স্ব‌প্নের ব্যাখ্যা যেভা‌বে দেয়া হয়, সেভা‌বেই বাস্তবায়ন হয়: পর্ব-৯

স্বপ্ন‌ নি‌য়ে মিথ্যা বলা বিরাট অন্যায়। তাছাড়া স্বপ্নের স‌ঠিক ব্যাখ্যা পে‌তে উপযুক্ত ও বিস্বস্ত আ‌লে‌মে দ্বীনের প্র‌য়োজন। স্বপ্ন নি‌য়ে স‌ঠিক ব্যাখ্যা জানার উপায় না থাক‌লে, তা নি‌জের ভিত‌রে রাখাই শ্রেয়। যি‌নি স্ব‌প্নের ব্যাখ্যা জান‌তে চাই‌বে এবং যি‌নি স্ব‌প্নের ব্যাখ্যা দি‌বে; উভয়েরই উ‌চিত স্বপ্ন বলা বা ব্যাখ্যা নি‌য়ে সতর্ক থাকা। কারণ, স্ব‌প্নের ব্যাখ্যা যেভা‌বেই করা হয়; পরবর্তী‌তে সেভা‌বেই তা সংঘ‌টিত হয়।

হাদীস শরী‌ফে এসেছে,
عن أنس رضي الله عنه قال: قال رسول
الله صلى الله عليه وسلم: "إن الرؤيا تقع على ما تعبر،  فإذا رأى أحدكم رؤيا فلا يحدث بها إلا ناصحاً أو عالماً.
المستدرك: (4/391) وقال صحيح الإسناد ولم يخرجاه، ووافقه الذهبي، وصححه أيضاً الألباني في سلسلة الأحاديث الصحيحة (120).
হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সঃ) বলেছেন: স্বপ্নের যেভাবে ব্যাখ্যা করা হয় সেভাবে তা বাস্তবায়িত হয়। যখন তোমাদের কেউ স্বপ্ন দেখবে তখন আলেম অথবা কল্যাণকামী ব্যতীত কারো কাছে তা বর্ণনা করবে না। (মুসতাদরাক, শায়খ আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন)
أخرج أبو داود والترمذي وابن ماجه، عن أبي رزين العقيلي، عن النبي صلى الله عليه وسلم قال: "الرؤيا على رجل طائر، ما لم تعبر، فإذا عبرت وقعت.
أخرجه أبو داود: (4/305) كتاب الأدب - باب ما جاء في الرؤيا - رقم (5020).
আবু দাউদ, তিরমিজী, ইবনে মাজাহ আবু রাযীন আল উকাইলী থেকে বর্ণনা করেন, নবী কারীম (সাঃ) বলেছেন: স্বপ্ন হল, উড়ন্ত পা- এর মত। (যা ভাল ও খারাপ উভয়ের সম্ভাবনা রাখে) যতক্ষণ না তার ব্যাখ্যা করা হয়। যখন একটি ব্যাখ্যা দেয়া হয় তখন তা বাস্তবায়িত হয়।
হাদীস শরী‌ফে আরো এসেছে,
عن عائشة زوج النبي صلى الله عليه وسلم قالت كانت امرأة من أهل المدينة لها زوج تاجر يختلف، فكانت ترى رؤيا كلما غاب زوجها وقلما يغيب إلا تركها حاملاً، فتأتي رسول الله- صلى الله عليه وسلم - فتقول: إن زوجي خرج تاجراً فتركني حاملاً، فرأيت فيما يرى النائم أن سارية بيتي انكسرت، وأني ولدت غلاماً أعور، فقال رسول الله-  صلى الله عليه وسلم - خير يرجع زوجك عليك، إن شاء الله تعالى صالحاً، وتلدين غلاماً براً - فكانت تراها مرتين أو ثلاثاً، كل ذلك تأتي رسول الله- صلى الله عليه وسلم- فيقول ذلك لها، فيرجع زوجها وتلد غلاماً، فجاءت يوما كما كانت تأتيه ورسول الله - صلى الله عليه وسلم - غائب، وقد رأت تلك الرؤيا فقلت لها: عم تسألين رسول الله - صلى الله عليه وسلم -يا أمة الله؟.
