স্বাধীনতার ঋণ

এক. সুরুজ আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে বোধকরি সেপ্টেম্বরে। ও প্রশিক্ষণ নিয়েছে লোহারবন না জানি ইন্দ্রনগরে ভারতীয় পরিচালিত প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে। শতভাগ গ্রামের ছেলে। লেখাপড়া নেই, স্বভাব অমায়িক। কথা বলে খুব কম। যে ধরনের যুদ্ধ আমরা করছিলাম সে ধরনের যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যক্তিগত তথ্যাদি ফাইলে লিপিবদ্ধ থাকে না তবু সুবিধার মধ্যে এটুকুই যে যোদ্ধারাই এলাকার ছেলে। একে অপরকে না চিনলেও বাড়িঘরের ঠিকানা মোটামুটি ঠাওর করতে পারে। সুরুজ এসেছে এক-দুই দিন আগে। তার সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা হয়নি কারোর। গেরিলা যুদ্ধের যা নিয়ম-শত্রুকে নাজেহাল করা, ধ্বংস করা, অপদস্থ করা। তার স্বাধীন চলাচল ব্যাহত করে ‘অন্ধকার ঘরে সাপ’-এর মতো ভীতির সঞ্চার করা।
আমরা সুরুজসহ ১২ জনের একটা দল নিয়ে ময়নামতি-ব্রাহ্মণবাড়িয়া রাস্তার মাধবপুর গ্রামে এম্বুশ পেতে শত্রুর জন্য অপেক্ষা করছি। আমরা ১২ জন
সুরুজসহ। শত্রুর গাড়ি এলো এক ট্রাক। এম্বুশ হলো। গাড়িটি রাস্তার অপর পাড়ে কাত হয়ে পড়ে গেল পানির মধ্যে। আমাদের কারোরই কিছু হলো না। শুধু একটি গুলি সুরুজের কপাল দিয়ে ঢুকে মাথার পেছন দিক দিয়ে বড় ছিদ্র হয়ে মগজসহ বেরিয়ে গেল। আমরা কেউই টের পাইনি। সুরুজও একটু শব্দ করার অবকাশ পায়নি।
কয়েক দিন পরের কথা। কুমিল্লা-দাউদকান্দির রাস্তায় আরেকটি এম্বুশের জন্য এক বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। জায়গাটি মুরাদনগর থানার দক্ষিণ অঞ্চলে। পরদিন বেলা ১০-১১টার দিকে মাঝবয়সী এক দরিদ্র গ্রাম্য মহিলা এলেন আমাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য। আমরা সবাই উঠানে বসে অস্ত্র পরিষ্কার করছিলাম। ... আমার ছেলে সুরুজ তোমাদের মুক্তিবাহিনীতে গেছে। তোমরা তারে চেনো?
সুরুজের নাম শুনে কেন জানি আমরা সবাই উঠে দাঁড়িয়ে গেলাম। সবাই একে অপরের দিকে তাকাচ্ছি। অবচেতন সবার চোখ ভিজে আসছে। যদিও আমরা জানি এ মায়ের কাছ থেকে এ চোখের পানি লুকাতে হবে, লুকাতেই হবে। আমরা কেউ একটি শব্দও উচ্চারণ করিনি অথচ এ মা’র কীভাবে জানি প্রতীতি জন্মালো যে তার ছেলে সুরুজকে আমরা চিনিই শুধু না, সে আমাদের সঙ্গে আছে। লুঙ্গির এক টুকরা কাপড়ের মধ্যে বাঁধা মুড়ির একটা পোঁটলা এগিয়ে দিয়ে বললো, এই মুড়িটা রাখো। তোমরাও খেয়ো, আমার সুরুজকেও দিও।
