এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৮৪৩তম পর্বে টাইফয়েড জ্বর বিষয়ে কথা বলেছেন ডা. কে এফ এম আয়াজ। বর্তমানে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।
টাইফয়েড জ্বর কেন হয়?
আমাদের দেশে টাইফয়েড বেশ প্রচলিত একটি জ্বর। কেন এই জ্বর হয়?
প্রশ্ন : একজন মানুষ টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয় কেন?
উত্তর : আমি একটু স্মরণ করব আমার শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক রফিক উদ্দিন স্যারকে। স্যার একটি কথা বলতেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের দুটি জ্বরে চিকিৎসা জানলে তুমি ডাক্তারি করে খেয়ে-পরে থাকতে পারবে।’ কোনটি ভাইরাস, কোনটি টাইফেড জ্বর—সেটি বুঝতে হবে। কারণ, এর প্রকোপ এত বেশি আমাদের দেশে যে এটি নির্ণয় করা খুব জরুরি।
আপনি যে প্রশ্ন করেছেন, তাতে ফিরে আসি। টাইফয়েড আসলে পানীয় খাদ্যবাহিত রোগ। অর্থাৎ সালমোনিলা টাইফি, প্যারাটাইফি এ ও বি জীবাণুগুলো সাধারণত খাবার ও পানি থেকে আসে, বিশেষ করে পানি। যদি ঠিকমতো ফুটানো পানি না পেয়ে থাকে, সেইটার মাধ্যমে হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলি, অনেকেই বলেন, ‘আমি তো স্যার বাইরের খাবার খাই না, খেলেও গরম খাবার খাই।’ উদাহরণ হিসেবে বলে, ‘আমি তো স্যার ফুসকা-চটপটি খাই, সেটি তো আমাকে গরম করেই দিচ্ছে।’ আমি বলি, ‘ভালো। তবে সঙ্গে টকটা নেন না? ওই টকের পানি যেখান থেকে আসে, সেখান থেকে সমস্যা হতে পারে।’ সেখানে তো কয়েক ফোঁটা পানিই যথেষ্ট। তার সঙ্গে আমি আরেকটি বিষয় বলি। আমার বাসায় আমি পানি ফুটিয়ে খাই বা আমি পানি ফিল্টারে দিয়ে খাই, ঠিক আছে। তবে আমি পানি কতক্ষণ ফুটাই। এটা জানা খুব জরুরি। বলক ওঠার পর ৩০ মিনিট না ফুটলে জীবাণুর কিছু হয় না। আমি পানি ফুটাতে দিলাম, ১০ মিনিট বলগ উঠালাম, নামিয়ে ফেললাম, তাহলে জীবাণু তো মরবে না। এই সোর্স হলো টাইফয়েডের জীবাণু ছড়ানোর সোর্স। এগুলোকে প্রতিরোধ করাই হলো টাইফয়েড ঠেকানোর উপায়।
টাইফয়েড জ্বর, বুঝবেন যেভাবে
টাইফয়েড প্রচলিত জ্বর। তবে এখন চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু ইত্যাদি জ্বরের প্রকোপ বেড়েছে। এগুলোর মাঝে টাইফয়েড জ্বরকে আলাদা করে চেনার উপায় কী?
প্রশ্ন : অন্য জ্বরের সঙ্গে টাইফয়েড জ্বরকে পার্থক্য করার উপায় কী?