فقالت: رؤيا كنت أراها فآتي رسول الله - صلى الله عليه وسلم - فأسأله عنها، فيقول خيراً، فيكون كما قال، فقلت: فأخبريني ما هي؟ قالت حتى يأتي رسول الله - صلى الله عليه وسلم - فأعرضها عليه كما كنت أعرض، فوالله ما تركتها حتى أخبرتني، فقلت والله لئن صدقت رؤياك ليموتن زوجك وتلدين غلاماً فاجراً، فقعدت تبكي، فقال لها: ما لها يا عائشة؟ فأخبرته الخبر وما تأولت لها، فقال رسول الله - صلى الله عليه وسلم - مه يا عائشة إذا عبرتم للمسلم الرؤيا، فاعبروها على خير، فإن الرؤيا تكون على ما يعبرها صاحبها، فمات والله زوجها ولا أراها إلا ولدت غلاماً فاجراً .
الدارمي: (2/174) - رقم (2163) وحسنه ابن حجر في الفتح (12/450) بيد أن في إسناده محمد بن إسحاق وهو يدلس ولم يصرح بالتحديث.
হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন; মদীনার অধিবাসী এক মহিলার স্বামী ছিল ব্যবসায়ী। ব্যবসায়িক কাজে বিভিন্ন দেশে আসা যাওয়া করত সে। যখনই তার স্বামী বিদেশে যেত তখনই সে নারী স্বপ্ন দেখত। আর তার স্বামী সর্বদা তাকে গর্ভবতী রেখে যেত। একদিন সে রাসূল (সঃ) এঁর কাছে এসে বলল, আমার স্বামী সফরে গেছে। আমি গর্ভবতী। আমি স্বপ্ন দেখলাম, আমার ঘরের চৌকাঠ ভেঙ্গে গেছে। আর আমি একটি এক চোখ কানা সন্তান প্রসব করেছি।
রাসূল (সঃ) বললেন; ভাল স্বপ্ন দেখেছো। ইনশা'আল্লাহ তোমার স্বামী তোমার কাছে সহীহ-সুস্থ্য অবস্থায় ফিরে আসবে আর তুমি একটি সুস্থ্য-সুন্দর সন্তান প্রসব করবে।
এভাবে সে দু বার বা তিনবার স্বপ্ন দেখেছে। আর প্রতিবারই রাসূল (সঃ) এঁর কাছে এসেছে। তিনি প্রতিবার এরকম ব্যাখ্যাই দিয়েছেন। আর প্রতিবার সে রকমই বাস্তবায়িত হয়েছে।
একদিন মহিলা আগের মতই আসলো। রাসূল (সঃ) তখন অনুপস্থিত ছিলেন। সে স্বপ্ন দেখেই এসেছে।
আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, হে আল্লাহর বান্দী! তুমি রাসুলুল্লাহর নিকট কী জিজ্ঞেস করবে?
সে বলল, আমি একটি স্বপ্ন প্রায়ই দেখি। অত:পর রাসূল (সঃ) এঁর কাছে আসি। তিনি সুন্দর ব্যাখ্যা দেন। সেটাই বাস্তবে পরিণত হয়।
আমি বললাম, তুমি আমাকে বল, কী স্বপ্ন দেখেছো? সে বলল, রাসূল (সঃ) আসুক, তারপর বলব।
আমি তাকে বারবার অনুরোধ করতে লাগলাম স্বপ্নটি বলার জন্য- যেমনটি আমার অভ্যাস। অবশেষে সে আমাকে স্বপ্নের কথা বলতে বাধ্য হল। আমি বললাম, আল্লাহর কসম! তোমার স্বপ্ন যদি সত্যি হয়, তাহলে তোমার স্বামী মারা যাবে। আর তুমি একটি অপূর্ণাঙ্গ বা অসুস্থ ছেলে প্রসব করবে।
তখন মহিলাটি বসে কাঁদতে লাগল। রাসুল (সঃ) এসে বললেন: হে আয়েশা! এর কি হয়েছে?
