আরবি ভাষায় ‘লাইলাতুন’ শব্দের অর্থ রাত বা রজনী এবং ‘কদর’ শব্দের অর্থ সম্মানিত, মহিমান্বিত। এই দুটি শব্দ মিলিয়ে লাইলাতুল কদর অর্থ অত্যন্ত সম্মানিত বা মহিমান্বিত রজনী।
‘লাইলাতুল কদর’ আরবি শব্দ। শবে কদর হলো লাইলাতুল কদরের ফারসি পরিভাষা।
মুসলিম উম্মাহর কাছে লাইলাতুল কদর অতিশয় মর্যাদাপূর্ণ একটি পবিত্র রজনী। পবিত্র কোরআনে এই রাতের গুরুত্ব তুলে ধরে সুরা কদর নামে একটি পূর্ণ সুরা নাজিল হয়েছে। তাতে এই মহিমান্বিত রাতকে হাজার মাসের চেয়েও উত্তম বলে ইরশাদ করা হয়েছে। এজন্য রাসূল সাঃ রমজানের শেষ দশ দিন মসজিদে ইতেকাফে থাকতেন এবং ইবাদতে গভীর মনোনিবেশ করতেন
কোরআন নাজিলের মাস মাহে রমজানের শেষ ১০ দিনের বিজোড় রাতগুলোর কোনো একটিই এই পুণ্যময় লাইলাতুল কদর। তবে ওলামায়ে কেরাম মনে করেন, রমজান মাসের ২৬তম দিনের শেষের রাতটিই লাইলাতুল কদর হওয়ার সম্ভাবনা সর্বাধিক। সেই হিসাবে এই রাতটিকেই লাইলাতুল কদর ধরে ধর্মপ্রাণ মুসলিম নর-নারীরা সারা রাত নফল নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, জিকির আসকারে মগ্ন থাকেন।
এই এক রাতে ইবাদতের বিনিময়ে হাজার মাসের ইবাদতের সওয়াবের চেয়েও বেশি সওয়াব পাওয়া যায়।
হাদিস শাস্ত্রে উল্লেখ রয়েছে, একদিন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই ভেবে অস্থির হচ্ছিলেন যে, আগের নবীর উম্মতেরা দীর্ঘ হায়াত পেত। ফলে তারা অনেক বেশি ইবাদত-বন্দেগির সুযোগ পেত। কিন্তু শেষ নবীর উম্মতের হায়াত খুবই সীমিত। অতএব তাদের পক্ষে উচ্চমর্যাদা লাভের সুযোগ কম।
তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে সূরা কদর নিয়ে উপস্থিত হন হজরত জিবরাইল (আ.)। আল্লাহ তায়ালা এ রাতেই কুরআন নাজিল করেছেন বলে জানিয়ে দিয়েছেন। তেমনি এ রাতটির মর্যাদা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম বলেও ঘোষণা করেছেন।
কিন্তু কদরের রাত কোনটি তা সুনির্দিষ্টভাবে বলে দেননি আল্লাহপাক। হাদিস শরিফেও নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি কোনটি কদরের রাত।
রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, তোমরা রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে কদরের রাত অনুসন্ধান করবে।
লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব ও ফজিলত
পবিত্র কুরআন ও সহিহ্ হাদিস দ্বারা লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ‘শবেবরাত’ নিয়ে হাদিস বিশেষজ্ঞ ও ফকিহদের মধ্যে যে সংশয় রয়েছে- লাইলাতুল কদরের ব্যাপারে তার কোনো অবকাশ নেই। পবিত্র কুরআন, নির্ভরযোগ্য হাদিস এবং রাসূল সাঃ-এর লাইলাতুল কদরের জন্য গৃহীত কর্মতৎপরতা লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
এ সম্মানিত রজনীর গুরুত্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, "আমি এ (কুরআনকে) কদরের রাতে নাজিল করেছি। তুমি কি জানো, কদরের রাত কী? কদরের রাত হাজার মাস হতেও উত্তম-কল্যাণময়।" (আল কদর: ১-৩)
শবে কদরের রাতটি কোন মাসে? এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন, "রমজান এমন মাস যাতে কুরআন নাজিল হয়েছে।" (বাকারা: ১৮৫)