আমি মুড়ির পোঁটলাখান নিলাম। এরপর ভাঁজ করা একটা পুরনো লুঙ্গি দিয়ে বলল, আমার সুরুজ তো এক কাপড়ে যুদ্ধে গেছে এই লুঙ্গিটা তারে দিও। কষ্টে বুকটা ভারী হয়ে গেল, মুখে কথা সরলো না একটাও। সবাই বোবা হয়ে রইলাম। অথচ চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে মা’গো তোমার সুরুজ যুদ্ধে শহীদ হয়েছে। আমরাই তাকে কবরে শুইয়ে এসেছি। এ পৃথিবীর কোনো কিছুই আর তাকে পৌঁছানো যাবে না। কী করে মাকে বলি যে তোমার সুরুজ নেই। এরপর দুটি দশ টাকার নোট আমাকে দিয়ে বললো, আমার সুরুজের বাপ তো খুব রাগী মানুষ। আমার সুরুজ একটা টাকাও নিয়ে যেতে পারে নাই। টাকাটা নিলাম। এমন মূর্ত অভিনয় করলাম যে গর্ভধারিণী মাও বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারলেন না। কসম কেটে বলতে পারি— এ অভিনয় মহিলা সমিতি মঞ্চের দক্ষ অভিনেতাকেও হার মানায়।
সুরুজ,
আইস দেইখ্যা যা তোর দেশটাকেই আমরা কী বানাইছি, কই লইয়া যাইতাছি। এই দেশের লেইগ্যা তুই জান দিলি ক্যান? দেখলি না আমরা একটা গুল্লির আঁচড়ও খাই নাই। মাকে কান্দাইলি, বাপকে কান্দাইলি, আমরারে কান্দাইতাছোছ, তোরে নিয়া কয়ডা লাইন লিখতে আজকা আমার আষ্ট দিন ক্যান লাগে? তোর মায়ের সামনে হেইদিন চোখের পানি আটকাইছি, আজকা একলা ঘরে ক্যান পারি না? চোখের পানি আমার পাকনা দাড়িগুলো ভিজাইয়া লেখাটি ঝাপসাইয়া ফেলতাছে।
সুরুজরে তুই ব্যাঁইচা থাক।
দুই. সোনামুড়ায় (ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা জেলার বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী থানা-সোনামুড়া) এক সকালে ছোট্ট চিকিৎসালয়ে আক্তার। ক্যাপ্টেন (ডা.) আক্তার আহমেদ, বীরপ্রতীক (প্রয়াত)। আর লুলুর (অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, একাত্তরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি অনার্সের শেষ বর্ষের ছাত্রী, কবি সুফিয়া কামালের কন্যা) সামনে একরাশ ধুলা উড়িয়ে জোরে ব্রেক কষে এক জিপ এসে থামল। জিপ থেকে নেমে এলো ১৬-১৭ বছরের দুই কিশোর। ভীষণ ব্যস্ত। গাড়ির পেছনে হোগলায় শায়িত আহত সহযোদ্ধাকে নামালো দুজন খুব সাবধানে ধরাধরি করে। সমবয়সী আহত বন্ধুকে নিয়ে এসেছে চিকিৎসার জন্য। আহত ছেলেটির খালি গা, লুঙ্গিটা হাঁটুর উপরে তোলা। সমস্ত দেহ কাদামাটি আর রক্তে একাকার। চোখ দুটি অর্ধেক বন্ধ হয়ে আছে। শুধু চোখের সাদা অংশটা দেখা যাচ্ছে। বন্ধুকে নামিয়ে রেখে ক্যাপ্টেন আক্তারের মুখের দিকে অপেক্ষায় তাকিয়ে রইল দুই কিশোর যোদ্ধা। ডাক্তারের দুই চোখ দিয়ে দেখে তারা বুঝে ফেলেছে যে আহত তরুণ স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য তার যা দেওয়ার তার সবটুকুই দিয়ে ফেলেছে। প্রিয় জন্মভূমির জন্য তার শেষ সম্বল প্রাণটা বিকিয়ে দিয়েছে কানাকড়ির দামে। হালকা-পাতলা ছেলেটির নামও জানে না কেউ। জানে না তার মা-বাবার নাম বা নিবাস। সে তো আর পেশাদার সৈনিক নয় যে যুদ্ধ করার জন্য মাসকাবারি বেতন পাবে, চৌদ্দপুরুষের ইতিহাস লেখা থাকবে ব্যক্তিগত নথিতে। তার নাম-ধামের প্রয়োজন নেই। সে ইতিহাস নয়, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসের সামান্য উপকরণ মাত্র। আক্তার হতাশায় ডানে-বামে মাথা নাড়লেন। সহযোদ্ধারা আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করল না। একটি কথাও না বলে পরম যত্নে আবার জিপের পেছনে তুলে নিল নিথর সহযোদ্ধাকে। যে পথ দিয়ে এসেছিল জিপটি সে পথ দিয়ে ধুলা উড়িয়ে আবার দৃশ্যের আড়ালে মিলিয়ে গেল। আক্তার আর লুলু তাকিয়ে আছে মাটির দিকে। চোখ থেকে তাদের নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে। আক্তার মনে মনে প্রার্থনা করলেন ছোট প্লিনির মতো— হে পৃথিবীর মাটি, ওকে তুমি কষ্ট দিও না। কারণ ও পৃথিবীতে বেঁচে ছিল সামান্য কদিনই। তাই সেও তোমাকে বেশি কষ্ট দেয়নি।
তিন. ৯ ডিসেম্বর দাউদকান্দি পশ্চিম-দক্ষিণে ফরাজিকান্দির চরে অকুতোভয় যোদ্ধা নজরুল ইসলাম এবং তার ছেলেরা ১১ জন পাকিস্তানিকে আত্মসমর্পণ করায়। নজরুলের সহযোদ্ধা হিসেবে ছিল সিকদার, বিল্লাল ও আরও কয়েকজন। শত্রু একদিকে স্তূপাকারে অস্ত্র রেখে মাথার ওপর হাত তুলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। নজরুলরা এগিয়ে যায়। কেউ জানত না শত্রুর এক সৈনিক একটি হ্যান্ড গ্রেনেডের সেফটি পিন খুলে গ্রেনেডের লিভারের ওপর থেকে পা সরিয়ে নেয় এবং ওরা একসঙ্গে নদীর দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সহযোদ্ধা অন্তপ্রাণ নজরুল সবাইকে গ্রেনেড বিস্ফোরণের কথা বলে মাটিতে পজিশন নিতে বলে। সবাই দ্রুত শুয়ে পড়ে, অলৌকিকভাবে অক্ষত অবস্থায় বেঁচে যায় সবাই। বাঁচেনি হতভাগা নজরুল। দাউদকান্দি ব্রিজের পশ্চিম প্রান্তে ওর কবর। বিশাল ব্রিজ ছোট কবরটিকে দৃষ্টির আড়াল করে ফেলেছে। পাথরকুচি, বালি, বাজার আর বর্জ্য কবরটিকে ঘিরে ফেলেছে।
চিন্তার বাইরে চলে গেছে মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধার কবর দৃষ্টির সামনে থাকে কী করে? সব মূল্যবোধ, সব অহংকার কি আমরা মুরগি বাজারে নিলামে দিয়েছি?
