ডায়বেটিস রোগীদের ভালো থাকার উপায়

ডায়বেটিস বা বহুমূত্র আজকের যুগের অন্যতম মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে উঠেছে। এ রোগের সাথে খাদ্যের গভীর সর্ম্পক আছে সে কথাও সবাই জানেন। তাই এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের কি ধরণের খাদ্য গ্রহণ করা উচিত সে ব্যাপারে আলোচনা করেছেন ঢাকায় অবস্থিত বাংলাদেশ ডায়বেটিক হাসপাতালের সিনিয়র পুষ্টিবিদ খালেদা খাতুন। আলোচনাটি পরিবেশন করা হলোঃ


ডায়বেটিস রোগের প্রকোপ বর্তমান কালে বেড়েছে। কেউ কেউ মনে করেন আংশকাজনক ভাবেই বেড়েছে। শহর কেন্দ্রিক মানুষের তুলনামূলক অলস জীবন যাপন আর এর সাথে অতিরিক্তি কথিত 'সুখাদ্য' এই রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি করেছে। ডায়বেটিস হলে দেহে পরিমাণমতো ইনস্যুলিন তৈরি হয় না বা তার ঘাটতি দেখা দেয়। এ কারণে দেহ চিনি জাতীয় খাদ্যকে ভেংগে আর হজম করতে পারে না। রক্তে চিনির মাত্রা নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে বেড়ে যায়। বহুমুত্রের পথ ধরে রোগীর দেহে হৃৎরোগ, কিডনি রোগসহ নানা জটিল রোগ দেহে বাসা বাধতে পারে। এ কারণে ডায়বেটিসকে রোগের জননী বলা হয়। 

খাদ্য নিয়ন্ত্রনঃ ডায়বেটিসকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে, প্রথমেই খাদ্য নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অর্থাৎ চিনি জাতীয় খাদ্য বর্জন করতে হবে। শর্করা জাতীয় খাবার গ্রহণে সতর্ক হতে হবে। অতিরিক্ত তেল চর্বি জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। একই সাথে অতিরিক্ত ভাজা-c খাওয়া যথাসাধ্য বন্ধ রাখতে হবে। 

ব্যায়ামঃ নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। প্রয়োজনে সুনির্দিষ্ট ওষুধ গ্রহণ করতে হবে। তবে সাধারণভাবে চিকিৎসকরা মনে করেন, কেউ যদি খাদ্য গ্রহণে সতর্ক না হোন এবং নিয়মিত ব্যায়াম না করেন তবে তিনি যতই ওষুধ গ্রহণ করুন না কেন, তার রক্তের চিনির মাত্রা হ্রাস পাবে না, বহুমুত্র নিয়ন্ত্রিত হবে না। একই সাথে ডায়বেটিসের পথ ধরে অন্যান্য রোগের আক্রমণের আশংকা কমবে না। 

খাদ্যাভ্যাসঃ একজন সাধারণ মানুষ যে পরিমাণ শর্করা জাতীয় খাদ্য অর্থাৎ ভাত বা রুটি খান; ডায়বেটিসের রোগী মোটেও সে পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করতে পারবেন না। তার যে পরিমাণa ক্যালোরির প্রয়োজন পড়ে তার মধ্যে ষাট থেকে সত্তর শতাংশ শর্করা খাদ্য হওয়া উচিত। এরপর বাকি ২০ থেকে ২৫ শতাংশ প্রোটিন বা আমিষ এবং ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ফ্যাট বা স্নেহ জাতীয় খাবার থেকে অর্জন করা উচিত। বাংলাদেশের মত দেশগুলোতে অনেকের জন্য খাদ্যের যোগাড় করাই মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। খাদ্য সমস্যার কথা মনে হলেই এ দেশে আমিষ বা প্রোটিন ঘাটতির কথাই বেশি আসে। তাই এ সব দেশের আমিষ সমস্যার কথা মনে রেখেই রোগীর খাদ্যের আমিষের কথাটি বলা হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে একটি মাপকাঠিও পাওয়া গেছে। সাধারণ ভাবে পূর্ণ বয়সী মানুষের দেহের ওজন যতো কিলোগ্রাম হবে তত গ্রাম আমিষ তাকে খেতে দিতে দিতে হবে। অর্থাৎ কারো ওজন যদি ৭৫ কিলোগ্রাম হয় তবে তাকে ৭৫ গ্রাম আমিষ গ্রহণ করতে হবে।
তবে শিশুদের বেলায় এই পরিমাণ একটু বাড়বে। অর্থাৎ তাকে প্রতি কিলো ওজনের জন্য ১ দশমিক ২ গ্রাম আমিষ সরবরাহ করতে হবে। অর্থাৎ কোনো শিশুর ওজন যদি ১৮ কিলোগ্রাম হয় তবে তাকে ২১ গ্রাম আমিষ গ্রহণ করতে হবে।
তবে গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে এ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটবে। যে সব মায়ের ডায়বেটিস আছে তারা পরিপূর্ণ ভাবে তা নিয়ন্ত্রণ না করে তাদের গর্ভ ধারণ করা মোটেও উচিত হবে না। গর্ভে সন্তান থাকাকালীন অবস্থায় এ ধরণের মায়ের খাদ্য তালিকায় চিনি জাতীয় খাবার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এ ছাড়া আর কিছু খাবার নিয়ন্ত্রণ করার কোনো দরকার নেই। অন্যদিকে সন্তান গর্ভে থাকার কারণে অনেকের মধ্যে বহুমুত্রের উপসর্গ দেখা দেয়। এ ক্ষেত্রে সাধারণ ভাবে সামান্য সতর্কতা ছাড়া বিশেষ কোনো নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন পড়ে না। 

