কিডনি নষ্ট হয়ে যায় কেন? কিডনি প্রতিস্থাপন ও কিডনি দান প্রসঙ্গ

আজ‌কের আ‌লোচনার বিষয়বস্তুু-
১। কিডনি নষ্ট হয়ে যায় কেন?
২। কিডনি প্রতিস্থাপন কারা করতে পারবেন?
৩। কিডনি দান কি ঝুঁকিপূর্ণ?

কিডনি নষ্ট হয়ে যায় কেন?
বিভিন্ন কারণে কিডনি বিকল হতে পারে। এনটিভির নিয়মিত আয়োজন ‘স্বাস্থ্য প্রতিদিন’ অনুষ্ঠানের ২৪৯০তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন অধ্যাপক জামানুল ইসলাম ভূঁইয়া। বর্তমানে তিনি গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজের ইউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।

প্রশ্ন : কিডনি সংযোজন অত্যন্ত জটিল ও আধুনিক একটি চিকিৎসা পদ্ধতি। এটি বাংলাদেশে হচ্ছে। একজন মানুষের কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট (প্রতিস্থাপন) প্রয়োজন হয় সাধারণত তার কিডনি বিকল হয়ে গেলে। কিডনি বিকল হয় কেন?
উত্তর : কিডনি বিকল একটি অত্যন্ত গুরুতর এবং এর জন্য অনেক ব্যয়বহুল চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। এর কারণের মধ্যে সংক্রমণ একটি কারণ। যেমন আমরা বলি গ্লুম্যারো নেফ্রাইটিস। এ ছাড়া পাইলোনেফ্রাইটিস, ডায়াবেটিস ম্যালাইটাস, ডায়াবেটিস যার বেশি থাকে, উচ্চ রক্তচাপ যার বেশি থাকে, যাকে আমরা বলি হাইপার টেনশন। এরপর অন্যান্য আরো কিছু অসুখ আছে, যেমন পাথর অথবা টিউমার দিয়ে রাস্তাগুলো বন্ধ করে দেয়, বের না হয়। যাকে আমরা প্রচলিত একটি শব্দ ব্যবহার করে বলি—অবসট্রাকটিভ ইউরোপ্যাথি। এ ধরনের অসুখগুলো হলে কিডনি বিকল হওয়ার আশঙ্কা বেশি।

প্রশ্ন : আমরা জানি কিডনি বিকল হয়ে যাওয়াটা শুরুতে অনেক সময় ধরা পড়ে না। এটা যখন ধরা পড়ে তখন অনেকখানি ক্ষতি হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে কিডনির চিকিৎসা করে কি আগের পর্যায়ে ফিরিয়ে আনা সম্ভব?
উত্তর : কিডনি যদি বিকল হয়, যদি অবসট্রাকটিভ ইউরোপ্যাথি হয়, তখন আমরা যদি বাধা দূর করে দিই এটি আগের পর্যায়ে ফিরে আসে। তবে এটা নির্ভর করবে কতদিন এই অবসট্রাকটেড অবস্থায় ছিল।
আমি রোগীদের একটি সহজ উদাহরণ দিই। একজন মানুষকে যদি আপনি একটি আঘাত করেন, সামান্য থাপ্পড় দিলেন, সে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সুস্থ থাকবে। কিন্তু একজন মানুষকে যদি আপনি অজ্ঞান করে ফেলেন, আর যদি মেরে ফেলেন তাহলে আর জীবনেও সুস্থ হবে না। কিডনির বেলায়ও তাই। কিডনির অসুখগুলো কতদিন থেকে ভোগাচ্ছে, সেটার ওপর নির্ভর করবে কতটা সে পূরণ করতে পারবে।
তাই সবাইকে একটি কথা বলব। যেহেতু এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যায়, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা যায়, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা যায়, আপনারা অবশ্যই এগুলোর চিকিৎসা করবেন। যাতে ওনাদের গুরুতর পরিণতির দিকে যেতে না হয়।