নোট : শহীদ নজরুল ইসলামের নামে দাউদকান্দি উপজেলার শহীদনগরের হাসানপুর এলাকায় একটি কলেজ আছে। উপজেলা চেয়ারম্যন— মেজর মো. আলী সুমন (অব.), সেনাবাহিনীতে আমার বহু বছরের জুনিয়র। গত ৮ ফেব্রুয়ারি তাকে টেলিফোনে অনুরোধ করেছিলাম নজরুলের কবরটি স্থানান্তর করে কলেজের ভিতর সমাহিত করতে এবং তার যুদ্ধের কাহিনী লিখে রাখতে।
আমার অনুরোধে ঢেঁকি গিলেননি।
চার. কোতোয়ালি থানার ভিতর হলেও মোহনপুর গ্রাম দিনাজপুর শহর থেকে প্রায় বারো মাইল দক্ষিণ-পূর্বে। জয়নাল আবেদিন এ গ্রামের এক খেটে খাওয়া গেরস্থ। স্ত্রী, কিশোরী মেয়ে আর শিশুপুত্র নিয়ে সংসার। আর দশজন শ্রমজীবী কৃষকের মতোই ‘সুখ-দুঃখে লেপ্টে থাকা বারো মাসের বছর’ জয়নালের। জয়নালরা রাজনীতির সুফলের অংশীদার হয় কদাচিৎ কিন্তু রাজনীতির ভোগান্তির সবটুকুই ভোগে। একাত্তরও এর ব্যতিক্রম রইল না। ছোট্ট ভুবন জয়নালের। এক প্রস্থ ভিটার ওপর এক রত্তির ঘর। তথাকথিত ইসলাম উম্মার ধ্বজাধারী পাকিস্তান নামক অকার্যকর এ দেশের অখণ্ডতা রক্ষায় মাথায় টুপি আর জানুর নিচে নামানো আলখেল্লায় আবৃত খেদমতগাররা (?) পাকিস্তানি সেনাদের গ্রামে গ্রামে নিয়ে যায়। সবটা অবশ্য তাদের পাকিস্তানের প্রতি মমতা বা প্রভুভক্তি নয়। ব্যাপক ব্যক্তি পরিচিতি এবং সামাজিক প্রতাপ প্রদর্শনের মোহে এরা ছিল সম্মোহিত। এক সকালে এই সেবাদাসরা পাকিস্তান বাহিনী নিয়ে এলো মোহনপুরে। জয়নাল এর কিছুই জানতো না। সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। দু’কোঠার ঘরের এক কোঠায় ধর্ষণ করা হলো জয়নালের স্ত্রীকে অপর কোঠায় কিশোরী কন্যাকে। কিশোরী মেয়ে ভালোভাবে জানত পাশের ঘরে তার স্নেহময়ী মায়ের অসহায় অবস্থা এবং তার মাও জানত যে এক ঘরে তার আদরের কন্যার করুণ পরিণতি। কারও কাছে অভিযোগ করল না মেয়ে, অনুযোগও করল না কোনো। গ্লানি ঢাকলো সে গলায় দড়ি দিয়ে। লজ্জাটুকু রেখে গেল আমাদের জন্য।
পাঁচ. নিজাম উদ্দিন মণ্ডল কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারীর একজন সচ্ছল গেরস্থ। ভুরুঙ্গামারীর একেবারে উত্তরে আসামের গোয়ারপাড়া জেলার ধুবড়ীর এপারের গ্রাম পরশুরামকুটি। এখানে নিজাম উদ্দিন মণ্ডলের একটি বড় কৃষি খামার। এ কৃষি খামারে রয়েছে গরু-মহিষ পালনের বিশাল একটি বাথান। এ বাথানটি দেখাশোনা করে পরশুরামকুটি গ্রামেরই ১৮-১৯ বছরের এক যুবক আবদুল খালেক। বছরকাবারি কামলা দেয় সে। আবদুল খালেক সব কাজই করে পরম নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে। ভাতের ফেনের সঙ্গে কত বড় টুকরা করে লাউ কাটলে গরুর খেতে সুবিধা হবে সেভাবে সে লাউ কাটে মনোযোগ দিয়ে। তারপর পরিমাণ মতো লবণ মিশিয়ে নিজের তর্জনি ডুবিয়ে চেখে দেখে। যেন নিজের খাবার। সূর্যোদয় থেকে গরু-মহিষের রাতযাপন পর্যন্ত একই কাজ ৩৬৫ দিন। ক্লান্তি নেই, একঘেয়েমি নেই। সবগুলো পশুই তার সন্তানসম। জীবনে বড় হওয়ার আশা নেই, লম্বা হওয়ার শখ নেই। অক্ষরজ্ঞানহীন ছেলেটির জীবন এই বাথানেই বাঁধা। এলো একাত্তর, শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। এই প্রথম বাথান ছাড়ল আবদুল খালেক। কী হলো তার কে জানে মুক্তিযুদ্ধে জিতলে তার কী লাভ। তাকে তো এক জীবন গতর খাটিয়েই উদরপূর্তি করতে হবে। তার অদৃষ্ট পরিবর্তনের সামান্যতম আশাও নেই। বোকা ছেলেটা কিছুই বোঝে না। দেশ স্বাধীন না পরাধীন তাতে তার মতো গেরস্থের বছরকাবারি কামলার কী যায় আসে?
