কেঁ‌চো সা‌র চা‌ষে সাফ‌ল্যের বিজয়গাঁথা

পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলা সদর থেকে চার কিলোমিটার দূরের গ্রাম ছোট শিংগা। গ্রামের ৯০ শতাংশ পরিবার কৃষিজীবী। সবজি ও রবিশস্য চাষে গ্রামটির সুখ্যাতি রয়েছে। একসময় এ গ্রামের কৃষকেরা জমিতে রাসায়নিক সার ব্যবহার করে ফসল ফলাতেন। এ সার ব্যবহারের পর ফসলের রোগবালাই বেড়ে যেত, উৎপাদন খরচও হতো বেশি। রাসায়নিক সার কম প্রয়োগে ফলন কম হয়। আবার অতিরিক্ত রাসায়নিক সার প্রয়োগের কারণে মাটির উর্বরতা শক্তি ও পানিধারণক্ষমতা কমে যায় এবং সবজির স্বাদ নষ্ট হয়। ফসলে রোগজীবাণুর আক্রমণ বেশি হয়। পাঁচ বছর আগে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে কেঁচো সার দিয়ে জমিতে ফসল ফলাতে শুরু করেন কয়েকজন কৃষক। কম খরচে কেঁচো সার ব্যবহার করে সবজি চাষে সাফল্য পান তাঁরা। তা দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে গ্রামজুড়ে শুরু হয় কেঁচো সারের উৎপাদন। এখন কয়েক শ কৃষক পরিবার নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে কেঁচো সার ও কেঁচো বিক্রি করে বাড়তি আয় করছে।

যেভাবে শুরু: ছোট শিংগা গ্রামের কৃষক বাবুল হালদার (৪৫) রাসায়নিক সারের বিড়ম্বনা থেকে পরিত্রাণ পেতে কেঁচো সার ব্যবহারে আগ্রহী হন। ২০১১ সালে তিনি স্থানীয় একটি বেসরকারি সংস্থা থেকে কেঁচো সার ও কুইক কম্পোস্ট সার তৈরির প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান কাজে লাগিয়ে বাবুল হালদার বাড়ির আঙিনায় দুটি রিংয়ে কেঁচো সার উৎপাদন শুরু করেন। কেঁচো সার তৈরির পদ্ধতি হলো একটি রিং বা চাড়ির মধ্যে দুই ভাগ গোবর এবং এক ভাগ কলাগাছের টুকরা বা সবজির উচ্ছিষ্টাংশ রেখে দিতে হবে। সাত-আট দিন পর এর মধ্যে হরিয়ানা প্রজাতির কেঁচো দিতে হবে। ওই জাতের কেঁচো প্রথমে স্থানীয় একটি এনজিও ভারত থেকে এনে সরবরাহ করেছিল। মূলত কেঁচোর মল থেকে সার তৈরি হয়। ওরই মধ্যে কেঁচো বংশ বৃদ্ধি করে। কোনো রিংয়ে আড়াই শ গ্রাম কেঁচো দিলে ১৫ দিনের মধ্যে এক কেজি কেঁচো তৈরি হয়। বাবুল ৫০ গ্রাম কেঁচো দিয়ে সার তৈরি শুরু করেন। ওই বছর তিনি দেড় বিঘা জমিতে ওই সার দিয়ে সবজি চাষ করেন। এতে আগের বছরের চেয়ে সবজির ভালো ফলন পান। সবজির উৎপাদন খরচ নেমে আসে অর্ধেকে। এ সাফল্য দেখে গ্রামের কয়েকজন কৃষক কেঁচো চাষ শুরু করেন। এরপর ছোট শিংগা গ্রামজুড়ে শুরু হয় কেঁচো সারে সবজি চাষ। এ বছর গ্রামের ২৫০ জন কৃষক বাড়িতে কেঁচো সার উৎপাদন করছেন।

ছোট শিংগা গ্রামের কৃষকদের কাছ থেকে কেঁচো কিনে নিয়ে পাশের ভেচকী, গুলিশাখালী, কবুতরখালী গ্রামে কেঁচো চাষ শুরু করেছেন আরও শতাধিক কৃষক।

বাবুল হালদার বলেন, ‘আমরা কয়েকজন মিলে বেসরকারি সংস্থা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে বিনা মূল্যে কেঁচো সারের প্রশিক্ষণ নিই। তারা বিনা মূল্যে কেঁচো ও সরঞ্জাম দেয়। তারপর শুরু করি কেঁচো চাষ।’

