অচল শরী‌রে সফল ব্যবসা কাজলের

খুলনা নগরের মিয়াপাড়া পাইপের মোড়ে দাঁড়ালেই কানে ভেসে আসে একটি বিজ্ঞাপনের সুর। ওই সুরের উৎস ধরে কয়েক পা এগোলেই চোখে পড়ে দ্বিতল একটি বাড়ি ‘কাজল ভিলা’। ৬৯ নম্বর বাড়িটির মূল ফটকে লাগানো বেশ বড় দুটি সাউন্ডবক্স। ঘরে ঢোকার মুখেই বারান্দায় চাকা লাগানো একটি খাট। ওই খাটের সঙ্গে বিশেষ পদ্ধতিতে লাগানো একটি কম্পিউটার। খাটের ওপর বিভিন্ন বই ও কয়েকটি মুঠোফোন সেট। সেখানে শুয়ে থেকে বাঁ হাতে একটি স্টিলের দণ্ড নিয়ে কিবোর্ড চেপে ছবি সম্পাদনার কাজ করছিলেন মহিউল ইসলাম। সবাই তাঁকে কাজল নামেই চেনে। মানুষটা শারীরিক প্রতিবন্ধী।

মুঠোফোনে রিচার্জ ও কম্পিউটার ব্যবসার দোকান রয়েছে তাঁর। ঘরের বারান্দায় চাকা লাগানো এই খাটই তাঁর দোকান। ছবি ও ভিডিও সম্পাদনা, কম্পোজ, প্রিন্ট দেওয়া, মুঠোফোনে রিচার্জ, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা লেনদেন, অনলাইনে ভর্তির আবেদন, বিভিন্ন পরীক্ষার ফলাফল দেখানো, পাসপোর্ট ফরম পূরণসহ ইন্টারনেট ও কম্পিউটারের মাধ্যমে করা যায়, এমন যাবতীয় কাজ করেন তিনি।

কবিতাও লেখেন কাজল। ২০০৪ সালে খুলনা থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর কবিতার বই ছোট্ট এক পাখি। ২৪টি কবিতা আছে তাতে। তিন ভাই ও চার বোনের মধ্যে কাজল সবার ছোট। বয়স ৪৮। কাজলের বয়স যখন ৬ কি ৭ দিন, তখন তাঁর শরীরে হাম ওঠে। এরপরই হয়ে পড়েন প্রতিবন্ধী। আটকে যান চার দেয়ালের সীমানায়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ হয়নি। কিন্তু দমে যাননি তিনি। নিজের চেষ্টায় লেখাপড়া শেখেন।

২০০৩ সালে সমাজসেবা অধিদপ্তর ১০ হাজার টাকা ঋণ দেয় কাজলকে। ওই টাকা দিয়ে তিনি মুঠোফোন ও সিম কার্ড কিনে ব্যবসা শুরু করেন। পরে এক স্বজনের কাছ থেকে একটি ক্যামেরা উপহার পেয়ে ঘরে বসে ছবি তোলার কাজ শুরু করেন। ঘাঁটাঘাঁটি করে শিখে ফেলেন ফটোশপের কাজ। ২০১১ সালে মুঠোফোনে রিচার্জ ও ধীরে ধীরে ইন্টারনেট-সংক্রান্ত ব্যবসা শুরু করেন। প্রতিবন্ধী হয়েও এ পর্যন্ত ১০ জনকে কম্পিউটার শিখিয়েছেন তিনি। নিজ থেকে চলাফেরা করতে পারেন না। দুই হাত ও দুই পা-ই অচল। খাইয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে সব কাজে কাজলকে সহায়তা করেন তাঁর স্ত্রী শিরিন ইসলাম। খাটের সঙ্গেই কলবেলের সুইচ। কোনো কিছুর দরকার হলে সুইচ চেপে স্ত্রী বা মেয়েকে ডাকেন।

কাজল বলেন, ‘আমি জীবনকে হেরে যেতে দিতে চাইনি। প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি আর মনোবল নিয়ে কম্পিউটার শিখেছি। জীবিকার মাধ্যম হিসেবেও বেছে নিয়েছি তা। মনের জোর আমাকে এখনো হারতে দেয়নি। আমি আরও অনেক দূর যেতে চাই।’ খুলনা জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক শেখ আবদুল হামিদ বলেন, এই ধরনের উদ্যমী মানুষকে সহায়তা দিতে তাঁরা সব সময় তৈরি। কাজলের এলাকার সমাজসেবা কর্মকর্তার কাছ থেকে তথ্য পেলে তাঁকে সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হবে।

~প্রথম আ‌লো

No comments:

Post a Comment