প্রশ্ন : যদি গুরুতর পরিণতির দিকে দুর্ভাগ্যবশত যায়, তার দুটো কিডনিই হয়তো বিকল, সে ক্ষেত্রে তার চিকিৎসার কী আছে? একটি তো আমরা জানি ট্রান্সপ্ল্যান্ট। তবে এর বিকল্প কী রয়েছে?
উত্তর : যখন নাকি কিডনি সম্পূর্ণ বিকল হয়ে যায়, তখন তো অন্য কথা। মনে করেন যদি খানিক বিকল হয়, তখন এর মেডিকেল চিকিৎসা আছে, আমরা রাখি। মেডিকেল চিকিৎসায় অনেকদিন ভালো থাকা যায়। যখন সম্পূর্ণ বিকল হয়ে যায় তখনই হয় ডায়ালাইসিস করি, অথবা কিডনি সংযোজন করি। ডায়ালাইসিস বিভিন্ন রকম আছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরামর্শ দিই, হেমোডায়ালাইসিস—রক্ত দিয়ে যে ডায়ালাইসিস করা হয়। এ ছাড়া প্যারিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস আছে। অথবা কন্টিনুয়াস এমবিলুটারি প্যারিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস আছে। এখানে সে বাড়িতে বসে বসে ডায়ালাইসিস করতে পারে। রোগী নিজে নিজেই করে, তাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে দেওয়া হয়। পেটে একটি নল বসিয়ে দেওয়া হয়। এটা দিয়ে তাকে শিখিয়ে দেওয়া হয় এবং সে বাড়িতে করতে পারে। এগুলো হলো তার চিকিৎসা।

প্রশ্ন : কিডনি বিকল হলে, একজন রোগীর হাতে মাত্র দুটো পথ রয়েছে। ডায়ালাইসিস অথবা কিডনির ট্রান্সপ্ল্যান্ট। সেই ক্ষেত্রে একজন রোগীকে কী পরামর্শ দেবেন? তিনি কি ডায়ালাইসিস করবেন, না কি তার ট্রান্সপ্ল্যান্টে যাওয়াই উচিত। ট্রান্সপ্ল্যান্ট করতে চাইলেই কি সবাই করতে পারবে?
উত্তর : এ দুটো বিষয়ের মধ্যে ট্রান্সপ্ল্যান্ট করতে পারলে ভালো। কারণ এতে তার জীবনের যে গতিধারা সেটি কম ব্যাহত হয়। মনে করেন ডায়ালাইসিস করতে গেলে, তাকে সপ্তাহে তিনদিন হাসপাতালে যেতে হবে। গিয়ে ডায়ালাইসিস করতে হবে। ঘণ্টা চার-পাঁচ হাসপাতালে থাকতে হবে। তবে একবার যখন সংযোজন করে ফেলে কিডনি, তখন শুধু তার ওষুধ খেতে হয়। প্রথম দিকে একটু বেশি। এরপর ছয় মাস গেলে অনেক কমে যায় এবং জীবনটা অনেক স্বাভাবিক হয়। স্বাভাবিক কাজকর্ম সহজে করতে পারে। তার জীবনযাপন প্রায় আগের মতো হয়ে যায়।

কিডনি প্রতিস্থাপন কারা করতে পারবেন?
কিডনি বিকল হয়ে গেলে অনেক সময় ট্রান্সপ্ল্যান্ট বা প্রতিস্থাপন করতে হয়। তবে কারা সেটি করতে পারবেন—এ বিষয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন ‘স্বাস্থ্য প্রতিদিন’ অনুষ্ঠানের ২৪৯০তম পর্বে কথা বলেছেন অধ্যাপক জামানুল ইসলাম ভূঁইয়া। বর্তমানে তিনি গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজের ইউরোলজি বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।

প্রশ্ন : কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট কি সবাই করতে পারবেন?
উত্তর : এ ক্ষেত্রে বয়সের বিষয় রয়েছে। কিডনি যে দান করবে তার বিষয়ে বয়সের কিছু বিষয় আছে। ৬০ বছরের ওপরে গেলে আমরা সাধারণত ডায়ালাইসিসটাই পছন্দ করি। এর মধ্যে থাকলে ট্রান্সপ্ল্যান্টটা পছন্দ করি। আবার কিছু বিষয় রয়েছে ধরেন একজন রোগীর যদি ক্যানসার থাকে, সে ক্ষেত্রে আমরা তখনই ট্রান্সপ্ল্যান্ট করব না। তার ক্যানসারের চিকিৎসা করে এক বছর দেখব রোগী ভালো হচ্ছে কি না। তখন যদি হয়, আবার আমরা ট্রান্সপ্ল্যান্ট করি।