উত্তর : এ ক্ষেত্রে আমি একটি বিষয় যোগ করে নিই। আমি যেটি বলব, সেটি সাধারণ। তবে তার মানে এটিই নয়, সব রোগীর এটিই লক্ষণ। সাধারণত ভাইরাস জ্বরে অনেক জ্বর নিয়ে রোগী হাজির হয়। তবে টাইফয়েড জ্বরের যখন ইতিহাস নেই, তখন দেখি এই জ্বরটা সাধারণত রোগীর পাঁচ/সাত দিন আগে থেকে অল্প অল্প করে আসতে থাকে। রোগীর একবেলা জ্বর আসে, খারাপ লাগে। তবে একটু পর ভালো। রোগী ভাবে, আমি সুস্থ হয়ে গেলাম। রোগী হয়তো ঠিকমতো খেয়ালও করে না। খেয়াল করলে দেখা যায়, জ্বর এলে আস্তে আস্তে অল্প অল্প করে একবেলা করে আসছিল। এরপর দুবেলা/তিনবেলা করে আসে। যখন জ্বরের প্রকোপ বেড়ে গিয়ে একটি ভাইরাস জ্বরের মতো হচ্ছে, ১০৪ বা ১০৩ আসছে, তখন তারা আমাদের সামনে উপস্থিত হোন। এটা থেকে যেটা বোঝা যায় যে জ্বরটা ধীরে ধীরে ওঠে, সময়ের সঙ্গে বাড়ে এবং জ্বরের প্রথম দিকে লক্ষণ খুব কম থাকে। যখন সময় বাড়তে থাকে তখন দেখা যায়, জ্বরের পাশাপাশি পেটের কিছু সমস্যা হয়, বমি ভাব হয়। দেখা যায়, তার পায়খানা ঠিকমতো হচ্ছে না। প্রথম দিকে একটু কষা থাকে, তার পরের দিকে হালকা নরম হওয়া শুরু করে। পায়খানার গন্ধটা খুব খারাপ হয়ে যায়। রোগীর স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়। খাবারে একটি অন্য ধরনের গন্ধ পাওয়া শুরু হয়। ধীরে ধীরে রোগী অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়তে শুরু করে। এই পুরো প্রক্রিয়াটা হতে সাধারণত সপ্তাহ দেড়েক সময় লাগে।
‘চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক নয়’
যেকোনো রোগ বা জ্বরের ক্ষেত্রে অনেকেই না বুঝে অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে ফেলেন। এটি মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
টাইফয়েড জ্বর আমাদের দেশের বেশ প্রচলিত জ্বর। এই জ্বরের ক্ষেত্রেও অনেকে না বুঝে অ্যান্টিবায়োটিক খান। এতে পরে রোগ জটিল হয়ে ওঠে।
প্রশ্ন : টাইফয়েডের ক্ষেত্রে যদি কেউ নিজে নিজে অ্যান্টিবায়োটিক খান এবং খাওয়ার পরও যদি জ্বর না কমে, সিএস রিপোর্ট ঠিকমতো না আসে, রোগ জটিল হয়ে যায়, তাহলে তাঁদের বেলায় করণীয় কী?
উত্তর : এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন। এ ক্ষেত্রে আমরা সাধারণত দুটো জিনিস করতে পারি। একটি হলো আগে রোগীর ইতিহাসটা নিই। এটি খুব জরুরি। দিনে জ্বর কীভাবে শুরু হলো, বোঝা জরুরি। ক্লিনিক্যাল এক্সামিনেশন করে রোগীকে দেখতে হবে।
টাইফয়েড জ্বরে সাধারণত দ্বিতীয় সপ্তাহের পরে দেখা যায়, স্পিন ও লিভার বড় হয়ে যাচ্ছে। এটা আমরা, ক্লিনিশিয়ানরা দেখতে পারে। কারণ, এটি তো আন্ত্রিক জ্বর। আমরা এটি দেখতে পাই। তিন নম্বর হলো ট্রিপল অ্যান্টিজেন বা এগলুটেশন টেস্টগুলো করে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পাওয়া যেতে পারে। আপনি টাইটার দেখতে পারেন। এ ছাড়া তিন সপ্তাহের পরে গিয়ে প্রস্রাবে টাইফয়েড ধরা পড়ে। তো, সেই সময় কালচার করা যেতে পারে। তবে জ্বর হয়ে গিয়ে চিকিৎসকের জন্য সবচেয়ে কঠিন, রোগীর জন্য সবচেয়ে সহজ।
প্রশ্ন : এ ক্ষেত্রে অগ্রবর্তী কোনো পদ্ধতি নেই যে অ্যান্টিবায়োটিক চলা অবস্থাতেই ব্লাড কালচার করা যায়?