নীলফামারীর হাতিবান্ধার যুদ্ধে পাকিস্তানিদের অপ্রতিরোদ্ধ মেশিনগান স্তব্ধ করার অতি সাহসী ও চরম ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নেয় আবদুল খালেক। অবারিত গুলি চলছে উভয় পক্ষের মধ্যে। শত্রুর আর্টিলারির গোলা মর্টারের শেল, ক্ষুদ্রাস্ত্রের মুষলধারার গুলি উপেক্ষা করে আবদুল খালেক ক্রলিং করে এগোতে লাগল। পর পর দুটি গ্রেনেড ছুড়ে ধুলার সঙ্গে মিশিয়ে দিল শত্রুর মেশিনগানের বাংকারটি। দখল হলো হাতিবান্ধা। আবদুল খালেকদের নিয়তিতে সুখ থাকে কদাচিৎ। আহত অবস্থায় পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়ল আমাদের আবদুল খালেক। ইতর পাকিস্তানিরা প্রথমে বেয়নেট দিয়ে তার চোখ দুটি তুলে ফেলে। তারপর তার হাত-পা বেঁধে লম্বা শক্ত দড়ি দিয়ে গাড়ি দিয়ে ইটের খোয়ার রাস্তায় টেনে টেনে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে। সেদিন ছিল ২০ নভেম্বর, শনিবার, ঈদুল ফিতরের দিন। ঈদ মানে আনন্দ।
আবদুল খালেকের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল। সে কবরের স্থান আজ আর কারোরই মনে নেই। সে তো বুদ্ধিজীবী নয়, আবদুল খালেক ভূমিসংলগ্ন মানুষ। মনে রাখার মতো সে কে?
ছয়. সপরিবারে ভারতে আশ্রয় নিতে সীমান্ত পার হওয়া প্রায়শই বিপদসংকুল হয়ে পড়ত। পাকিস্তানিরা দেখতে পেলে নির্বিচারে এলোপাতাড়ি গুলি করত। এতে সহায়তা থাকত মানুষ পাচারকারী ‘আদম বেপারি’দের। এই অসহায় মানুষগুলোর সঙ্গে থাকা টাকা-পয়সা, সোনা-দানা সব তারা সহজেই হস্তগত করত। নৃশংস সে দৃশ্য। এমনই এক পরিস্থিতির শিকার এক হিন্দু গৃহবধূ। বয়স মধ্য কুড়িতে। মাথায় সিঁদুর। মৃত্যুতুল্য গুলির আঘাত। কোমর থেকে নিচটা গুলিতে সম্পূর্ণ ঝাঁজরা হয়ে গেছে। ত্রিপুরার বিশ্রামগঞ্জে বাংলাদেশ হাসপাতাল কেবল স্থাপিত হচ্ছে। বাস্তবে তখনো কোনো যন্ত্রপাতি নেই সেখানে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে মহিলার। তাকে রক্ত দেওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। অথচ তাকে বাঁচিয়ে রাখার উপায় অস্ত্রোপচার করা ও বিরামহীন রক্ত দিতে থাকা। ডা. মুবিন এফআরসিএস করছেন স্কটল্যান্ডে। সব ফেলে গচ্ছিত সব অর্থ নিয়ে যোগ দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। ডা. মুবিনসহ কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছেন মহিলার পাশে। চেয়ে চেয়ে কেবল অগস্ত্য যাত্রা অবলোকন করা। একপর্যায়ে মহিলাটি ডা. মুবিনের ডান হাতটি ধরলেন তার দুটি দুর্বল হাত দিয়ে, অতি কষ্টে। ততক্ষণে কথা জড়িয়ে গেছে তার।
শেষ চেষ্টায় বহু কষ্টে বললেন, ‘দাদা আমি মরে যাচ্ছি। আপনারা কিন্তু আমাদের দেশটা স্বাধীন করে যাবেন। ’ একটা স্বাধীন দেশ কী এতই আরাধ্য যে Dying Statement-এর শেষ বাক্যটি হতে হবে দেশের স্বাধীনতার?
