কেউ নম্র, আর কেউ উগ্র। কেউ আধ্যাত্মিক, কেউ আবার বাটপার। যাদুকরী, মাফিয়া -- ভারতে সব জাতের ধর্মগুরুর ছড়াছড়ি। গত ২০ বছরে অন্ধবিশ্বাসের এই রমরমা ব্যবসা মাশরুমের মতো বিস্তৃত হয়েছে ভারতজুড়ে। লাখ লাখ সহজ সরল মানুষের কাছে মিথ্যার বেসাতি বিক্রির কারবার এখন পুরোমাত্রার একটি ইন্ডাস্ট্রি হয়ে দাঁড়িয়েছে। গুরমিত রাম রহিম সিং নামে এমন এক ধর্মগুরুকে ধর্ষণের দায়ে কারাদণ্ড ও এর পরে সংঘটিত ব্যাপক সহিংসতা এই ইস্যুটি আবারও আলোচনায় নিয়ে এসেছে।
ভারতে এই স্বঘোষিত ‘গডম্যান’দের ধাপ্পাবাজি সবচেয়ে সূক্ষ্মভাবে ফুটিয়ে ধরা হয়েছিল আমির খান অভিনীত আলোচিত ছবি ‘পিকে’তে। সাধারণত, স্যাফ্রন রঙ্গের ঢিলেঢালা পোশাকে তাদের চেনা যায়। গলায় ঝুলানো থাকে মালা আর মুখে লম্বা দাড়ি। কিন্তু এসব ধর্মগুরুরা বসবাস করেন দুই জগতে। প্রকাশ্যে তারা থাকেন একরকম। আরেক জগৎ অন্ধকারে ভরা। যৌনতা সেখানে অবাধ, আর অর্থকড়ি অঢেল।
আশ্রমে ভক্তি নিয়ে নিজের সাধ্যমতো টাকাপয়সা ঢেলে যায় ভক্তরা। অর্থ আসে আরও অজানা উৎস থেকে। এই বিপুল অর্থের নেই কোনো জবাবদিহিতা। আরও ভয়াবহ ব্যাপার হলো, এই ধরণের ‘স্বামী’ আর ধর্মগুরুদের তোয়াজ করে চলতে হয় প্রায় সব রাজনৈতিক দলকে। উপায়ই বা আর কী? এই ধর্মগুরুদের অনুসারীর সংখ্যা এত বেশি থাকে যে তারাই অনেক নির্বাচনে পার্থক্য গড়ে দিতে পারেন।
গুরমিত রাম রহিমের বিরুদ্ধে শিখ ও হিন্দু ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের ব্যঙ্গ করার অভিযোগ উঠেছিল। পরে উঠে ধর্ষণ, খুন ও লিঙ্গচ্ছেদের অভিযোগও। শেষপর্যন্ত ২৫শে আগস্ট বিশেষ সিবিআই আদালত ধর্ষণের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে তাকে। এরপরই ব্যপক হারে দাঙ্গা শুরু হয়। অনেক শহরে রীতিমতো যুদ্ধাবস্থা দেখা দেয়। পুলিশের সঙ্গে তার অনুসারীদের সহিংসতায় ৩৮ জন নিহত হয়। আহত হয় ৩ শতাধিক মানুষ। ২৮শে আগস্ট তাকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
আরেক আধ্যাত্মিক গুরু স্বামী নিথিয়ানন্দের সঙ্গে এক তামিল অভিনেত্রীর ঘনিষ্ঠতার দৃশ্য ক্যামেরায়ও ধারণ করা হয়। অথচ, এই নিথিয়ানন্দ নিজেকে চিরকুমার বলে দাবি করে থাকেন। তারও আগে দুই নারীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ অবস্থার দৃশ্যও আলোচনার ঝড় তোলে ভারতে। এসব ছবি ও ভিডিওকে ভুয়া বললেও, নিথিয়ানন্দ নিজের প্রতিষ্ঠান থেকে পদত্যাগ করেন।
অনেক ধর্মগুরুর বিরুদ্ধেই বিভিন্ন পতিতা চক্র পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে। শিব মুরাত দ্বিবেদি ওরফে ইচ্ছাধারী বাবা নামে এক ধর্মগুরুকে সম্প্রতি নয়াদিল্লিতে গ্রেপ্তার করা হয়। নিজের আধ্যাত্মিকতার ছদ্মবেশ তো ছিলই, অর্থ, দামি উপহার ও গাড়ি দিয়ে তরুণীদের প্রলুব্ধ করে তাদেরকে বাধ্য করতেন পতিতাবৃত্তিতে। এসব থেকে তার আয় হতো কোটি কোটি টাকা। তদন্তকারীরা খুঁজে পান যে, দ্বিবেদী দক্ষিণ দিল্লির খানপুরে নিজের মন্দিরে গুহা বানিয়েছিলেন এই নির্বিঘেœ এই কারবার পরিচালনা করতে। বাদরপুরে সাঁই বাবার নামে ছোট একটি মন্দির বানিয়ে তার যাত্রা শুরু। পরবর্তীতে নিজের বানানো মন্দির প্রাঙ্গনেই তিনি দেহব্যবসা চালু করেন।