উত্তর : হ্যাঁ, করা যায়। আমরা ফ্যান পদ্ধতিতে ব্লাড কালচার করে থাকি। তবে এর ক্ষেত্রেই একই কথা, যদি সাত বা আট সপ্তাহ পার হয়ে যায়, এতেও অনেক সময় আসতে চান না। এটি অবশ্যই একটি জটিল প্রক্রিয়া। তখন চিকিৎসকদের এটিও চিন্তা করতে হয়। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া যেন অ্যান্টিবায়োটিক শুরু না করে। একজন লোকও যদি এটি শুনে কথাটি মেনে চলেন, সেটি হবে আজকের অনুষ্ঠানের সফলতা।
টাইফয়েড জ্বর : কিছু পরামর্শ
টাইফয়েড জ্বর হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করা জরুরি। না হলে রোগ জটিল হয়ে উঠতে পারে।
প্রশ্ন : টাইফয়েড জ্বরের ক্ষেত্রে কী পরামর্শ দিয়ে থাকেন?
উত্তর : সব সময় আমি বলি যে অ্যান্টিবায়োটিকটা না জেনে খাবেন না। টাইফয়েড এমন একটি জ্বর, যেখানে সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার প্রয়োজন হয় ন্যূনতম ১৪ দিন। অন্য জ্বরের মতো সাত দিন অ্যান্টিবায়োটিক খেলে টাইফয়েড জ্বর সরে যায় না। এ কারণে রোগ নির্ণয় করা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
টাইফয়েডের মূল পরীক্ষা হলো ব্লাড কালচার। এটা প্রথম সাত দিনের মধ্যে করলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইতিবাচক ফল পাওয়া যায়। আপনি যদি না জেনে অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে ফেলেন, তাহলে দুটো সমস্যা দেখা দেবে। এক, কালচার নেগেটিভ হয়ে যেতে পারে। এতে আপনি বুঝতে পারবেন না এটি টাইফয়েড কি না। এরপর কালচার করলেন। ফলে বোঝা যাবে না এই অ্যান্টিবায়োটিকটি কি আমি সাত দিন খাওয়াব, নাকি ১৪ দিন খাওয়াব। এটি এক নম্বর সমস্যা।
দুই নম্বর সমস্যা হলো, অনেকেই টাইফয়েডের জন্য নিজে নিজে চিন্তা করে নেন যে আমি টাইফয়েডের পরীক্ষা করাব এবং গিয়ে ওউডাল টেস্ট নামক একটি টেস্ট করে থাকেন। এখানে জানা প্রয়োজন, ওউডাল টেস্ট সাধারণত দ্বিতীয় সপ্তাহের আগে পজিটিভ হয় না। তাহলে এটি একটি অত্যন্ত ভুল প্রক্রিয়া। এখন বলাই হয় এটি না করতে। তাই আপনি যদি এটি করে চিন্তা করেন, আমার টাইফয়েড হয়েছে কি হয়নি, তাহলেও রোগ নির্ণয়ে একটি গণ্ডগোল থেকে যাবে। অ্যান্টিবায়োটিকটা কত দিন খেতে হবে, সেটি বোঝা যায় না।
তিন নম্বর সমস্যা যেটা দেখা যায়, আপনি এমন একটি অ্যান্টিবায়োটিক শুরু করলেন, যেটি আসলেই টাইফয়েডের বিরুদ্ধে কাজ করে। ওই গ্রুপের একটি অ্যান্টিবায়োটিক দোকানদার বা আরেকজন ডাক্তার সাহেব দিয়ে দিয়েছেন। আপনি খাচ্ছেন, জ্বর কমে গেল। পাঁচ দিনের দিন জ্বর কমে গেল। সপ্তম দিন আপনি দেখলেন জ্বর ভালো হয়ে গেছে। অ্যান্টিবায়োটিক আপনি বন্ধ করে দিলেন। ঠিক পরের সপ্তাহে জ্বরটা ফেরত আসবে। যখন ফেরত আসবে, আপনি ও আপনার চিকিৎসক উভয়েই সংকটে পড়ে যাবে। বোঝা যাচ্ছে না জ্বরের কারণ কী? এই রোগীরাই দেখা যায় দীর্ঘ মেয়াদে জ্বরে ভুগতে থাকে এবং রোগ নির্ণয় হয় না। তাই অ্যান্টিবায়োটিক শুরু করার আগে আপনি পরামর্শ নেন আমি শুরু করব কি না, কোন রোগের কারণে শুরু করব। ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করেন, আপনি যেই অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছেন, সেটি কেন দিচ্ছেন। আমি আমার রোগীকে বলি, এটা জানার অধিকার আপনার রয়েছে।