ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যাংক ঋণের বিস্তা‌রিত

একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে শিল্প কারখানা পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যাংকিং ও ব্যাংক ব্যবস্থাপনা এবং ইন্সুরেন্সের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্যই হলো উদ্যোক্তা এবং ব্যবসায়ীদের ঋণ ও অর্থায়নের ব্যবস্থা করা। আমাদের দেশে একটি প্রচলিত ধ্যান-ধারণা বিদ্যমান রয়েছে যে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ উদ্যোক্তা এবং ব্যবসায়ীদের ঋণ প্রাপ্তিতে সহায়তার পরিবর্তে অহেতুক জটিলতার সৃষ্টি করে। বিষয়টি ঢালাওভাবে কিংবা একতরফাভাবে বলা সমিচীন নয়। উদ্যোক্তা হিসেবে শিল্প কারখানা পরিচালনার জন্য যেমন নিয়মনীতি অনুসরন করতে হয় তেমনি আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে পদ্ধতিগতভাবে নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। অনেক সময় উদ্যোক্তারা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাস্তব জ্ঞান এবং ব্যাংকের নিয়ম কানুন সম্পর্কে অজ্ঞতার কারনে অহেতুক অসুবিধার
সম্মুখীন হয়।

সম্প্রতি দেশের অনেক সরকারি এবং বেসরকারি ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান শিল্পোদ্যোক্তা বিশেষ করে এসএমই উদ্যোক্তাদের ঋণ ও অর্থায়নের সুবিধা প্রদানের জন্য এসএমই ব্যাংকিং ব্যাবস্থা চালু করেছে। অনেক ব্যাংক নারী উদ্যোক্তাদের জন্য পৃথক সেল/ ইউনিট প্রতিষ্ঠা করেছে।

ঋণদাতা ব্যাংক (Bank):
বাংলাদেশের বর্তমান অর্থবাজারে এসএমই খাতে অর্থায়নে যে সমস্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এসএমই ব্যাংকিং শুরু করেছে তাদের তালিকা নিম্নরূপঃ
(১) ব্র্যাক ব্যাংক (২) বেসিক ব্যাংক (৩) ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড (৪) ঢাকা ব্যাংক লিমিটেড (৫) প্রাইম ব্যাংক লিঃ (৬) এবি ব্যাংক (৭) মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক (৮) প্রিমিয়ার ব্যাংক (৯) ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (১০) সিটি ব্যাংক লিমিটেড (১১) মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিঃ (১২) স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংক (১৩) ট্রাষ্ট ব্যাংক লিঃ (১৪) ব্যাংক এশিয়া (১৫) ডাচ বাংলা ব্যাংক লিঃ (১৬) সোনালী ব্যাংক লিঃ (১৭) জনতা ব্যাংক লিঃ (১৮) অগ্রনী ব্যাংক লিঃ (১৯) পূবালী ব্যাংক লিঃ (২০) বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক প্রভৃতি।

ব্যাংক একাউন্ট খোলা (Opening Bank Account):
ব্যাংক একাউন্ট খোলার জন্য আপনার পছন্দ মতো ব্যাংক হতে ফরম সংগ্রহ করতে হবে। ব্যাংক একাউন্ট খোলার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ আবেদন জমা দিতে হবে। বিভিন্ন ব্যাংকে এই কাগজপত্রের চাহিদা ভিন্ন রকমের হয়। এছাড়া নিয়মের কিছু কিছু ক্ষেত্রেও ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়।