গুজরাটের ধর্মগুরু আশারাম বাপুর নাকি সম্মোহনী ক্ষমতা আছে। এই ক্ষমতার কারণে বিশ্বজুড়ে তার লাখো ভক্ত জুড়েছে। গুজরাট সরকার সম্প্রতি বিধানসভায় স্বীকার করেছে যে, আশারামের আশ্রম আহমেদাবাদে ৬৭ হাজার ৯৯ বর্গমিটার জমি দখল করেছে! বলে রাখা ভালো যে, আশারামের এমন ২২৫টি আশ্রম রয়েছে! বিশ্বজুড়ে রয়েছে ১৫০০ যোগ বেদান্ত সেবা সমিতি।
মুম্বইয়ের ধর্মঘুরু রাধা মা একটু ব্যতিক্রমী। কারণ, তিনি হলেন নারী ধর্মগুরু। জন্মের সময় নাম ছিল সুখভিন্দর কৌর নামে। পরমহাঁস ডেরায় যোগদানের পর নিজেকে একজন হিন্দু দেবী হিসেবে উপস্থাপন করতে থাকেন রাধা মা। নিজেকে এমনকি একবার দুর্গা দেবীর সাজেও সাজান। এ নিয়ে ফাগবারা নামে এক হিন্দু সংগঠন আপত্তি জানালে, তিনি ক্ষমা চান। ২০১৫ সালের জুলাইয়ে নিকি গুপ্ত নামে এক নারী রাধা মার বিরুদ্ধে শারিরীক নির্যাতনের অভিযোগ আনেন। বাইরে তার এক রূপ হলেও, ভেতরে আরেক। তার স্বল্পবসনা পোশাক পরা কিংবা অশ্লীল কার্যকলাপ করার ছবি ও ভিডিও একবার ছয়লাব হয়েছিল।
হরিয়ানার রামপাল সিং জতীন একসময় ছিলেন প্রকৌশলী। পরে আশ্রম খুলে হয়ে যান আধ্যাত্মিক গুরু। ধরতে গেলে তিনি নতুন ধর্মই বের করে বসেন। তার ধর্মে মন্দিরে যাওয়া, মূর্তিপূজা, যৌনতা, অশ্লীল গান ও নাচ নিষিদ্ধ। রামপালের মতে, সব বড় ধর্মীয় গ্রন্থেই জনৈক কবির পীরকে দেবতা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আর তিনি ওই কবিরেরই উত্তরসূরি। ২০০৬ সালে আর্য সমাজ নামে এক হিন্দু সংগঠনের সমালোচনা করেন। এরপরই তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়। কিন্তু তিনি ৪ বছরে ৪২ বার আদালতে হাজিরা দিতে ব্যর্থ হন। শুধুমাত্র ‘আইন শৃঙ্খলা রক্ষা’র স্বার্থে তাকে হাজিরা দেওয়া থেকে আদালত অব্যাহতি দেয়। কিন্তু ২০১৪ সালে তার বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। আর এরপরই আর্য সমাজ ও তার অনুসারীদের মধ্যে সহিংস সংঘাত সৃষ্টি হয়। আর্য সমাজের এক অনুসারীর মৃত্যু হলে রামপালের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ আনা হয়। পরে তিনি গ্রেপ্তার হন। মাসকয়েক পর বেরও হয়ে যান জেল থেকে। কিন্তু এরপর আবার আদালতে হাজিরা দেননি তিনি। ফের পরোয়ানা জারি হলে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে যায়, কিন্তু তার অনুসারীরা পুলিশকে ঠেকিয়ে দেয়। ২০১৪ সালের নভেম্বরে তাকে শেষমেশ আটক করা হয়। সঙ্গে আটক হয় তার ৪৮২ জন অনুসারী। হত্যা, হত্যাচেষ্টা, ষড়যন্ত্র, অবৈধ অস্ত্র বহন, আত্মহত্যা প্রবণ মানুষকে উস্কানো সহ বহু অভিযোগ আনা হয় তাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসব অভিযোগ থেকে আদালত তাকে খালাস দিয়ে দেয়! এমনই ক্ষমতা এই ধর্মগুরুদের।