খাবা‌রের সময়সূ‌চির গুরুত্বঃ
ডায়বেটিস রোগীর খাবারের সময় সূচি রক্ষা করা একান্তভাবে প্রয়োজনীয়। এ ধরণের রোগীদের প্রতি ৩ থেকে সাড়ে ৩ ঘন্টা অন্তর অন্তর তাকে খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। খাদ্যের এই সময় সূচি সঠিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে তার পরিণাম ভাল হবে না। ডায়বেটিস রোগী চিকিৎসা এবং আনুষাঙ্গিক নিয়ম মানার ফলে যে সুফল অর্জন করতে পারবেন কেবল মাত্র খাদ্যের নিয়ম না মানার কারণে তা ভেস্তে যেতে পারে। এ্ই নিয়ম না মানার কারণে ডায়বেটিসের রোগীর রক্তে চিনির পরিমাণ অতি মাত্রায় কমে যেতে পারে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে হাইপো গ্লাইসিমিয়া বলা হয়। অথবা খাদ্য গ্রহণের পর রক্তে চিনির পরিমাণ অতি মাত্রায় বৃদ্ধি পেতে পারে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এ অবস্থাকে হাইপার গ্লাইসিমিয়া বলা হয়। তাই যদি তিন থেকে সাড়ে তিন ঘন্টা পর পর যদি খাবার গ্রহণ করা হয় তবে রক্তে চিনির এই মাত্রা ওঠা-নামা করার সুযোগ পায় না। 

ভেষজ চি‌কিৎসাঃ
এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজনীয় মনে করছি, তা হলো বিশ্বের অনেক উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশেও ভেষজ চিকিৎসার প্রতি অনেকের গভীর বিশ্বাস রয়েছে। গাছ-গাছড়ায় রোগ সারিয়ে তোলার মতো উপকরণ বা উপাদান রয়েছে একথা সবাই স্বীকার করবেন। তবে ভেষজ চিকিৎসার জন্য যে সব গাছ-গাছড়ার নাম বলা হয় তাদের কার্যকারিতা, রোগ সারিয়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রা এবং দেহের উপর এসব ভেষজের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে সঠিক গবেষণা আজো হয়নি। কোনো ভেষজকে আধুনিক ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য এরকম বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করতে হবে। বাংলাদেশে অনেকেই বলেন, মেথি, করলা, রসুন, পেঁয়াজ, জামের বিচি থেকে শুরু করে নানা উদ্ভিদের বহুমুত্র সারিয়ে তোলার বা নিয়ন্ত্রণ করার মতো উপাদান আছে। এ কথা কতোটি সত্যি তা আজও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হয়নি। তাই চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুমোদিত ওষুধের বিকল্প হিসেবে এ ভেষজ উপাদান ব্যবহার করা ঠিক নয়। বরং তা অনেক ক্ষেত্রে রোগীর জন্য ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। 

প্র‌য়োজন খাদ্য ও জীবনাচারের প‌রিবর্তনঃ
মনে রাখতে হবে ডায়বেটিস কখনোই সারে না। এ রোগ সারাবার কোনো ওষুধ এখন পর্যন্ত কেউ উদ্ভাবন করতে পারেন নি। তবে ডায়বেটিস রোগকে নিয়ন্ত্রণে রেখে দীর্ঘদিন মান সম্পন্ন জীবন যাপন করা সম্ভব। আজকের দিনে ডায়বেটিসের যে চিকিৎসা হয় তা রোগ নিরাময় বা রোগ সারিয়ে তোলা জন্য নয়। রোগী যেনো সুস্থ সক্রিয় জীবনযাপন করতে পারেন তার জন্যেই এই চিকিৎসা করা হয়। এই চিকিৎসার ক্ষেত্রে খাদ্য এবং জীবন আচারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাই ডায়বেটিসের রোগীকে সুস্থ জীবন যাপন করতে হলে নিয়ম মেনে খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। আজকের যুগের অনেক চিকিৎসকই বলেন, নিয়ম মেনে খাবেন এবং দৈনিক ব্যায়াম করবেন তা হলেই ডায়বেটিসের রোগী ভালো থাকবেন।
© রেডিও তেহরান

No comments:

Post a Comment