সাত. শ্রীমঙ্গল চা বাগানে পাকিস্তানিদের ক্যাম্প। অফিসাররা থাকে ম্যানেজারের বাংলোয়। বাংলোর আশপাশে যাওয়ার জো নেই। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা পাকিস্তানিদের। যুদ্ধের মাঠে দেশপ্রেম এক উন্মাদনার নাম। আলী আজগর এবং তার এক সহযোদ্ধা মিলে পরিকল্পনা করল বাংলোর সামনে কাঁচা রাস্তায় এম-১৪ অ্যান্টি-পারসোনাল মাইন লাগাবে। আস্তানার এত কাছে মুক্তিবাহিনী আসবে শত্রুর কল্পনার বাইরে। রাস্তার দুই পাশে ঘন চা বাগান। চারটি করে আটটি মাইন লাগাবে তারা। আলী আজগর যখন তার শেষ মাইনটি গর্তের ভিতর ঢোকাচ্ছে, তখন হঠাৎ খেয়াল করল চার পাকিস্তানি অফিসার গল্প করতে করতে বাংলোর দিকে হেঁটে আসছে। খামখেয়ালি ভাব। আজগরের অবস্থান থেকে পাকিস্তানিদের এবং মাইন পোঁতায় ব্যস্ত তার বন্ধুর দূরত্ব প্রায় সমান। ডাকতে গেলে পাকিস্তানিরা শুনে ফেলবেই শুধু নয়, তাদের দেখেও ফেলবে। দূরত্ব মাত্র ১০-১২ গজ অথচ তার বন্ধুর পিঠ তখন শত্রুদের দিকে। একটুকুও আঁচ করতে পারছে না সে। সেকেন্ডের অংশভাগে সিদ্ধান্ত নিতে হলো আলী আজগরের। নিরুপায় হয়ে গড়িয়ে ঢুকে গেল ঘন চা বাগানের ভিতরে। শত্রুরা খেয়াল করতে পারল না। সহযোদ্ধা বন্ধুটি ধরা পড়ল মাইন লাগানোরত অবস্থায়। একদম সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হলো অস্ত্রের আর বুটের আঘাত। মাইনের ভয়ে এরা আর স্থান ত্যাগও করতে পারছে না। নিজের পরিণতি মুহূর্তেই বুঝে ফেলল যোদ্ধা। শরীরের সব শক্তি দিয়ে নিজেকে একটু হাল্কা করে নিল। তারপর একটু আগে নিজের পোঁতা একটি মাইনের ওপর ডান পায়ের সজোরে আঘাত, চোখের পলকে বিকট শব্দে উড়ে গেল সবাই— আমরা যার নামধাম কিছুই জানি না, সে মুক্তিযোদ্ধাও।
আট . রমজান আলীর বয়স ১২-১৩। দিনাজপুর সীমান্তে হিলি এবং ফুলবাড়ীর মাঝামাঝি জলপাইতলি। এখানে পাকিস্তান আর্মির শক্ত প্রতিরক্ষা অবস্থান। মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণের উদ্দেশে রেকি করতে গিয়ে রমজান আলীকে সে ক্যাম্প থেকে বের হতে দেখে তাকে ধরে নিয়ে যায় আসে কমান্ডার