আশারাম থেকে রাম রহিম কিংবা নিথিয়ানন্দ সবার বিরুদ্ধেই ধর্ষণ সহ বিভিন্ন গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। তাদের অনেক অনুসারীও বিস্তারিতভাবে বর্ণনা দিয়েছেন ধর্ষণ সহ অনেক অনৈতিক কাজের। কিন্তু খুব কমই বিচারের কাঠকড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে এই প্রচণ্ড প্রভাবশালী গুরুদেরকে।
সূফীবাদে বিশ্বাসী আরেক আধ্যাত্মিক গুরু অরবিন্দ গুরুজির ভাষ্য, ‘ধর্ম আর রাজনীতির মিশ্রণ অনেকটা মদের মতো। কিন্তু ধর্ম আর যৌনতার মিশেলটা আশ্চর্য্যজনক, বিশেষ করে বিশ্বাসীদের কাছে। এটা সত্য যে, আধ্যাত্মিকতা এখন অপবিত্র কাজকর্মের পবিত্র লেবাসে পরিণত হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী লাখো অনুসারী আছে এমন বহু গুরুর বিরুদ্ধে এখন ধর্ষণ, যৌন ব্যবসা আর অনৈতিক কাজকর্ম করার অভিযোগ উঠছে। কিন্তু সহজ সরল মানুষেরা এরপরও তাদের পায়ে মাথা ঠেকায়। আর পরে ওই গুরুর প্রতারণা ফাঁস হলে সবচেয়ে বড় ভয়টাই সত্য হয়ে ধরা দেয় এই অন্ধ ভক্তদের কাছে।’
মজার ব্যাপার হলো, অকাট্য প্রমাণ হাজির করা সত্ত্বেও অনেক ভক্তের মোহ কাটে না। নিথিয়ানন্দের এক ভক্ত যেমন তার সেক্স টেপ দেখার পরও তার সত্যতা মানতে রাজি হননি। নিজের গুরুর প্রতি এখনও অগাধ আস্থা তার। তার মতে, ওইসব সেক্স টেপের কোনো ভিত্তি নেই।
অতীব দারিদ্র্য, কুসংস্কার ও অশিক্ষা- সব মিলিয়ে ভারত যেন সব ধরণের ভণ্ড ধর্মগুরুদের চারণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। অনেকেই অবশ্য বলেন, সব ধর্মগুরুকেই কিছুমাত্রায় জবাবদিহিতার আওতায় আনা দরকার। ভুয়া ধর্মগুরুদের উত্থান রুখতে, আরেক আলোচিত ইয়োগা-গুরু বাবা রামদেব প্রস্তাব দিয়েছেন, ‘বাবা’ হতে গেলে কিছুনা কিছু যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে। তার বক্তব্য, ‘এসব গুরুদের প্রকাশ্যে প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীর মতো ক্ষমতাধর লোকেরা তোয়াজ করেন। এর ফলেই তারা ধনী হয়, আর নিজের ব্যক্তিগত সাম্রাজ্য গড়ে তোলে।’
অরভিন্দ গুরুজি বলছিলেন, ‘অর্থ এই ক্ষেত্রে মূল নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। এই গুরুরা তাদের ভক্তদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পেয়ে থাকেন। আর গুরুকে অর্থ দিতে পেরে অনুসারীরা মনের ভেতর এক ধরণের স্বস্তি ভোগ করে থাকেন। অন্য কথায় বলতে গেলে, এই গুরু আর তার অনুসারীরা একে অপরের পরিপূরক।’
No comments:
Post a Comment