরে যখন তিনি আবার আসেন ২০১১ সালে তাকে ভর্তি করি। ভর্তি করার পর থেকে তার আগ্রহ দেখে অবাক হয়েছি। প্রতিদিন ক্লাস তিনি করেছেন। ক্লাসের সহপাঠীদের সঙ্গে তার শিশুদের মতোই আচরণ শিক্ষকদের মুগ্ধ করতো।
সহপাঠী মৌ জানায়, বাছিরন তার দাদির বয়সী হলেও তাকে বান্ধবীর মতো করে দেখতে হয়। লেখাপড়া নিয়ে কোনো সমস্যা মনে হলে একে অপরকে সহযোগিতা করেন। সে আরো বলে, বাছিরনকে স্যাররা পড়া ধরতে দেরি করলে মন খারাপ করে স্যারদের বলতেন আমার পড়া ধরেন।
মটমুড়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সোহেল আহমেদ বলেন, আমার ইউনিয়ন এলাকায় এ ধরনের বয়সের কেউ লেখাপড়া করতে চাইলে তাকে পরিষদের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।
গাংনী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আকবর আলী জানান, শিক্ষার কোনো বয়স নাই। এ বয়সের একজন পিএসসি পরীক্ষায় পাস করেছে। যা নিরক্ষরমুক্ত দেশ গড়তে সকলেই অনুপ্রাণিত হবে।
© মানবজমিন
No comments:
Post a Comment