হামিদুল হোসেন তারেকের (বীরবিক্রম) কাছে। বলে, ‘স্যার, এ শালা রাজাকার’। রমজান আলী কেঁদে-কেটে যে কাহিনী শোনায় তা সত্যিই করুণ, বুক ভরা কষ্টের। রমজান বাবা-মার একমাত্র সন্তান। সান্তাহার রেলস্টেশনের পাশে তার বাবার একটি ছোট্ট চা-বিস্কুটের দোকান। এপ্রিলের প্রথমে পাকিস্তানিরা সান্তাহার এসে তার সামনেই তারা তার বাবাকে দোকানের ভিতর গুলি করে হত্যা করে। রমজান দৌড়ে কাছেই তার বাড়িতে যায়। দেখে তাদের ঘরসহ গোটা বস্তি আগুনে জ্বলছে। বস্তির সব লোক যে যেভাবে পারছে দৌড়ে পালাচ্ছে। বহু খুঁজেও মাকে পায় না রমজান। আশ্রয় নেয় এক চালের গুদামের মালিকের কাছে। তারপর আরও দু’হাত বদল হওয়ার পর এক মালিক তাকে এই পাকিস্তানি ক্যাম্পে দিয়ে যায়। এখানে সে থালা-বাসন ধোয়া থেকে সব ফুট-ফরমায়েশ খাটে। তার প্রচণ্ড ঘৃণা পাকিস্তানিদের প্রতি। রমজান তার বাবা হত্যার এবং মা হারানোর প্রতিশোধ নিতে চায়। কমান্ডার তারেকের স্নেহে তাদেরই একজন হয়ে যায়। এলাকার পথঘাট তার নখদর্পণে। ১৯ নভেম্বর ভোরে জলপাইতলির পাকিস্তানি অবস্থান আক্রমণ করে দখল করে মুক্তিযোদ্ধারা। গাইড আমাদের রমজান আলী। শত্রু অবস্থান দখলের আনন্দে ও উচ্ছ্বাসে রমজান একাই দৌড় দেয় ক্যাম্পের উদ্দেশে। হঠাৎ বিকট শব্দ। শত্রুর পোঁতা মাইনে পড়ে রমজানের ছোট্ট শরীরটা খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যায়। যুদ্ধ জয়ের আনন্দ কোথায় মিলিয়ে গেল। প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধা রমজানের জন্য বুক ভাসিয়ে সশব্দে কাঁদতে থাকেন। এ পৃথিবীতে চোখের দুই ফোঁটা পানি ফেলার জন্য তখন তার আর কেউ নেই। সেদিন ঈদুল ফিতরের সকাল। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৬ গার্ড রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নের ভি কে দত্তের নির্দেশে পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় লাস্ট পোস্ট বাজিয়ে রমজানকে সবাই শেষ বিদায় জানায়। রমজান, বুদ্ধিজীবীদের কবরের ঠিকানা তো জানি। কিন্তু তোমার কবরটা জানি কোথায়?