তখন আমি পুরো ঘটনা ও স্বপ্ন সম্পর্কে আমার দেয়া ব্যাখ্যা রাসূল (সঃ) কে জানালাম।
রাসূল (সঃ) বললেন: হে আয়েশা এটা কী করলে? যখন কোনো মুসলমানের স্বপ্নের ব্যাখ্যা করবে তখন সুন্দর ও কল্যাণকর ব্যাখ্যা দেবে। মনে রাখবে স্বপ্নের যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়, বাস্তবে তাই সংঘটিত হয়।
হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন; আল্লাহ তাআলার কি ইচ্ছা জানি না। মহিলাটির স্বামী মারা গেল আর দেখলাম সে একটি অসুস্থ অপূর্ণাঙ্গ ছেলে প্রসব করল। (দারামী। ইবনে হাজার রহ. হাদীসটিকে হাসান বলে অভিহিত করেছেন।)
উপ‌রোক্ত হাদীস থেকে শিক্ষা ও মাসায়েলঃ
এক. স্বপ্ন বর্ণনা করার ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। যাকে তাকে স্বপ্নের কথা বলা উচিত নয়।
দুই. সর্বদা আলেম, শুভাকাংখীর কাছে স্বপ্নের কথা বলবে। যে শুভাকাংখী নয় তার কাছে কোনো ধরনের স্বপ্নের কথা বলবে না।
তিন. স্বপ্ন একটি উড়ন্ত পায়ের মত। এ কথার অর্থ হল শূন্যে ঝুলিয়ে রাখা পা যেমন যে কোনো সময় মাটিতে রাখা যায় আবার নীচে আগুন থাকলে তাতেও রাখা যায়। স্বপ্ন এমনই, এর ব্যাখ্যা ভাল করা যায় আবার খারাপও করা যায়। যে ব্যাখ্যাই করা হোক, সেটিই সংঘটিত হবে।
চার. মদীনার এই মহিলাটি রাসূল (সঃ) এঁর কাছে স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে আসতেন। স্বপ্নটি বাহ্যিক দৃষ্টিতে খারাপ হলেও রাসূল (সঃ) ভাল ও সুন্দর ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন।
তাই স্বপ্ন দ্রষ্টার পরিচিতদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে ভাল আলেম তার কাছে স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া উচিত।
পাঁচ. প্রশ্ন হতে পারে, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা কেন এ ধরনের ব্যাখ্যা দিলেন? এর উত্তর হল :
(ক) এ মহিলার স্বপ্নের ব্যাখ্যা রাসূল (সঃ) কীভাবে করেছেন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা তা জানতেন না। তাই তিনি নিজের পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন।
(খ) আয়েশা (রাঃ) স্বপ্নের বাহ্যিক দিক তাকিয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ঘরের চৌকাঠ দ্বারা স্বামী বুঝেছেন। আর এক চোখ অন্ধ সন্তান দ্বারা অপূর্ণাঙ্গ সন্তান বুঝেছেন।
(গ) স্বপ্নের খারাপ বা অশুভ ব্যাখ্যা করা অনুচিত। স্বপ্ন ব্যাখ্যার এ মূলনীতির কথা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা আগে থেকে জানতেন না। এ ঘটনার পর রাসূল (সঃ) তাকে জানিয়েছেন। এবং তিনি জেনেছেন।
(ঘ) এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা এভাবে করা যেত, যা রাসূল (সঃ) করতেন। তা হলো: ঘরের চৌকাঠ ভেঙ্গে যাওয়ার অর্থ হল, ঘর প্রশস্ত হবে। প্রাচুর্য ও সচ্ছলতা আসবে। আর এক চোখ কানা সন্তানের অর্থ হল, সন্তানটি তার চোখ দিয়ে শুধু ভাল বিষয় দেখবে।
এটা হল দূরবর্তী ব্যাখ্যা। আর আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা করেছেন নিকটবর্তী ব্যাখ্যা।
ছয়. যার কাছে স্বপ্নের ব্যাখ্যা চাওয়া হবে, তিনি যদি জানেন, এর ব্যাখ্যা খারাপ তবে তিনি তা বলবেন না। যথাসম্ভব ভাল ব্যাখ্যা করে দেবেন। নয়তো চুপ থাকবেন। অথবা বলবেন, আল্লাহ ভাল জানেন।
সায়ীদ ইবনে মানসূর বর্ণনা করেন, আতা রহ. সব সময় বলতেন : স্বপ্নের ব্যাখ্যা যা দেয়া হয়, সেটাই সংঘটিত হয়। (ফাতহুল বারী)
প্রশ্ন হতে পারে তাহলে তাকদীরের ব্যাপারটা কি হবে?