ব্যাংক একাউন্ট খুল‌তে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র:
১. ব্যাংক কর্তৃক সরবরাহকৃত ফরমে ব্যাংক একাউন্ট করার দরখাস্ত ।
২. দুই কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি।
৩. হালনাগাদ ট্রেড লাইসেন্স এর সত্যায়িত কপি।
৪. লিমিটেড বা পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হলে বোর্ড অব ডাইরেক্টরস-এর রেজুলেশন কপি অর্থাৎ ব্যাংক একাউন্ট খোলার সিদ্ধান্তসহ- কে কে ব্যাংক একাউন্ট অপারেট করবেন তাদের নাম উল্লেখসহ গৃহীত সিদ্ধান্তের কপি।
৫. সার্টিফাইড Join Stock থেকে কার্যারম্ভের অনুমতিপত্র (Certificate of Incorporation)।
৬. মেম্বার বা সরকার কর্তৃক অনুমোদিত সমিতি হতে নেয়া সদস্য সার্টিফিকেট।
৭. ঐ ব্যাংকের অন্য কোন একাউন্ট হোল্ডার কর্তৃক আপনার ছবি ও আবেদন পত্রে স্বাক্ষর প্রয়োজন হবে এবং তাকে  সনাক্তকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

ঋণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রাথমিক পদক্ষেপ:
(ক) প্রতিটি ব্যাংকের উদ্যোক্তা/ ব্যবসায়ীদের ঋণ ও অর্থায়নের ক্ষেত্রে প্রকল্প দলিল তৈরীর ফরমেট রয়েছে। আপনি যে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিতে ইচ্ছুক সে ব্যাংকের ফরমেট অনুযায়ী প্রকল্প প্রস্তাব প্রস্তুত পূর্বক প্রয়োজনীয় কাগজ ও দলিল-পত্রাদি সমেত প্রকল্প ব্যাংকে দাখিল করতে হবে।
(খ) একটি উপযুক্ত প্রোজেক্ট প্রোফাইল প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে আপনি বিসিক, এসএমই ফাউন্ডেশন এবং কনসালটেন্সী ফার্মের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। এ ব্যাপারে এসএমই ফাউন্ডেশনের এডভাইজারী সার্ভিস সেন্টারে যোগাযোগ করলে বিস্তারিত তথ্য ও পরামর্শ পেতে পারেন।
(গ) যখন কোন ব্যবসায়ী যৌক্তিকভাবে মনে করেন ব্যবসায়ের উন্নতির জন্য তার ব্যাংক ঋণের প্রয়োজন তখন তিনি ব্যাংক ব্যবস্থাপকের বরাবরে প্রয়োজনীয় বিবরণ সম্বলিত দরখান্ত পেশ করবেন।

