কালেরকন্ঠ: নরসিংদী রেলস্টেশনের একটু বাইরে। ছোট্ট একটি চৌকি। সুন্দর গড়নের লম্বা এক তরুণ। জামা-কাপড় বিক্রি করছে। তরুণের চোখে আলো নেই। কিন্তু হেরে যায়নি। দেখে এসেছেন রায়হান রাশেদ
কাস্টমার দাম জিজ্ঞেস করলে মুস্তাফিজুর রহমান প্রথমে কাপড়ের শরীরে হাত বোলায়। সাইজ অনুমান করে। তারপর বলে দাম। দর মিললে পরে কাস্টমারের ব্যাগে পুরে দেয়। টাকা হাতে নিয়ে স্পর্শ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করে। কখনো কখনো টাকার প্রান্তে আঙুল দিয়ে খুঁটে দেখে। পুরো টাকা বুঝে নিয়ে পকেটে পোরে। মুস্তাফিজের চোখে আলো নেই, কিন্তু মুখের হাসি কখনো মিলায় না। মানুষ তাকে ভালোবাসে। সে-ও ভালোবাসে সবাইকে।
মুস্তাফিজের ছোটবেলা
অন্ধ হয়ে সে জন্মায়নি। বাংলার আকাশ-মাটি দেখতে পেয়েছিল সে। দেখেছিল মমতামাখা মায়ের মুখ। প্রত্যয়ী বাবার চেহারা। বড় আপুর বইতে মুক্তিযুদ্ধের ছবিও সে দেখেছে। কিন্তু টাইফয়েড হয়েছিল তার। তখন বয়স চার। মুস্তাফিজ দেখার শক্তি হারায়।
প্রথম ব্যবসা
অভাবের সংসার। একসময় তাকে কাজে লাগতেই হয়। তখন কিশোরবেলা। বাবার সঙ্গে মোবাইলে লোড দেওয়ার কাজ করতে লাগে। মোবাইলের বাটন টেপা শিখে নিয়েছিল মুস্তাফিজ। টাকা পাঠাতে ভুল করত না। মানুষ অবাক হয়ে দেখত অন্ধ ছেলেটিকে। এভাবে অনেক দিন ওই কাজে ছিল মুস্তাফিজ। তারপর বড় হলো। উপলব্ধি করল, রোজগার বাড়াতে হবে। অল্প টাকায় চলে না সংসার।
মানুষটা ভদ্রলোক
২০১৪ সাল। ঢাকা এসেছিল মুস্তাফিজ। ফেরার সময় বিমানবন্দর স্টেশন থেকে ট্রেন ধরবে বলে এগোচ্ছিল। কিন্তু ঠিক পেরে উঠছিল না। শেষে এক লোককে বলেছিল, ভাই, আমি চোখে দেখি না। আপনি কি আমাকে স্টেশনে পৌঁছে দেবেন? ভদ্রলোক সদয় হলেন। হাঁটতে হাঁটতে মুস্তাফিজ জানলেন, ভদ্রলোকের একটি প্যান্ট-গেঞ্জি তৈরির কারখানা আছে। ভদ্রলোকও জানতে পারলেন, মুস্তাফিজ অন্ধ হয়েও ভিক্ষা করে না। তিনি খুশি হলেন। নিজের ভিজিটিং কার্ড দিলেন মুস্তাফিজকে। বললেন, যদি মনে করো কোনো কাজে লাগব, তবে ফোন করো।
কার্ডটি জীবন বদলে দিল
ভিজিটিং কার্ডটি যত্ন করেই রেখে দিয়েছিল মুস্তাফিজ। একদিন সাহস করে ফোনও করে। বলে, আমাকে একটা ছোটখাটো চাকরি দেন। ভদ্রলোক বললেন, এখানে তুমি পারবে না। অন্য কিছু বলো। মুস্তাফিজ বলল, রিজেক্ট (বাতিল) কাপড়গুলো কী করেন?
ব্যবসায়ীরা নিয়ে যায়। কম মূল্যে ছেড়ে দিই।
আমাকে যদি দিতেন, তাহলে আমি বিক্রি করতাম।
ভদ্রলোক রাজি হলেন। ১০০ প্যান্ট বিনে পয়সায় দিয়ে দেন। শুধু বললেন, তুমি প্রথমে ব্যবসা শেখো। ভদ্রলোকের নাম আনিছুর রহমান।
ফেরি করে বেড়াত
প্রথম প্রথম কাপড় কাঁধে নিয়ে যেত বাজারে বাজারে। একেক দিন একেক বাজারে। এতে কষ্ট বেশি হতো। তারপর একটা ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ভ্যানে করে কাপড় বেচাকেনা করত। তারপর রেলস্টেশনের ধারে একটা বসার জায়গা জোগাড় করে। সেখানেই সকাল থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত কাপড় বিক্রি করে মুস্তাফিজ। প্রায় আড়াই বছর হতে চলল। নরসিংদীর বদলপুর গ্রামে তাঁর বাড়ি।
মুস্তাফিজের ভালো বউ
বাড়ির সব কাজ করে একাই। মেয়েটাকে স্কুল থেকেও নিয়ে আসে। কাপড়ে টুটাফাটা থাকলে সেগুলো সেলাইও করে। তারপর বিকেলে যায় স্বামীর দোকানে। মুস্তাফিজের বউ। নাম নাজমীন আক্তার। বউ পাশে থাকলে মুস্তাফিজের কোনো ভয় লাগে না। বলে, ‘বউটা আমার ভারি ভালো। ’ চোখেমুখে তখন খুশি খেলে যায় মুস্তাফিজের।
মুস্তাফিজ স্বপ্ন দেখে
স্বপ্ন আছে মুস্তাফিজের। আর দশটা বাবার মতোই। বলে, ‘বড় মেয়েটার মেধা তেমন ভালো নয়। তবে ছোট মেয়েটাকে আমি ডাক্তার বানাব। আমার স্বপ্ন, সে ডাক্তার হবে। ’ বউ-সন্তান নিয়ে দিব্যি চলছে মুস্তাফিজ। বলে, কারোর কাছে হাত পাততে হয় না, এটাই শুকরিয়া।
No comments:
Post a Comment