প্রশ্ন : কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টের বিষয়ে অন্য একজন মানুষের কিডনি এনে সংযোজন করতে হয়। সাধারণত ওই কিডনির বেলায় মিলবে কি না এই বিষয়টি থাকে বা দাতা পাওয়া যায় না। এ বিষয়ে যদি একটু বলেন।
উত্তর : দাতাদের বেলায় আমি সর্বপ্রথম দর্শক-স্রোতাদের একটি কথাই বলব, প্রথম একটি সহজ পরীক্ষা করে নেবেন সেটি হলো রক্তের গ্রুপ। সাধারণত যেটা করা হয় রক্তের গ্রুপ না মিললেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা সেটা করি। সেটা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তবে সাধারণত আমাদের এখানে যেটা মেনে চলা হয় একই গ্রুপের রক্ত হতে হবে।
আরেকটি যেটা মানতে হবে, আমাদের দেশে একটি আইন আছে, এটি হলো জিনগতভাবে সম্পর্কিত হতে হয়। যেমন বাবা মা, ছেলে মেয়ে, ভাই, বোন এরা দিতে পারে। আর সেকেন্ড ডিগ্রির মধ্যে আসে চাচা মামা খালা ফুফু। মানে আমি যে কথাগুলো বললাম চাচা দিতে পারবে। তবে চাচি দিতে পারবে না। কারণ চাচা জিনগতভাবে সম্পর্কিত। চাচি নয়। তেমনি খালা দিতে পারবে। তবে খালু দিতে পারবে না।
আর সম্পর্কিত যেটি নয়, যেটা আমাদের দেশে করা হয় সেটি হলো দম্পতি। স্বামী স্ত্রীকে দিতে পারবে। স্ত্রী স্বামীকে দিতে পারবে। তবে এই ক্ষেত্রে একটা বিষয় আমরা খুব খেয়াল করি, যে আপনার অসুস্থতাটা কি বিয়ের পরে হয়েছে, না কি আগে হয়েছে? কারণ এর সঙ্গে অনেক নৈতিকতা জড়িয়ে যায়। অনেক সময় দেখা গেল, একজন অসুস্থ হলো, এরপর একটি বিয়ের সার্টিফিকেট নিয়ে এলো। এনে বলল আমার স্বামী। এটা কিন্তু আমরা নেব না। তাকে অবশ্যই আগে থেকে বিবাহিত জীবন যাপন করতে হবে।

কিডনি দান কি ঝুঁকিপূর্ণ?
অনেকে কিডনি দান করে থাকেন। এই বিষয়টি কতটা নিরাপদ বা এতে ঝুঁকি আসলে কতখানি—এনটিভির নিয়মিত আয়োজন ‘স্বাস্থ্য প্রতিদিন’ অনুষ্ঠানের ২৪৯০তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন অধ্যাপক জামানুল ইসলাম ভূঁইয়া। বর্তমানে তিনি গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজের ইউরোলজি বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।

প্রশ্ন : যাঁরা কিডনি দেবেন তাঁদের মধ্যেও আতঙ্ক কাজ করে। যিনি কিডনি দেবেন তাঁর জন্য কি কিডনি দেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে?
উত্তর : আমরা যখন ট্রান্সপ্ল্যান্ট করি, যাকে কিডনি দেব (গ্রহীতা), তাঁর চেয়ে বেশি যত্নবান থাকি যিনি দেবেন তাঁর প্রতি। কারণ উনি একটি মহৎ কাজ করছেন। দান করছেন। হোক না ওনার আত্মীয়। তারপরও তো উনি কিডনিটা দিয়ে জীবন বাঁচাচ্ছেন। সে ক্ষেত্রে আমরা দাতার ব্যাপারে খুব যত্নবান থাকি। কেউ কিডনি দিলে আমরা তাঁর অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিই। তাঁর শরীরে যদি ন্যূনতম কোনো অসুবিধা থাকে, তাহলে তাঁর কিডনি আমরা নেব না। আমরা যখন দেখি, উনি সম্পূর্ণ নিরাপদ, তাঁর শরীরে কোনো ক্ষতি হবে না, তখনই আমরা তাঁর কিডনি নেব।
আরেকটি বিষয় বলব, জন্মগতভাবে আমাদের অনেকের একটি কিডনি। এটা নিয়েও তো আমরা ভালো আছি।

No comments:

Post a Comment