এতে নিম্নলিখিত কাগজপত্র সংযুক্ত করতে হবে
১. ব্যাংকের নিজস্ব ফরম সংগ্রহ করন এবং তা যথাযথভাবে পূরন।
২. হালনাগাদ ট্রেড লাইসেন্স এর ফটোকপি।
৩. ব্যবসায়ের টিন নম্বর।
৪. সম্পত্তির বর্তমান মূল্যের সনদপত্র (যেখানে শিল্পটি বিদ্যমান/ প্রতিষ্ঠা করা হবে)।
৫. সম্পত্তি বন্ধক নেয়া হলে তার বৈধ চুক্তিনামা (যেখানে প্রতিষ্ঠান রয়েছে বা প্রতিষ্ঠা করা হবে)।
৬. ব্যাংকের হিসাব নং এবং জামানত স্থিতি।
৭. পৌরসভার বাসিন্দা হলে কমিশনারের সনদ। স্থানীয় পর্যায়ের হলে চেয়ারম্যান অথবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সনদ।
৮. লিমিটেড কোম্পানি হলে মেমেরেন্ডাম এবং আর্টিক্যাল অব এসোসিয়েশনের কপি। অংশীদারী প্রতিষ্ঠান হলে অংশীদারী চুক্তিপত্রের সত্যায়িত কপি।
৯. প্রতিষ্ঠান চালু থাকা অবস্থায় ঋণ গ্রহনে ইচ্ছুক হলে ব্যবসার ১ বছরের লাভ ক্ষতির হিসাব বিবরনী।
১০. প্রতি ব্যাংকের ফর্মে উল্লেখযোগ্য একটি দিক রয়েছে যাকে লেটার অব গ্যারান্টি বলা হয়। এক্ষেত্রে আপনাকে দুইজন যোগ্য গ্যারান্টারের সনদ প্রদানের ব্যবস্থা রাখতে হয়।
১১. প্রতিষ্ঠান পরিচালনার পূর্বে কোন ব্যাংক থেকে ঋণ করে থাকলে তার হিসাবের একটি হালনাগাদ ও যথাযথ বিবরণ থাকতে হবে।
১২. এসএমই খাতে কতিপয় ব্যাংক কোলেটারেল ফ্রি (জামানতবিহীন) লোন চালু করেছে। এক্ষেত্রে আগ্রহী ক্ষুদ্র ও  মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তা এবং নারী উদ্যোক্তাদের জন্য অগ্রাধিকারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক একটি সার্কুলার জারী করেছে। এসএমই ফাউন্ডেশনের এডভাইজারী সার্ভিস সেন্টারে এ বিষয়ে তথ্য ও পরামর্শ প্রাপ্তির সুযোগ রয়েছে।
১৩. কিছু কিছু ব্যাংকে বর্ণিত বিষয়াদির বহির্ভূত দলিলপত্রাদি প্রয়োজন হতে পারে।
এক্যুইটি এন্ড অন্ট্র্যাপ্র্যানারশীপ ফান্ড (BBGd)
ঝুঁকিপূর্ণ কিন্তু সম্ভাবনাময় শিল্পের বিকাশের লক্ষ্যে সরকারি অর্থায়নে শিল্প উদ্যোক্তাদের নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগে উৎসাহিত করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় এক্যুইটি এন্ড অন্ট্র্যাপ্র্যান্যারশীপ ফান্ড ( ইইএফ) এর কার্যক্রম পরিচালিত হয়। সম্প্রতি কৃষিভিত্তিক ও খ্যদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রকল্পে ইইএফ সহায়তা প্রদান করা হয়। এ সমস্ত প্রকল্পের অগ্রাধিকার খাতসমূহ উল্লেখ করা হলোঃ

১. কৃষিঃ (ক) হাইব্রীড বীজ উৎপাদন (ধান, ভূট্রা, সব্জী ও তরমুজ), (খ) বাণিজ্যিকভাবে টিস্যু কালচার প্রযুক্তির মাধ্যমে আলু বীজ উৎপাদন, (গ) বাণিজ্যিকভাবে ফুল, অর্কিড চাষ (রপ্তানি বাজারের জন্য), (ঘ) বাণিজ্যিকভাবে সরু/ সুগুন্ধ চাল (রপ্তানি বাজারের জন্য এবং প্রকৃত রপ্তানিকারক যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে), (ঙ) মাশরুম চাষ প্রকল্প।

২. মৎস্যঃ মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরন ভিত্তিক শিল্পঃ (ক) IQF Found স্থাপন (Individual Quick Freezing/Fish Processing),  (খ) মূল্য সংযোজিত মৎসজাত খাদ্য উৎপাদন ( Value Added Fish Product Development and Marketing), (গ) আধুনিক পদ্ধতিতে শুটকীমাছ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরন ও বাজারজাতকরন (Dehydrated Fish Plant ),
মৎস্য চাষ ও হ্যাচারীঃ (ক) বাণিজ্যিকভাবে high value  মাছের খামার ও হ্যাচারী স্থাপন।
খাদ্য উৎপাদনভিত্তিক শিল্পঃ মৎস ও পশুজাত গুনগত মানসম্পন্ন (Balance feed) খাদ্য উৎপাদনভিত্তিক শিল্প।

৩. পশুসম্পদঃ পশুজাত খাদ্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরন ভিত্তিক শিল্প স্থাপনঃ (ক) দুধ, ডিম প্রক্রিয়াজাতকরন প্ল্যান্ট, (খ) মাংস প্রক্রিয়াজাতকরন প্ল্যান্ট (আধুনিক কসাইখানাসহ)।
৪. স্বাস্থ্য রক্ষা ও ব্যবস্থাপনা ভিত্তিক শিল্প স্থাপনঃ গবাদি পশু/ হাঁস-মুরগীর রোগ নির্ণয়/ চিকিৎসার জন্য ল্যাবরেটরী ও হাসপাতাল স্থাপন।
পোল্ট্রি উৎপাদনভিত্তিক শিল্পঃ গ্রেট-গ্র্যান্ট প্যারেন্ট ও প্যারেন্ট স্টক খামার।

