যে গ্রা‌মের নিরাপত্তা ব্যবস্থা লা‌গে না

যে গ্রামে ঘরের দরজা খোলা থা‌কে হরদম, চু‌রি-ডাকা‌তির কোনো ভয় নেই, দরকার হয়না কোন নিরাপত্তার, দোকা‌নিরা না থাক‌লেও দোকানপাট থা‌কে খোলা, ব্যাং‌কের তালাও সবসময় খোলা, নিরাপত্তা নিয়ে কারও কোনো অ‌ভি‌যোগ নেই।
ভাব‌ছেন বর্তমান যুগ-যামানায় এটা কি বাস্তব ? শুনতে অবাস্তব মনে হলেও এমন গ্রাম সত্যিই আছে। এটি ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের শনিশিংনাপুর গ্রাম।

সম্প্রতি বিবিসি অনলাইনের প্রতিবেদনে জানানো হয়, গ্রামটির বাসিন্দাদের এই নিরাপদ বোধ করার পেছনে অন্যতম কারণ ভগবান শনির প্রতি তাঁদের অগাধ বিশ্বাস। তাঁরা মনে করেন, এই দেবতাই তাঁদের গ্রামের অভিভাবক।
কথিত আছে, ৩০০ বছর আগে বন্যায় এই গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পানাসনালা
নদীর পানির ধাক্কায় একটি বড় কালো পাথর এই গ্রামের দিকে চলে আসে। গ্রামবাসী পাথরটিকে লাঠি দিয়ে আটকালে এর ভেতর থেকে রক্ত বের হতে থাকে। রাতে ওই গ্রামের মোড়লকে স্বপ্নে দেখা দেন শনি দেবতা। দেবতা তাঁকে বলেন, এই পাথরটি আসলে তাঁরই প্রতিকৃতি। তাঁকে এই গ্রামে অধিষ্ঠিত করতে নির্দেশ দেন। তবে শর্ত হচ্ছে, অবশ্যই তাঁকে খোলা জায়গায় রাখতে হবে। এখান থেকে তিনি পুরো গ্রামকে যেকোনো বিপদ থেকে রক্ষা করবেন।

এরপরই গ্রামের প্রাণকেন্দ্রে এই শনি দেবতার প্রতিকৃতি হিসেবে পাথরটিকে স্থাপন করা হয়। গ্রামবাসী তাঁদের বাড়িঘরের সব দরজা ও তালা খুলে ফেলেন। এমনকি গ্রামটিতে গণশৌচাগারে দরজা নেই। শুধু গোপনীয়তার জন্য পাতলা পর্দা রয়েছে। এরপর থেকে এই ধারাই চলে আসছে।
তবে গ্রামবাসী মাঝেমধ্যে ঘরে যেন কুকুর না ঢোকে, সে জন্য সামনের দরজায় গাছের ডালপালা দিয়ে তৈরি ঝাঁপ দিয়ে রাখেন। কিন্তু তাঁদের কোনো স্থায়ী দরজা নেই। এতে তাঁদের গয়না, টাকাপয়সা সবকিছুরই রক্ষার দায়িত্ব ভগবানকে দিয়ে তাঁরা নিশ্চিন্তে থাকেন।
গ্রামের কেউ অন্য কোথাও গেলে দেখভালের জন্য কাউকে কিছুই বলে না। এ কথা প্রচলিত রয়েছে, কোনো চোর এসে চুরি করলে অমনি সে অন্ধ হয়ে যাবে। কেউ অপকর্ম করলে তাকে সাড়ে সাত বছর দুর্ভাগ্য বয়ে বেড়াতে হবে।
শোনা যায়, একবার এক লোক তাঁর বাড়ির ফটকে কাঠের দরজা লাগিয়েছিলেন। এরপরই গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়েন তিনি।
গ্রামটিতে নতুন যেসব অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে, সেখানেও এই নিয়ম মেনে চলতে হয়। গত বছরের সেপ্টেম্বরে গ্রামটিতে প্রথমবারের মতো পুলিশ স্টেশন স্থাপন করা হয়। এখন পর্যন্ত সেখানে কোনো অভিযোগ আসেনি। এমনকি ২০১১ সালে গ্রামটিতে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের শাখা স্থাপন করা হয়, যা ভারতের প্রথম ‘তালাহীন’ শাখা। শাখাটিতে স্বচ্ছতার প্রতীক হিসেবে কাচের প্রবেশদ্বার তৈরি করা হয়েছে। গ্রামবাসীর বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এখানে খুব কমই দূরনিয়ন্ত্রিত তড়িৎ-চুম্বকীয় তালা ব্যবহার করা হয়।
এসব কারণে শনিশিংনাপুর পুরো ভারতে এক আকর্ষণে পরিণত হয়েছে। অন্তত প্রতিদিন ৪০ হাজার পর্যটক শনি দেবতাকে দর্শন করতে এই গ্রামে যান। যদিও সরকারি তথ্য অনুযায়ী, এই গ্রামে বছরে পর বছর চুরির কোনো ঘটনা ঘটেনি। ২০১০ সালে এক পর্যটক তাঁর গাড়ি থেকে ৩৫ হাজার রুপির সম্পদ চুরির অভিযোগ আনেন। আর ২০১১ সালের ৭০ হাজার রুপি মূল্যের সোনার গয়না চুরির অভিযোগ করেন। অবশ্য গ্রামবাসীর দাবি, এসব ঘটনা গ্রামের বাইরে ঘটেছে।

No comments:

Post a Comment