লাইলাতুল কদরের রাতটি রমজানের কোন তারিখে? রাসূল সাঃ একটি রহস্যময় কারণে তারিখটি সুনির্দিষ্ট করেননি। ইমাম বুখারি, ইমাম মুসলিম, ইমাম আহমদ ও ইমাম তিরমিজি কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে বলা হয়েছে যে, হজরত আয়েশা রা: বর্ণনা করেছেন, নবী করিম সাঃ বলেছেন, "কদরের রাতকে রমজানের শেষ দশ রাতের কোনো বিজোড় রাতে খোঁজ করো।"
হজরত আবু বকর রা: ও হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত হাদিস থেকেও এ একই ধরনের তথ্য পাওয়া যায়। অবশ্য কোনো কোনো ইসলামি মনীষী নিজস্ব ইজতিহাদ, গবেষণা, গাণিতিক বিশ্লেষণ ইত্যাদির মাধ্যমে রমজানের ২৭ তারিখের রাতে (অর্থাৎ ২৬ রোজার দিবাগত রাতে) শবেকদর হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনার কথা জোর দিয়ে বলেছেন।
কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাঃ এটাকে সুনির্দিষ্ট করেননি, বরং কষ্ট করে খুঁজে নিতে বলেছেন। মহান আল্লাহ চান বান্দাহ কয়েক রাত ইবাদতে গভীর মনোনিবেশ করে এ মহামূল্যবান রাতের সন্ধান পাক। আল্লাহ তার বান্দাহদের সবরের পরীক্ষায় ফেলেছেন। এ রহস্যের অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে। বান্দাহ বিনিদ্র রজনী কাটাবে, সবর করবে; এর মধ্যে খুঁজে পাবে সম্মানীত রাত, পাবে আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাত; ফেরেশতার অদৃশ্য মোলাকাতে সিক্ত হবে তার হৃদয়, আপন রবের ভালোবাসায় হবে সে উদ্বেলিত। এ যেন দীর্ঘ বিরহের পর আপনজনকে ফিরে পাওয়ার আনন্দ। এ দীর্ঘ প্রতীক্ষার কষ্ট-বিরহের মাধ্যমে রব তার বান্দাহকে আরো আপন করে নেন। কাজেই শেষ দশ দিনের বিজোড় রাতগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ইবাদতে মশগুল হতে হবে। প্রতিটি রাতকেই লাইলাতুল কদর মনে করতে হবে। তাহলে লাইলাতুল কদর আল্লাহর মেহেরবানিতে হাতছাড়া হবে না ইনশাআল্লাহ।
রমজানের ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ তারিখের রাতগুলোই (অর্থাৎ ২০, ২২, ২৪, ২৬ ও ২৮ রোজার দিবাগত রাত) হলো শেষ দশকের বিজোড় রাত।
এ রাতের আরেকটি গুরুত্ব হলো এ পবিত্র রাতেই কুরআন নাজিল হয়েছে। আর এ কুরআনের সাথেই মানুষের ভাগ্য জড়িয়ে আছে। তাহলে লাইলাতুল কদরের আরেকটি অর্থ হয় ভাগ্য রজনী। যে মানুষ, যে সমাজ, যে জাতি, কুরআনকে বাস্তব জীবনবিধান হিসেবে গ্রহণ করবে, তারা পার্থিব জীবনে ও পরকালীন জীবনে সম্মানীত হবে। এ রাতে নাজিলকৃত কুরআনকে যারা অবহেলা করবে, তারা ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। এ রাতেই মানবকল্যাণে আল্লাহ মানুষের জন্য চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ফেরেশতাদের জানান। আল্লাহ বলেন- "এ রাতে প্রতিটি ব্যাপারে অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত ও সুদৃঢ় ফায়সালা জারি করা হয়।" (সূরা দুখান : ৪)
মহান আল্লাহ আরো বলেন- "ফেরেশতারা ও রূহ (জিব্রাইল আ:) এ রাতে তাদের রবের অনুমতিক্রমে সব হুকুম নিয়ে অবতীর্ণ হয়, সে রাত পুরোপুরি শান্তি ও নিরাপত্তার- ফজর উদয় হওয়া পর্যন্ত।" (আল-কদর : ৪-৫)