দিনবদল: ছোট শিংগা গ্রামের দরিদ্র কৃষক কেশব রায় একসময় রাসায়নিক সার কিনতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ২০১২ সাল থেকে কেশব রায় বাড়িতে দুটি সিমেন্টের রিংয়ে কেঁচো সার উৎপাদন শুরু করেন। বর্তমানে তিনি পাঁচটি রিংয়ে উৎপাদিত কেঁচো সার দুই বিঘা জমিতে ব্যবহার করার পর প্রতিবছর পাঁচ থেকে ৭ মণ কেঁচো সার এবং ১০ থেকে ১২ কেজি কেঁচো বিক্রি করছেন। কেঁচো সার ও কেঁচো বিক্রি করে তিনি বছরে ১৫ হাজার টাকা আয় করছেন। রাসায়নিক সারের বদলে নিজের তৈরি জৈব সার ব্যবহার করে সাশ্রয় হয়েছে ২০ হাজার টাকা। কেঁচো চাষ করে কেশব রায় এখন স্বাবলম্বী। তিনি বলেন, ‘কেঁচো মোগো ভাগ্য বদলাইছে। এ গ্রামকে মোরা রাসায়নিক সারমুক্ত করমু।’

সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম স্বামীর মৃত্যুর পর তিনটি ছোট সন্তান নিয়ে চোখে অন্ধকার দেখেন মহারানী হাওলাদার (৫০)। তিন বিঘা জমির ফসলে অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটত তাঁর। চার বছর আগে বাবুল হালদারের কাছ থেকে কেঁচো নিয়ে বাড়িতে শুরু করেন কেঁচো সার উৎপাদন। জমিতে কেঁচো সার ব্যবহারের পর কেঁচো এবং কেঁচো সার বিক্রি করে বছরে আয় করছেন ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। মহারানী হাওলাদার বলেন, ‘নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে সার ও কেঁচো বিক্রি করে বাড়তি আয় করছি।’

শিংগা গ্রামে একদিন: ছোট শিংগা গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, গ্রামের মাঠে মরিচ, মিষ্টিকুমড়ার খেতে কিষান-কিষানিরা কাজ করছেন। বসতবাড়ির আঙিনায়ও সবজি আবাদ করছেন অনেকে। কৃষক নিখিল মিস্ত্রি বলেন, একটি রিং বা চাড়ি থেকে ২৫-৩০ কেজি জৈব সার তৈরি হয়। কেঁচো পাওয়া যায় দুই থেকে পাঁচ কেজি। তিন-চার মাস পরপর সার ও কেঁচো সংগ্রহ করে বিক্রি করা হয়। প্রতি কেজি জৈব সার ১৫ থেকে ১৮ এবং কেঁচো প্রতি কেজি ৮০০ থেকে ১০০০ টাকায় বিক্রি হয়।

অন্যরা যা বলেন:  উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা নূর নাহার বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘লাভজনক হওয়ায় শিংগা গ্রামের মানুষ সবজি চাষে ব্যাপক আগ্রহ দেখাচ্ছেন। ইতিমধ্যে কৃষকেরা রাসায়নিক সার বর্জন করে জমিতে কেঁচো সার প্রয়োগের মাধ্যমে সবজি চাষে ভালো সাফল্য পেয়েছেন। আমরা কৃষকদের সবজি চাষে সহযোগিতা করছি।’

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মঠবাড়িয়া শাখার মাঠ সংগঠক অনিমেষ বালা বলেন, ‘রাসায়নিক সারমুক্ত সবজি চাষে আগ্রহী করতে কৃষকদের প্রথমে আমরা কেঁচো এবং কেঁচো সার উৎপাদনের সরঞ্জাম বিনা মূল্যে সরবরাহ করি। এরপর সার তৈরির ওপর প্রশিক্ষণ দিই। কেঁচো সারে সবজি চাষ করে কৃষকেরা লাভবান হওয়ায় এখন শুধু শিংগা গ্রামেই ২৫০টি পরিবার নিজেদের উৎপাদিত কেঁচো সার জমিতে ব্যবহার করছে। আশপাশের আরও শতাধিক কৃষক কেঁচো সার কিনে জমিতে ব্যবহার করছেন। এ ছাড়া গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রসহ কয়েকটি এনজিও এবং কৃষকেরা শিংগা গ্রাম থেকে কেঁচো কিনে কেঁচো সার উৎপাদন করছেন।’

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘জৈব সারকে মাটির প্রাণ বলা হয়। আদর্শ মাটিতে শতকরা ৫ ভাগ জৈব থাকা উচিত। আমাদের দেশের জমিতে ১ ভাগ আছে। জৈব সার মাটির মধ্যে বায়ু চলাচল বৃদ্ধি করে। পানির ধারণক্ষমতা বাড়ায়। মাটির প্রাণসঞ্চারে জৈব সার সহায়তা করে। ছোট শিংগা গ্রামের বেশির ভাগ কৃষক জমিতে জৈব সার ব্যবহার করেন। গ্রামের কয়েক শ কৃষক পরিবার কেঁচো চাষের মাধ্যমে জৈব সার উৎপাদন করে। এই কৃষকদের দেখে আশপাশের গ্রামগুলোতে কেঁচো চাষ ও জৈব সার উৎপাদন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আমরা কৃষকদের মাটিতে জৈব সার ব্যবহারে উৎসাহিত করছি।’

@Prothomalo

No comments:

Post a Comment