উত্তর সোজা। তাকদীরে এভাবেই লেখা আছে যে, অমুক ব্যক্তি এভাবে ব্যাখ্যা করবে। আর তাই সংঘটিত হবে। কিন্তু আমাদের কর্তব্য হবে, কখনো খারাপ বা অশুভ ব্যাখ্যা না দেয়া। তাকদীরে কি আছে আমরা তা জানি না।
এ জন্য রাসূল (সঃ) যে কোনো মানুষের কাছে স্বপ্নের কথা বলতে নিষেধ করেছেন।
স্বপ্নের কথা শুধু তাকে বলা যাবে যে আলেম, বন্ধু, শুভাকাংখী ও কল্যাণকামী। অর্থাৎ যে আপনার কোন প্রকার অকল্যাণ চায় না। এ ছাড়া অন্য কারো কাছে নয়।

আরেকটি ঘটনাঃ
এক মহিলা একটি দুগ্ধপোষ্য শিশুকে নিয়ে ইমাম ইবনে সীরিন রহ.-এর শিক্ষা মজলিসে আসল। এসে তিনি ইমামের ছাত্রদের কাছে জিজ্ঞেস করল, ইমাম সাহেব কোথায়? ইমাম সাহেবের একজন বোকা ছাত্র বলল, আপনি তার কাছে কেন এসেছেন?
মহিলাটি বলল, আমি এ ছেলেটির ব্যাপারে একটি স্বপ্ন দেখেছি, তার ব্যাখ্যা জানার জন্য এসেছি।
ছাত্রটি বলল, কি স্বপ্ন দেখেছেন? মহিলাটি বলল, আমি দেখেছি আমার এ ছেলেটি সাগর থেকে পানি পান করছে।
ছাত্রটি তাড়াতাড়ি ব্যাখ্যা দিল, বলল, তাহলে তো সে পেট ফুলে মারা যাবে।
তৎক্ষনাৎ শিশুটির পেট ফুলে উঠল। আর চিৎকার করে মারা গেল।
মহিলাটি কাঁদা শুরু করল। এরই মধ্যে ইমাম সাহেব এসে পড়লেন। ঘটনা শুনে তিনি বললেন: যদি তুমি স্বপ্নের ব্যাখ্যা না করে ছেড়ে দিতে তাহলে ছেলেটি এ দেশের সবচেয়ে বড় আলেম ও বিদ্যান হত।
সাগরের অর্থ শুধু পানের অযোগ্য নোনা পানিই নয়। সাগরের ব্যাখ্যা হল, মনি, মুক্তা, হীরা, প্রবাল।
কাজেই যিনি স্বপ্নের ব্যাখ্যা করবেন তিনি সব সময় ইতিবাচক ও কল্যাণকর ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবেন।
(আল কাওয়ায়েদুল হুসনা ফী তাবীলির রুইয়াঃ শায়খ আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ আস সাদহান)



স্বপ্ন নিয়ে আরও পোস্ট:
স্বপ্ন নি‌য়ে ধারাবা‌হিক প্র‌তি‌বেদনের আজ ১ম পর্ব
^
^
#স্বপ্ন ... স্ব‌প্নের ব্যাখ্যা যেভা‌বে করা হয় তাই হয় ।  স্ব‌প্নের ব্যাখ্যা . যেভা‌বে স্বপ্ন বলা হয়, কিভা‌বে স্ব‌প্নের ব্যাখ্যা করা হয় ।।

No comments:

Post a Comment