দশ. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম। গাঁয়ের ছেলে, পড়ে মুন্সীগঞ্জের রামপাল হাইস্কুলে, দশম শ্রেণিতে। বাড়ি গজারিয়া থানার মধ্য ভবেরচর গ্রামে। একাত্তরে ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কটি গজারিয়ার ওপর দিয়ে যেত এবং এখনো যায়। বিমান নিতান্তই অপ্রতুল হওয়ায় এবং রেলপথ মুক্তিযোদ্ধারা অকেজো করে দেওয়ায় পাকিস্তানিদের প্রধান চলাচলের পথ ও প্রধান সরবরাহ পথ ছিল এই সড়কটি। রফিকের বয়স কত হবে? ১৬-১৭। অজো গ্রামে অবহেলায় বেড়ে ওঠা এক ছেলে— মুক্তিযুদ্ধের ঋজু এক যোদ্ধা। ২ নম্বর সেক্টর সদর দফতরের কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ এবং ক্যাপ্টেন হায়দার দুজনই অত্যন্ত স্নেহ করতেন রফিককে। সহজ সরল কথাবার্তা। খাদ নেই কোথাও। অন্তরে ডর-ভয় নেই এক রত্তিও। এই ক্ষ্যাপা ছেলে রফিক এবং তার সহযোদ্ধাদের দিয়েই খালেদ এবং হায়দার বাউসিয়া, ভাটেরচর, ভবেরচরসহ সংলগ্ন এলাকায় বারবার আক্রমণ চালিয়ে শত্রুকে দুই পায়ের ওপর ত্রস্ত রেখেছিলেন। পাকিস্তানিদের বহু লাশ গুনতে হয়েছে এই ছেলেদের সঙ্গে যুদ্ধে। প্রতিটি দিন মেলাঘরে খালেদ ও হায়দার অপেক্ষায় বসে থাকতেন রফিকের যুদ্ধের খবরের জন্য। মুক্তিযুদ্ধের বীরপ্রতীক রফিক আজ যখন তার যুদ্ধে হারানো সহযোদ্ধাদের স্মরণ করে তখন হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। চোখের পানি মুছে বাঁ হাতের তালুর উল্টো পিঠ দিয়ে। ভেজা হাত মুছে প্যান্টের সঙ্গে। চোখের পানি তারপরও থামে না। আমার অফিসে আসে, বলে ইব্রাহিমের কথা। বাবা নেই। মায়ের একমাত্র সন্তান। কপালে গুলি লাগে ইব্রাহিমের। গজারিয়ার যুদ্ধে শহীদ হয় সে। বলতে বলতে রফিক বলে, স্যার, আমার সঙ্গে যতজন শহীদ হয়েছে তাদের কারোরই বাবা ছিল না আর সবাই ছিল মায়ের একমাত্র সন্তান। ইব্রাহিমের মৃতদেহ নিয়ে রফিক ও তার সহযোদ্ধারা যায় ইব্রাহিমের মায়ের বাড়িতে। কিন্তু একমাত্র সন্তান ইব্রাহিমের মৃত্যু সংবাদ তার মাকে কে দেবে, কীভাবে? উঠানে ইব্রাহিমের মৃতদেহ রেখে রফিকরা ‘চাচি’ বলে ঘরে ঢোকে।
‘কীরে কী অইছে’? ইব্রাহিমের মা শোয়া থেকে উঠে দাঁড়ান। এ কথা সে কথার পর রফিক বলে, ‘চাচি’ এই যে আমরা যুদ্ধ করতাছি কোনদিন না জানি কে মইরা যাই। ’ ‘হাঁ, কথাটা তো ঠিক অই। ’
‘চাচি’, এমন কইরা তো আফনের ইব্রাহিমও মরতারে (মরতে পারে)।
‘তা তো পারেই— ইব্রাহিমের মায়ের সরল উক্তি। আমার ইব্রাহিম মরলে কী অইছে? তোরা আছোছ না। ’ অনর্গল আর উচ্চ স্বরে কথা বলা যে রফিকের অকৈশোর অভ্যাস, সে রফিক ডুকরাতে থাকে। কথা আর বলতে পারে না। বলে, স্যার, ইব্রাহিমের লাশটা তখন উডানে (উঠানে)। আবারও সশব্দে ডুকরাতে থাকে রফিক।
রফিক বলে চলে একাধারে, চোখের পানি পড়ে অবিশ্রান্ত ধরায়। এমন রফিকদের কথা বলা থামানো যায় না। এমন দেশপ্রেমের আর আত্মোৎসর্গের কাহিনী তারা শুকনা চোখ নিয়ে শুনতে পারবেন না। এত নোনা জল চোখে আসে কোথা থেকে?
এগার. আমাদের স্বাধীনতা বিনিময়হীন ছিল না। মূল্য দিতে হয়েছে। সে মূল্য মৃণ্ময়ী নয়, সে মূল্য চিন্ময়ী। এ জাতির অঢেল ঋণ। সে ঋণ শোধ করা প্রায় অসম্ভব।

কামরুল হাসান ভূঁইয়া
অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা, মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষক।

No comments:

Post a Comment