লাইলাতুল কদরের ফজিলতগুলো সংক্ষেপে নিম্নরূপঃ
* এ রাতটি হাজার মাস থেকে উত্তম- কল্যাণময় (কুরআন)
* এ রাতেই পবিত্র কুরআন নাজিল করা হয়েছে। (কুরআন)
* এ রাতে ফেরেশতা নাজিল হয় এবং আবেদ বান্দাহদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে।
* ফজর পর্যন্ত এ রাতে পুরোপুরি শান্তি ও নিরাপত্তার (কুরআন)
* এ রাতে প্রতিটি ব্যাপারে অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত ও সুদৃঢ় ফায়সালা জারি করা হয়। (কুরআন)
* এ রাতে ইবাদতে মশগুল বান্দাদের জন্য অবতরণকৃত ফেরেশতারা দোয়া করেন। (হাদিস)।
* গুনাহ মাফ : "যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে ঈমান সহকারে ও আল্লাহর নিকট হতে বড় শুভফল লাভের আশায় ইবাদতের জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে, তার পেছনের সব গুনাহ মাফ হয়ে যাবে।" (বুখারি-মুসলিম)।
* এ রাতে কল্যাণ থেকে একমাত্র হতভাগ্য লোক ছাড়া আর কেউ বঞ্চিত হয় না। (ইবনে মাজাহ-মিশকাত)।
কিয়ামুল লাইল বা রাত জাগা
‘কিয়ামুল লাইল’ অর্থ হলো রাত্রি জাগরণ। মহান আল্লাহর জন্য আরামের ঘুম স্বেচ্ছায় হারাম করে রাত জেগে ইবাদত করা আল্লাহর প্রিয় বান্দাহদের একটি গুণ। মহান আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাহদের পরিচয় দিয়েছেন এভাবে- "তারা রাত্রী যাপন করে রবের উদ্দেশ্যে সিজদাবনত হয়ে ও দাঁড়িয়ে থেকে।" (ফুরকান : ৬৪)
"তাদের পার্শ্বদেশ বিছানা হতে পৃথক থাকে (অর্থাৎ তারা শয্যা গ্রহণ করে না; বরং ইবাদতে মশগুল থাকে)। তারা (গজবের) ভয়ে এবং (রহমতের ) আশায় তাদের রবকে ডাকতে থাকে এবং আমি যা দিয়েছি তা হতে দান করে থাকে। কেউ জানে না। তাদের আমলের পুরস্কারস্বরূপ (আখেরাতে) তাদের জন্য কী জিনিস গোপনে রাখা হয়েছে।" (সিজদা : ১৬, ১৭)
আল্লাহর প্রিয় বান্দারা গোটা জীবনই এভাবে কাটান। আমাদের সে জীবনে প্রবেশ করতে হলে দরকার অধ্যবসায়। পবিত্র রমজান বিশেষ করে লাইলাতুল কদরের অনুসন্ধানের প্রচেষ্টা আমাদের ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌছতে সাহায্য করবে।
যে ব্যক্তি কদরের শুভফল লাভের উদ্দেশ্যে ইবাদতের জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে, আল্লাহ তার আগের পেছনের গুনাহ মাফ করে দেবেন।
রাসূল সাঃ রমজানের শেষ দশ দিন মসজিদে ইতেকাফে থাকতেন এবং ইবাদতে গভীর মনোনিবেশ করতেন।
কাজেই আমরা কোনো একটা বিশেষ রাতকে নির্দিষ্ট না করে হাদিস অনুযায়ী অন্তত রমজানের শেষ দশ দিনের বিজোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল কদরের সৌভাগ্য লাভের আশায় ইবাদতে মশগুল হই। আমরা এতে অবহেলা করলে হাদিসের ভাষায় হতভাগ্য হিসেবে চিহ্নিত হব। রাসূল সাঃ বলেন- "যে ব্যক্তি এ রাত থেকে বঞ্চিত হবে সে সমগ্র কল্যাণ ও বরকত হতে বঞ্চিত হবে। এর কল্যাণ থেকে একমাত্র হতভাগ্য লোক ছাড়া আর কেউ বঞ্চিত হয় না।" (মিশকাত)
^
^
পবিত্র লাইলাতুল কদর... লাইলাতুল কদর । #শবেকদর । কিয়ামুল লাইল
মহিলা সাহাবীদের নামের তালিকা দেখুন। ইসলামের সৌভাগ্যবান ৭৯ জন মহিলা সাহাবীদের নাম
ReplyDeletehttps://islami-bangla.blogspot.com/2020/02/blog-post_139.html