সুদঃ সুদ নেই। প্রকল্পের অর্জিত লাভ-লোকসান উদ্যোক্তার এবং ইইএফ এর মূলধনের আনুপাতিক অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে বন্টিত হবে।

প্রকল্প ব্যয়ঃ মোট প্রকল্প ব্যয় সর্বনিম্ন ৫০.০০ লক্ষ টাকা হতে সর্বোচ্চ ১০.০০ কোটি টাকা হতে পারে।

বিস্তারিত তথ্যের জন্যঃ
এক্যুইটি এন্ড অন্ট্র্যাপ্র্যান্যারশীপ ফান্ড ইউনিট
বাংলাদেশ ব্যাংক
প্রধান কার্যালয়, ঢাকা-১০০০
ফোনঃ ৭১২৬২৮০-৯৫, ৭১২৬১০১-২০
ওয়েবসাইটঃ Bangladesh-Bank

স্মল এন্টারপ্রাইজ ফান্ড
(ক) বিভিন্ন ব্যাংকে শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণ সহায়তার ব্যবস্থা থাকলেও ক্ষুদ্র শিল্প উদ্যোক্তাদের ঋণ পেতে বেশ প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। ক্ষুদ্র শিল্পকে উৎসাহিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি বিশেষ ফান্ডের ব্যবস্থা রয়েছে।  আলোচ্য তহবিলের আওতায় ক্ষুদ্র শিল্প উদ্যোক্তারা স্পল্প সুদে এবং অপেক্ষাকৃত সহজ শর্তে ঋণ প্রাপ্তির সুযোগ পায়। এটি এসইএফ ফান্ড নামে পরিচিত। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ ব্যাংক সরাসরি ক্ষুদ্র শিল্প উদ্যোক্তাদের এসইএফ ঋণ সহায়তা প্রদান করে না। নিম্নলিখিত ব্যাংক ও লিজিং কোম্পানি সমূহের মাধ্যমে বিভিন্ন খাতে ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠানকে সুনির্দিষ্টভাবে এ ঋণ প্রদান করা হয়ঃ
(১) ওয়ান ব্যাংক (২) ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড (৩) প্রাইম ব্যাংক লিঃ (৪) ঢাকা ব্যাংক (৫) এনসিসি ব্যাংক (৬) উত্তরা ব্যাংক (৭) মাইডাস  (৮) আইডিএলসি (৯) পিপলস্ লিজিং (১০) ইন্টারন্যাশনাল লিজিং (১১) প্রিমিয়ার লিজিং। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ঋণ সহায়তা লাভের জন্য উল্লেখিত ব্যাংক ও লিজিং কোম্পানিসমূহের সাথে যোগাযোগ করা যেতে পারে।

ইন্স্যুরেন্স (Insurance):
একটি শিল্প কারখানায় দুই ধরনের ইন্স্যুরেন্স পলিসি গ্রহণ করতে হয়। মূল কারখানা, বিল্ডিং, মেশিন, কাঁচামালের জন্য যে কোন মালিককে ফায়ার ও ফ্লাড (Fire and Flood ) পলিসি গ্রহণ করতে হয়। বিপদকালীন সময় এই Insurance Policy একটি শিল্প কারখানাকে রক্ষা করতে পারে। আর কারখানা চালু হওয়ার পর কাঁচামাল আমদানি ও রপ্তানির জন্য মেশিন পলিসি করতে হয়। আপনি পছন্দসই যে কোন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিকে বেছে নিতে পারে।
রেফারেন্সঃ ড. নূরুল কাদির ও অন্যান্য (২০০৯) এসএমই বিজনেস ম্যানুয়াল, ১ম এডিশন., ঢাকা: ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশন

No comments:

Post a Comment